ঋজুচেতনার কবি মহাদেব সাহা |
ড. সৌমিত্র শেখর, অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা, বাংলাদেশ |
নবযৌবনকালে মহাদেব সাহার ‘আমি কি বলতে পেরেছিলাম’ কবিতা পড়ে নিজে এতোটাই সম্মোহিত হয়েছিলাম যে,সে প্রভাবে আমিও কিছু একটা লিখে ফেলেছিলাম। স্থানীয় এক সম্পাদক পনেরই আগস্ট উপলক্ষে সে লেখা ছেপেওছিলেন। উত্তরকালে তাঁর কবিতা আর একটু গভীরভাবে পড়ার সময় বুঝেছি,কবি হিসেবে তিনি উচ্চকণ্ঠ নন,তবে ঋজুচেতনাধারী আর তাই প্রভাব বিস্তারী। নরমভাবে কত শক্ত ভাব যে প্রকাশ করা যায়,কবি মহাদেব সাহা সেটা দেখিয়েছেন। উচ্চকণ্ঠ না হলেও কবিতার নীলকণ্ঠ এই মহাদেব;শতশোকেও অটল,দৃঢ়। সূচনা কিন্তু এভাবে হয় নি তাঁর। প্রথম কাব্যগ্রন্থ এই গৃহ এই সন্ন্যাস (১৯৭২) পাঠ করলে যে কবিকে চেনা যায়, তিনি অনেক বেশি আবেগপ্রবন,গভীর অনুভূতিতে আপ্লুত। এ কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা ক্ষুধা। একটু পড়লেই বোঝা যায় এ ক্ষিদে জঠরের নয় -অন্য কিছুর। কী চমৎকার উপমা-উৎপ্রেক্ষা দিয়ে সূচনা করেছেন কবি!
‘আমার শরীরে চোখে হৃদয়ে কেবল জ্বলে ক্ষুধা,
ক্ষুধার দীর্ঘ গ্রীবা স্থবির জন্তুর মতো মেলে দেয় লোলুপতা, অভ্যন্তরে
হৃদযন্ত্রে,মস্তিষ্কের সেলে ক্ষুধার তীব্র নখ ভয়ঙ্কর জ্বলে
যেন এক সর্বাঙ্গে সহস্র চোখ মাছি ঘুরে ঘুরে আমার
চোখের ভিতর থেকে মাংস তুলে খায়,[...]’
[ক্ষুধা]
এ কাব্যগ্রন্থেই গৃহকে সন্ন্যাস ভেবে জীবনের পর্বান্তরে কাতর কবি। কিন্তু অল্প পরেই সেই চেতনা তাঁর দৃঢ়মূল হয়,যে চেতনা আমাদের স্বদেশ ও স্বাজাত্যবোধ থেকে জাগ্রত। মানুষই হয়ে ওঠে তাঁর কবিতার কেন্দ্রমূল। মহাদেব সাহার কাব্যগ্রন্থাবলির একটি তালিকা দেবার চেষ্টা করা যাকঃ এই গৃহ এই সন্ন্যাস (১৯৭২),মানব এসেছি কাছে (১৯৭৩),চাই বিষ অমরতা (১৯৭৫),কী সুন্দর অন্ধ (১৯৭৮),তোমার পায়ের শব্দ (১৯৮২), ধুলোমাটির মানুষ (১৯৮২),ফুল কই,শুধু অস্ত্রের উল্লাস (১৯৮৪),লাজুক লিরিক (১৯৮৪),আমি ছিন্নভিন্ন (১৯৮৬),মানুষ বড়ো ক্রন্দন জানে না (১৯৮৯),প্রথম পয়ার (১৯৯০),কোথা সেই প্রেম কোথা সেই বিদ্রোহ (১৯৯০),প্রেমের কবিতা (১৯৯১),রাজনৈতিক কবিতা (১৯৯১),অস্তমিত কালের গৌরব (১৯৯২),আমূল বদলে দাও আমার জীবন (১৯৯৩),একা হয়ে যাও (১৯৯৩),যদুবংশ ধ্বংসের আগে (১৯৯৪),কোথায় যাই,কার কাছে যাই (১৯৯৪),সুন্দরের হাতে আজ হাতকড়া গোলাপের বিরুদ্ধে হুলিয়া (১৯৯৫), এসো তুমি পুরাণের পাখি (১৯৯৫), বেঁচে আছি স্বপ্নমানুষ (১৯৯৫), বিষাদ ছুঁয়েছে আজ, মন ভালো নেই (১৯৯৬), আকাশের আদ্যোপান্ত (১৯৯৬), তোমার জন্য অন্ত্যমিল (১৯৯৬), ভুলি নাই তোমাকে রুমাল (১৯৯৬), তুমিই অনন্ত উৎস (১৯৯৬), কেউ ভালোবাসে না (১৯৯৭), কাকে এই মনের কথা বলি (১৯৯৭), অন্তহীন নৃত্যের মহড়া (১৯৯৭), একবার নিজের কাছে যাই (১৯৯৭), পাতার ঘোমটা-পরা বাড়ি (১৯৯৭), ভালোবাসা কেন এত আলো-অন্ধকারময় (২০০৫) ইত্যাদি।
মহাদেব সাহার কবিতার দুটো স্পষ্টভাগঃ রাজনীতি এবং প্রেম। রাজনৈতিক চেতনা, আদর্শ, মূল্যবোধ যা-ই বলা হোক না কেন, এ প্রসঙ্গে তিনি আপোষহীন। কিন্তু প্রেমে দৃঢ়তা নেই, সমর্পণেই প্রাপ্তিবোধ তাঁর। নারীকে তিনি বলেছেন ‘অধিকার’। বলেছেন এভাবেঃ ‘হেলানো গ্রীবায় ধরো ভুলো রাজহাঁস/ যে হও সে হও তুমি।’ এ নারীর কোনো নাম নেই, পরিচয় নেই, ধর্ম নেই; আছে শুধু প্রেম, পুরুষের অধিকার। নারী শিরোনামের কবিতায় নারীকে নিয়ে এ ধরনের বক্তব্যই প্রকাশ করেছেন কবি। কিন্তু জীবন সায়াহ্নে এসে সেই কবিই তাঁর প্রেয়সী নারীকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন কালের অমোঘ সত্যঃ
‘তুমি কোথাও আর খুঁজে পাবে না টিনের চালে বৃষ্টির নৃত্য,
মন-উদাস-করা ঘুঘুর ডাক
খুঁজে পাবে না তোমার সেই কল্লোলিত জীবন,সেই আলুলায়িত দিনরাত্রি
তুমি কোথাও আজ আর খুঁজে পাবে না তোমার সেই সুখ,
সেই দুঃখ, সেই ভালোবাসা, বিরহ।’
[কোথাও আর খুঁজে পাবে না]
ভালোবাসার এই কথকতা মিথ্যে নয় মহাদেবের কবিতায়। কবি প্রেম ও কামের পার্থক্য সদাস্পষ্ট রেখেছেন। তাঁর কবিতায় দেহগন্ধী শব্দরাজীর ব্যবহার থাকলেও তা অনেক পরিশীলিত,পাঠ বা শ্রবণের মাত্রা ছাড়িয়ে যায় না। যেমনঃ তিনি যখন লেখেন –
‘দূরে, আরো অতি দূরে যেতে যেতে সঙ্গমে সৎকারে নেমে
আরো এক বিশুদ্ধ মাটির মর্ম জেনে নিতে হবে। কী সে প্রতিমা
কী সে প্রতীক, তোমরা তাহারও বেশি উদ্দামতা পাবে।
না হলে এ নারী হবে উরুর অশ্লীল, কোনো মর্মগ্রাহী নয়
মাত্র গ্রীসের গণিকা, মেয়ে অধর্ম অশ্লীল।’
[যাও সঙ্গমে সৎকারে, প্রেমে]
লক্ষ্য করার বিষয়, এখানে সঙ্গম শব্দটি ব্যবহার করা হলেও তা যৌনতার ভাব প্রকাশের আগেই ‘সৎকার’ শব্দের অনুপ্রাসে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। ঠিক তেমনি,‘ঊরুর অশ্লীল’ এবং ‘অধর্মেরঅশ্লীল’এর মধ্যে গ্রীসের গণিকা শব্দদ্বয় প্রতিস্থাপিত হয়ে ভাবসাম্যের সৃষ্টি করে। কিন্তু এসব কিছুকে সহ্য করে, প্রেম-প্রিয়া-প্রিয়্ভাষণ ইত্যাদিকে সমীহ করেই তাঁর রাজনীতিচেতনা এগিয়ে যায়। তিনি নিজেই বলেছেন কবিতায়ঃ
‘তোমার কোমল হাতের চেয়ে কম সুন্দর নয় সৃষ্টির হাতুড়ি,
যেমন প্রেমের চেয়ে কখনোই কম সুন্দর নয়, বিদ্রোহ।’
[নন্দনতত্ত্ব]
এই বোধ মহাদেব সাহার কবিতার গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। কবি ষাটের দশকের উত্তাল সময়কে দেখেছেন, দেখেছেন মুক্তিযুদ্ধ। তাঁর কিছু কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের এমন সব অনুভূতি প্রকাশিত, প্রত্যক্ষ সাক্ষী বা ভুক্তভোগী ভিন্ন অন্য কারো পক্ষে যা প্রকাশ করা অসম্ভব। যে গ্রাম প্রতিরাতে হাতছানি দিয়ে কবিকে ডাকতো উৎকণ্ঠিতা প্রেমিকার মতো, সেই গ্রামের এবং নিজ বাড়ির ধ্বংস স্তুপে দাঁড়িয়ে কবিমনের বিলাপ শোনা যায় ‘ফিরে আসা গ্রাম’ কবিতায়। এরপর শেখ মুজিব-হত্যা এবং তাঁর পরিবার-নিধন প্রসঙ্গে কবির আত্মোপলব্ধি এরকমঃ
‘আমার অক্ষমতাই রাসেলের হত্যাকারী, সুলতানার ঘাতক
আমার স্বপ্ন, আমার ভালোবাসা, আমার কোমলতা
আমি তোমাকে বাঁচাতে পারিনি
আমার কাপুরুষতাই তোমার হত্যাকারী।’
[তোমার হত্যাকারী]
এখানে বিবৃতিধর্মী কয়েকটি পঙক্তি উদ্ধার করা হলো। মহাদেব সাহার কবিতায় বিবৃতির উপস্থিতি সামান্যই। তাঁর কবিতায় নরম শব্দের কাব্যিক দ্যোতনা মুখ্য। তিনি যখন দেশ, ভাষা, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, অধিকার ইত্যাদি রক্ষার জোর দাবি উত্থাপন করেন, তখনও সে ভাষা প্রায়শ রূঢ় হয়ে যায় নাঃ
‘এদেশে কখন আসবে নতুন দিন? কখন উদ্দীপনা
অবসাদ আর ব্যর্থতাকেই দেবে নিদারুণ হানা
ছড়াবে হৃদয়ে আগামীর গাড় রঙ, ভাসাবে
মেঘের দূর নীলিমায় স্বপ্নের সাম্পান?’
[নববর্ষের চিঠি]
এই উদ্ধৃতিতে ছন্দের যথার্থতা আছে, শব্দের সহজ নির্বাচন আছে, পরম আশাবাদও বাদ যায় নি। তার পরও বলতে হয়, মহাদেব সাহা তাঁর কবিতায় আগে প্রেমিক, পরে অন্য কিছু। কারণ তিনি শুধু দেখেছেনই নন, সৃষ্টি করেছেন কবিতার ‘সম্পূর্ণ আকাশ’। আর প্রেমিক ছাড়া সম্পূর্ণ আকাশ দেখাই সম্ভব নয়, সৃষ্টি করা তো কোন ছাড়ঃ
‘যদি সত্যি সত্যি কেউ এই আকাশ দেখতে চায়, তাহলে তাকে
প্রেমিক হতে হয়,
কেবল একজন প্রেমিকই সম্পূর্ণ আকাশ দেখতে পারে।’
[একজন প্রেমিক যেভাবে আকাশ দ্যাখে]
দীর্ঘ পঙক্তির প্রতি পৃথক দুর্বলতা আছে মহাদেব সাহার। এটা তাঁর স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে একটি ফলকও বটে।
***
কবিতা হচ্ছে জীবনের শ্রেষ্ঠ অভিজ্ঞতার নির্যাস: মহাদেব সাহা |
![]() কবিতা হচ্ছে কবির জীবনের অপার সুখ, অপার দুঃখ। দুঃখ, ত্যাগ ও সীমাহীন যন্ত্রণা এড়িয়ে কবি হওয়া যায় না। কবিকে স্বাতন্ত্র্যধর্মী, ব্যতিক্রমী হতে হয়। তাকে আগের লেখা ছাড়িয়ে নতুন ভাবনায় যেতে হয়। নতুন বোধ তৈরিই কবির কাজ আমি অল্পতেই আত্মহারা হয়ে যাই, ভালোবাসায়। কেউ ভালো ব্যবহার করলে তাকে আমি আমার সর্বস্ব দিয়ে দিতে পারি। একাকীত্ব ও ব্যর্থতাবোধও আমার মধ্যে কাজ করে। বন্ধুত্ব ও উষ্ণ সাহচর্যের খুব মূল্য দিই আমি। হাইজ্যাকাররা ধরেও আমাকে ছেড়ে দেয়, বুঝলে? ওখানেও আমার ভক্ত আছে। ষাট দশক বাংলা কবিতার পালাবদলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ দশকে রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ, ব্যক্তিগত অনুভূতি, সমাজ ও পরিপাশ্র্বের বিবিধ বিষয় কবিচিত্তে আলোড়ন তোলে। বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কবি মহাদেব সাহা সমাজ, ব্যক্তিজীবন, আনন্দ-বেদনার কথকতা তার কবিতায় তুলে ধরেন। তার কবিতা প্রকৃতিবন্দনা, মানব-মানবীর আনন্দ-বেদনা দেশপ্রেম ও সমাজভাবনায় সমৃদ্ধ। রাজনৈতিক দর্শন, প্রণয়, বিরহ, ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতা আর জীবনযাপনের খুঁটিনাটি একজন কবিকে কবিতা রচনায় কীভাবে প্রাণিত করে অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায় মহাদেব সাহা ৯ সেপ্টেম্বর দৈনিক যায়যায়দিন পত্রিকা অফিসে শরতের এক সন্ধ্যায় তা আমাদের সঙ্গে ভাগ করে নেন। তার সঙ্গে এ আলাপচারিতায় অংশ নেন কথাসাহিত্যিক ও দৈনিক যায়যায়দিনের সাহিত্য সম্পাদক সালাম সালেহ উদদীন, প্রাবন্ধিক রতনতনু ঘোষ ও কবি সাইফুজ্জামান। নবীনরাই সাহিত্য বাঁচিয়ে রাখে। নবীনদের হাতেই সাহিত্যের বহমানতা। বাংলা কবিতা এমন পর্যায়ে পেঁৗছে গেছে যেখানে কারোরই আর খারাপ লেখা সম্ভব নয়। নবীনদের লেখা বেশ ব্যঞ্জনাধর্মী। তারা যথেষ্ট ভালো লিখছে। সালাম সালেহ উদদীন: কবি মহাদেব সাহা আপনাকে শরতের এ সন্ধ্যার আলাপচারিতায় স্বাগত জানাই। আপনাকে দেখলে মনে হয় আপনি একজন উদাসীন অন্যমনষ্ক মানুষ, সর্বতোভাবে কবি। আপনার পরনেও গেরুয়া রঙের পাঞ্জাবি। কবিতায় আমরা দেখি অসম্ভব শুভ্রতা, সৌন্দর্য প্রেমবোধ আর সামাজিক চেতনা। আপনার প্রথম বই 'এই গৃহ এই সন্ন্যাস' কাব্যগ্রন্থের প্রেরণা কী? এসব কবিতা কীভাবে লেখা? মহাদেব সাহা: সবটা ব্যাখ্যা করে বলা যাবে না। তবে এটুকু বলতে পারি সেই শৈশবেই মায়ের কাছ থেকে আমার ছন্দের কানটা তৈরি হয়। আমার মা খুব সুন্দর রামায়ণ, মহাভারত পাঠ করতেন। কিছু গানও লিখেছেন আমার মা। দু'একটা মনেও আছে আমার। মার লেখা গান এখনো মাঝে মাঝে আমার মনে পড়ে। আমি একমাত্র সন্তান। তবে একটি যৌথ ধনাঢ্য পরিবারে আমার বেড়ে ওঠা। রাখাল আর মধু বৈরাগীর কোলে আমি মানুষ হয়েছি। মধু দা গান শোনাতেন : 'বিয়া না করাইলে দাদা, আসাম যাবো গা, আসাম যাইয়া করব বাড়ি, বিয়া করব সুন্দর নারী; দাদা দেশে আসব না।' আমার তিন চার বছরের স্মৃতিও মনে আছে। মা-র হাতেই আমার খাওয়া, তার কোলেই আমার ঘুম। বাইরের দিক থেকে দেখলে আমাকে ঠিক বোঝা যাবে না, আমার ভেতরটা দারুণ অগোছালো। বাইরেরটা গুছিয়ে রেখে এলোমেলো ভেতরটা ঢাকতে চেয়েছি। ভাইবোন না থাকলেও যৌথ পরিবারের মধ্য থেকে বড় হওয়া আমার। অনিয়ম করাই আমার স্বভাব। অনিয়ম আর নিজের প্রতি অযত্নের আমি মাস্টার। অনিয়ম করেও প্রকৃতির কৃপায় বেঁচে আছি। আমি বোধহয় বিশ্ববাউল, আমার কবিতায়ও আছে, আমি সবখানে থেকেও নেই, মন আমার পাগলা ঘোড়া। ভেতরে সন্ন্যাস ভাব আমার ছোটবেলা থেকে। আমার সঙ্গে যে সংসার করে সে জানে আমি কতখানি বোহেমিয়ান, কতোখানি খারাপ। স্কুলে থাকতে সাধুর পেছনেও ঘুরে বেড়াতাম। তাঁর কথা ছিল : সব ধর্মের মূলে এক। আর তা হলো কল্যাণ, শান্তি ও মানুষকে ভালোবাসা। আমার অনেক লেখা হারিয়ে গেছে। বাইরে থেকে যেমন মনে হয় আমাকে, আমি তা নই, তোমাদের চোখে ধূলা দেই, ভেতরে বড়ো অগোছালো, বড়ো ভাঙাচোরা, বাজে, বড্ড বাজে, অকম্মার ঢেঁকি, অপদার্থ। এইসব মিলে, আরো কতো কিছু, জানি না, বলতে পারবো না, 'এই গৃহ এই সন্ন্যাস' লিখতে প্রাণিত করেছে। সাইফুজ্জামান: আপনি অসংখ্য প্রেমের কবিতা লিখেছেন। আপনার জীবনে নারীর প্রভাব কতটুকু? মহাদেব সাহা: নারীভাগ্য আমার খুব ভালো। সেই কৈশোর থেকেই মেয়েরা আমাকে পছন্দ করে। আমি না, মেয়েরাই আমার প্রেমে পড়েছে। কতো মেয়ের যে ভালোবাসা, কতো মেয়ের যে চিঠি পেয়েছি। লেনাও দিলি্ল থেকে চিঠি লিখতো আমাকে। চিঠিগুলো হারিয়ে ফেলেছি। নারী আমার কাছে চিরচেনা, চির-অচেনা। আমার কবিতায় তারা বার বার এসেছে, সীতা, মন্দিরা, মাধবী... এসব বেশি জানতে চেয়ো না, উস্কানি দিও না, চুপ করো। আমি খুঁজি বৈষ্ণবীকে। আবার মেয়েদেরই আমি সবচেয়ে বেশি ভয়ও পাই; কখন কার প্রেমে পড়ি। আমার প্রেমের কবিতা সন্ন্যাসেরই কবিতা। প্রেমের কবিতা তো বিচ্ছেদেরই কবিতা। অনেকে জড়িয়ে যেতে চায়। আমি সরিয়ে নিই, সরে যাই, কবিতা লিখি। রতনতনু ঘোষ: আপনার কবিতার অনুপ্রেরণা কে? মহাদেব সাহা: মা, নদী, বর্ষা। আমি যখন খুব নিচের ক্লাসে পড়ি বঙ্গবন্ধু তখন এসেছিলেন আমাদের স্কুলে একটি নির্বাচনী সভায়। আমি একটি কবিতা পড়েছিলাম। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, 'তুই একদিন বড় কবি হবি।' সেই থেকে আমি কবি। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমি কবিতা লিখেছি। এর চেয়ে গৌরব জীবনে আর কী আছে? 'কফিন কাহিনী' সমকালে ছাপা হয় সেই ৭৭-এর দিকেই। ফুটনোটে লেখা ছিল : কবি হাসপাতালে শুয়ে কবিতাটি লিখেছেন। আমার যত বড় কবি হওয়ার কথা ছিল তত বড় কবি হতে পারিনি। আমি অফুরন্ত কাব্য উৎসের মধ্যে বড় হয়েছি। ছোটবেলায় বাবার সংগ্রহ থেকে কতো পত্রিকা, কতো বই আমি পড়েছি। কতোকিছুর কাছে যে আমি ঋণী, আমি খুব কৃতজ্ঞচিত্তের মানুষ। সালাম সালেহ উদদীন: কোনো অপূর্ণতা বোধ করেন কি? মহাদেব সাহা: পূর্ণতা কোথায়? প্রশ্নই ওঠে না। মহাজগতের মহাশূন্যতায় আমি ভাসছি। আমি নির্বাসিত। নিঃসঙ্গতা আমার চিরসঙ্গী। এত কোলাহল, জনারণ্যে থেকেও আমি একাকী, নিঃসঙ্গ। সাইফুজ্জামান: আপনারা তিন কবি-বন্ধু নির্মলেন্দু গুণ, আবুল হাসান ও আপনি। আপনাদের বন্ধুত্ব কিংবদন্তীতুল্য। বন্ধুদের সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী। মহাদেব সাহা: হাসানের সঙ্গে আমার স্বভাবগত মিল বেশি। হাসানও নির্জনতাপ্রিয়। ঢাকা শহরের এমন কোনো নির্জন জায়গা নেই যেখানে আমরা যাইনি। ঢাকার এমন কোনো স্টেশন, টার্মিনাল, পার্ক নেই যেখানে আমি আর হাসান যাইনি। 'তুমি ও তার এপিসোড' গল্পটি পড়ছো? পড়ে দেখো। নির্মল যে কোনো অবস্থার মধ্যে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারে। যে কোনো প্রশ্নের উত্তর যেন তৈরি থাকে। নির্মল আড্ডায় সব সময়ই উজ্জ্বল। ওর উইট ও রসিকতাবোধ অসাধারণ। দুইজনেরই রাজনৈতিক আদর্শ ও কাব্যচিন্তার ক্ষেত্র অভিন্ন । আমরা অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও মানুষের কথাই চিন্তা করেছি। বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশ ও বাঙালি আমাদের বিশ্বাস। প্রেমই মানুষের প্রথম বিদ্রোহ, নির্মলের মধ্যেও এক বাউল বাস করে। সালাম সালেহ উদদীন: আপনাদের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব ছিল কখনো? ব্যক্তিগত বা সাহিত্য-ঈর্ষা। মহাদেব সাহা: আমরা প্রচুর তর্ক-বিতর্ক করেছি। কেউ কারো নিন্দা করিনি, গীবত করিনি কখনো। অন্যের কুৎসা নয় আমরা সব সময় নিজেদের টপকাতে চেয়েছি। নিজের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে নিজেকে অতিক্রম করাই ছিল আমাদের কাজ। অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা নয়। কবিতার উপাদান আমরা জীবন থেকে সংগ্রহ করব, বই থেকে নয়। আমার একটি কবিতার নাম 'গোলাপের বংশে জন্ম'। কবিতার জন্য বন্ধুত্বের ক্ষতি হবে কেন? বন্ধুত্ব আরো গাঢ় হয়েছে। আমাদের মতো বন্ধু কজন হয়? আমাদের পরশ্রীকাতরতা ছিল না। পরনিন্দা করতে হবে কেন, নারী প্রেম, রাজনীতি কতো বিষয় আছে কথা বলার। নারীর ভালোবাসা বাদ দিয়ে কেউ পরের নিন্দা বন্দনা করে? আমাদের তিনজনের ভালোবাসা ভাবলে এখনো চোখে জল আসে। আমরা দীর্ঘ পথ একসঙ্গে হেঁটেছি। বন্ধুত্বে চিড় ধরেনি কখনো। রাজনৈতিক সঙ্কটের মুহূর্তে আমরা মিলিত সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি নির্মলের থেকে হয়তো এক বছরের মতো বড়, কিন্তু মাসের হিসাবে নির্মল আমার থেকে বড়ো এক মাসের। রতনতনু ঘোষ: বিচিত্র বিষয় নিয়ে আপনি কবিতা রচনা করেছেন। কাব্যগ্রন্থের নামকরণেও আপনার রয়েছে অসাধারণত্ব। কবিতার উপাদান, লেখার বিষয় কিংবা নামকরণের বিশেষত্ব কীভাবে আপনি আবিষ্কার করেন? মহাদেব সাহা: আমি অল্পতেই আত্মহারা হয়ে যাই, ভালোবাসায়। কেউ ভালো ব্যবহার করলে তাকে আমি আমার সর্বস্ব দিয়ে দিতে পারি। একাকীত্ব ও ব্যর্থতাবোধও আমার মধ্যে কাজ করে। বন্ধুত্ব ও উষ্ণ সাহচর্যের খুব মূল্য দিই আমি। হাইজাকাররা ধরেও আমাকে ছেড়ে দেয়, বুঝলে? ওখানেও আমার ভক্ত আছে। জানো, কী বাজে মানুষ আমি, কতো যে মুদ্রাদোষ, দুই ঘণ্টা ওয়াশরুমে কাটাই। লাভও হয়, হাত ধুতে ধুতে, জল পড়ার শব্দ শুনতে শুনতে মনে মনে লিখেও ফেলি, কতো নাম পেয়ে যাই, কতো শব্দ। জন্ম-মৃত্যুর রহস্য কতো বিক্ষিপ্ত চিন্তা। এক চিন্তা থেকে আরেক চিন্তায় চলে যাই। আধা পাগল বুঝলে, বলা যায় না পাগলও হয়ে যেতে পারি, কিছু ঠিক নেই। আমার মতো একা থাকতে পারবে? দিনের পর দিন, কিচ্ছু না করে, শুধু ভেবে, আর ভেবে। পড়বো কেন, আমি ভাববো, পড়বে প-িতেরা, আমার কী দরকার? ভেবেই আমি সবকিছু চাই শিখতে, পড়ে কতোটুকু শেখা যাবে? বই পড়া বিদ্যা, না আমি এতো বিদ্যা টিদ্যার মধ্যে নেই। জ্ঞানের কথা রাখো, প্রেমের কথা বলো, প্রেমের জল হয়ে যাই গলে। সাইফুজ্জামান : আপনার জীবনে কার গুরুত্ব বেশি? মহাদেব সাহা: নীলার। সে-ই সব। সর্বাঙ্গিনী। তার হাতেই খাই পরি। সে-ই অভিভাবক, কড়া মাস্টার। নীলার অর্ডারে চলি। এক অবাস্তব জীবনযাপন করি আমি। অবসাদ, অবসন্নতা, বিষাদ, ভারসাম্যহীনতাও। সালাম সালেহ উদদীন: এবার নবীন লেখকদের উদ্দেশে কিছু বলুন। মহাদেব সাহা: নবীনরাই সাহিত্য বাঁচিয়ে রাখে। নবীনদের হাতেই সাহিত্যের বহমানতা। বাংলা কবিতা এমন পর্যায়ে পেঁৗছে গেছে যেখানে কারোরই আর খারাপ লেখা সম্ভব নয়। নবীনদের লেখা বেশ ব্যঞ্জনাধর্মী। তারা যথেষ্ট ভালো লিখছে। রতনতনু ঘোষ: কবির থাকে স্বকীয় সত্তা ও স্বতন্ত্র স্বর। একজন কবির কী ধরনের আত্মপ্রস্তুতি ও জীবনযাপন প্রক্রিয়া থাকতে পারে আপনার মতে? মহাদেব সাহা: রিলকে ঠিকই বলেছিলেন, কবিতা হচ্ছে জীবনের শ্রেষ্ঠ অভিজ্ঞতার নির্যাস। আমিও তাই মনে করি। জীবনের মধ্যেই কবিতা। কবিতার মধ্যেই জীবন। জীবন থেকেই কবিতার পাঠ সংগ্রহ করতে হয়। জীবনকে পুড়িয়ে, ক্ষয় করে এই কঠিন কাজে নিজেকে প্রস্তুত করতে হয়। কবিতা হচ্ছে কবির জীবনের অপার সুখ, অপার দুঃখ। দুঃখ, ত্যাগ ও সীমাহীন যন্ত্রণা এড়িয়ে কবি হওয়া যায় না। কবিকে স্বাতন্ত্র্যধর্মী, ব্যতিক্রমী হতে হয়। তাকে আগের লেখা ছাড়িয়ে নতুন ভাবনায় যেতে হয়। নতুন বোধ তৈরিই কবির কাজ। শেষ পর্যন্ত সে একা হয়ে যায়। তার অন্তর্জগতে অংশীদারিত্বের কেউ থাকে না। ব্যক্তিজীবনে সে ছায়ার মতো বেঁচে থাকে। তার জীবনে বাস্তবজীবন থাকে না। নৈঃশব্দের ধ্বনিও তাকে শুনতে হয়। যা দেখা যায় না তাও দেখতে হয়। মূর্তিহীনকে সে মূর্তিময় করে তোলে, শরীরহীনাকে শরীরী করে তোলে। একজন কবিকে প্রতিনিয়ত ক্ষত-বিক্ষত হতে হয়। আর দশজন মানুষ থেকে সে আলাদা। আবার সে দশ জনের একজনও। কবি মানুষের থেকে কম অথবা বেশি। সালাম সালেহ উদদীন: আমাদের সঙ্গে আলাপে অংশ নেয়ায় এবং এতো সব মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ মতামত প্রকাশ করায় আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। মহাদেব সাহা: তোমরা আমাকে এতো কিছু বলতে প্রণোদিত করায় তোমাদেরও ধন্যবাদ জানাচ্ছি। ভালো থেকো। |