কবিতার দিনগুলি রাতগুলি |
শুভেন্দু দেবনাথ দিল্লী, ভারতবর্ষ |
কবিতা সর্ম্পকে বস্তুতঃ আমি
কিছুই জানি না। কোন কোন সকাল আমার বিকেল বলে মনে হয়, আর কোন
কোন বিকেল সকালের মতো। কিন্তু এই মনে হওয়া , কেন যে আমার মধ্যে
ঘটে জানি না। যেভাবে জানি না, কি ভাবে প্রথম আমি লিখে
ফেলেছিলাম কিছু শব্দ। সে শব্দের সমাহার কবিতা হয়েছিল কিনা তাও
জানি না। সমস্ত যৌবন ধরে আমি শুধু একটা ‘না’ এর সাথে দ্বৈরথ
করে চলেছি। একটা ‘না’। ক্রমেই আমার স্মৃতি লুপ্ত হয়ে আসছে।
কয়েক বছর আগেও আমি বহু প্রয়োজনীয় কথা মনে রাখতে পারতাম। এখন
প্রয়োজনের ভার হাল্কা হয়ে আসছে। কেন এমন হচ্ছে বুঝতে পারিনা।
কঠোপনিষদের কথা মাঝে মাঝে মনে হয় – যখন নচিকেতা বিশ্বরহস্য
নাকি ব্রক্ষ্মের স্বরুপ জানতে চাইছেন – তখন যম বলছেন আমার কথা
শ্রবণ কর। হয়তো এর থেকেই কোনও উত্তর বেরিয়ে আসবে।
কবিতা সর্ম্পকে আমার ভাবনা আসলে ‘না’ ভাবনাই। যে নেতি আমাদের
দিয়ে লিখিয়ে নেয় কথা। শব্দের পর শব্দ। এক একটি রুপের আভাস।
শুধু এটুকু বলতে পারি প্লেটোর ‘গণরাজ্যে’র ‘না বাসিন্দা’ কবি
কিন্তু আমাদের দর্শনে অন্যভাবে উত্থাপিত। সেখানে কবি সম্বন্ধে
বলা হচ্ছে -- ‘কবিং পুরাণ মনুশাসিতরম্ অনোরনিয়া’ অর্থাৎ কবি
একজন সত্যদ্রষ্টা। তবে এ তো গেল শাস্ত্রের বাদানুবাদ।
আমি কবিতা সর্ম্পকে কিছুই জানি না। শুধু জানি যখন আমাদের
পুরোনো বাড়িটার ছোট্ট ঘরে অন্ধকার বাক্স-প্যাঁটরার ওপর শীতের
দুপুরের এক চিলতে আলো এসে পড়ে। দু-একটি আরশোলা ফরফর করে উড়ে
যায় রান্নাঘরের দিকে কিংবা একটি টিকটিকি বিনীত চিৎকারে জানিয়ে
দেয় দুপুরের বয়স – তখন আমার ভিতর কীরকম যেন হয়ে যায়। হয়তো বা
ঠিক সেইদিন বহুকালের না পারাগুলি একত্র হয়ে আমাকে দিয়ে লিখিয়ে
নেয় কয়েকটি বাক্য। এর বেশী আমার আর কিছুই বলার নেই কবিতা
বিষয়ে।
মাঝে মাঝে মনে হয় কি লিখছি কেন লিখছি? লেখা গুলো কি আদৌ কবিতা?
বুঝি না। এক এক সময় মনে হয় লিখতে বসে আজ আর লিখব না, নিশব্দ
বসে থাকব, নিশব্দের কি কোন শব্দ হয়? রোজ আমি বসি খাতা কলম নিয়ে
কোন দিন শব্দ এসে ধরা দেয় কোন কোন দিন বা সাদা পাতায় ঝরে পড়ে
একরাশ নিশব্দ।
নিশব্দে থেকো।
আজন্ম বধিরতা নিয়ে।
নিশব্দই এক একটি শব্দ তৈরি করে।...
আবার কখনো কখনো লিখতে বসে শব্দেরা প্রশ্নের আকার নেয়। আমার
যন্ত্রনারা ভীড় করে এসে প্রশ্ন তোলে। এই যে জীবন যন্ত্রনারা
ভীড় করে আসে কলমে
এ যন্ত্রনার মুখ কি আমার আদৌ চেনা?
অন্তঃকরণে অভিমানে
রক্ত ঝর্না গুপ্ত প্রবাহিনী
এ যন্ত্রনার মুখ
আমি চিনি?
যখন মাঝ রাতে সমস্ত পাড়া ঘুমে আচ্ছন্ন ঠিক তখনই আমি এসে বসি
আমার লেখার টেবিলটায়। কোন কোন দিন আমার নিজের জীবন কে লিখতে
ইচ্ছে করে
কোন কোন দিনে ফেলে আসা জীবনের দিকে তাকাই। তখন মনের কার্নিশে
ভীড় করে আসে নানা প্রশ্ন জীবনের পরতে পরতে জড়িয়ে থাকা বিতর্ক।
কখনো উত্তর পাই কখনো বা পাই না। আবার কখনো উত্তর পেলেও মনে হয়
বোধ হয় ঠিক উত্তর পেলাম না তখন আবার ভীড় জমায় সেই একই প্রশ্নরা
আবার আমি নতুন করে শুরু করি উত্তর খোঁজা এভাবেই জমে ওঠে জীবনের
পাওয়া না পাওয়া সব প্রশ্ন উত্তরের খেলা।
কয়েকটি বিতর্ক রইলো। মাঝরাতে সবুজ জড়ানো
লতা ও গুল্মের মতো অন্ধকার। জানি
প্রতিটি প্রশ্নের গ্রাসে আহরিত প্রতিটি অজস্র নিরুত্তর
ক্ষমা করে। ভালোবাসে। পুনর্বার ক্ষুধিতের মতো
প্রসারিত হয়।
এক এক সময় পাগলের প্রলাপের মতো লিখে চলি, লিখেই চলি। কখনো সেই
লেখা শব্দের মধ্যে জন্ম নেয় কবিতা কিংম্বা গল্প বা অন্য কিছু।
আবার কখনো কিছুই লেখা হয় না কিছু অর্থহীন শব্দ ছাড়া। এই যেমন
এখন লিখে চলেছি। কি লিখছি কেনো লিখছি জানি না। কলমের ডগায় ভীড়
করা শব্দদের একের পর এক বসিয়ে যাচ্ছি পর পর। কি এদের ভবিষ্যত
কিংম্বা আদৌ কোন ভবিষ্যত আছে কিনা কে জানে। শুধু মনে হয় নিশুতি
রাতে রোজ আমি সহবাস করি শব্দের শরীরে। আর এক সময় সেই সহবাস
শেষে শব্দের সমস্ত শরীর জুড়ে আমার সমস্ত টেবিল জুড়ে আমার সমস্ত
আত্মা জুড়ে উঠে আসে জন্মানোর গন্ধ।
সমস্ত শরীর থেকে জন্মানোর গন্ধ উঠে আসে
সহবাস
অগুরু মেখেছে কিংম্বা কাঁচা চন্দনের গন্ধ ঊরু ও জঙ্ঘায়
হঠাৎ শরীর থেকে গৈরিক শাড়ির টুকরো চুরি হয়ে যায়
লবঙ্গের কাত্থ মাখে ধমনীরা।
এক এক দিন ভাবি আজ একটা প্রেমের কবিতা লিখব, কিংম্বা একটা
প্রেমের গল্প, কিন্তু লিখব বললেই তো আর লেখা হয়ে ওঠে না। হয়ত
লিখতে বসলাম, কিন্তু মাঝ পথেই কলম অবাধ্য হয়ে ওঠে, বেঁকে বসে
আর লিখবে না, তখন প্রেমের জায়গায় লিখে বসে বিদ্রোহের কবিতা।
অথচ আমি তো বিদ্রোহের কবিতা লিখতে চাই নি। আমার মন মানে না
কিন্তু কলম এগিয়ে চলে তর তর। আমি তাল রাখতে পারিনা, আমার অবশ
মন কলমের বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য হয়। সাদা পাতার উপর আমার কলম
ওগরাতে থাকে অক্ষরের তেজ।
কলমে ঠিকরে পড়ে অক্ষরের তেজ
হীরের টুকরোর মত কঠিন কথার খাঁজে খাঁজে
আকাঁড়া সত্যের মুখ, জ্বালা ধরায়, টুটি চেপে ধরে বলে
কান ধরে ওঠবোস কর দশবার।
হাল ছেড়ে দি। অথচ কি যন্ত্রনা। মিনিট দশেক আগেই আমি লিখতে
চেয়েছিলাম একটা আস্ত প্রেম।আমি বারবার পিছন দিকে তাকাতে চাই
কিন্ত কলমের কাছে আমি নিরুপায়, যেনো ও আমাকে একটা নির্দিষ্ট
লক্ষণরেখা টেনে দিয়েছে।এক চুল ও এদিক ওদিক হবার যো নেই। যেনো
এর বাইরে পা দিলেই আমি হারিয়ে ফেলব আমার সব অস্তিত্ব।বাধ্য
হয়েই তাই ফিরে আসি বারবার বারবার।
পিছনে তাকাই নি আর, ছায়া দেখে ভুল পথে চলে যেতে যেতে
ফের ফিরে আসি লক্ষণরেখার মধ্যে আত্মরক্ষার তাগিদে।
কখন মনে হয় আমি তো প্রেমের কবিতা লিখতে চেয়েছি, কিংম্বা অন্য
কিছু কিন্তু যাই লিখিনা কেনো আমার কলম কেনো বারবার আমাকে টেনে
ধরে অন্য কিছু লেখায়? কেনো কেনো কেনো, তবে কি ওই প্রেম ফুল
পাখি ঈশ্বর এসব কিছু নয় আমার মন আসলে বিদ্রোহের খোঁজ করে। সব
কিছুকে ভেঙ্গে তছনছ করতে চায়। কিন্তু আমি ভয় পাই আর তাই বোধ হয়
আমার বাইরের মুখোশের মতো আমার মনের আয়নায় আমি পরাতে চাই
প্রেমের মুখোশ। আর আমার কলম আমাকে টেনে হিছড়ে দাঁড় করায় সত্যের
মুখোমুখি।
কথাগুলি অক্ষরের ঠিকানা ধরে খুঁজে পায়
টেনে নিয়ে আসে বাইরে
প্রখর রৌদ্রের তেজে মুখ দেখে
নিজেকে দেখায়
সে শুধু অক্ষর নয় ভাঁজে ভাঁজে আকাঁড়া সত্যের মুখ।
এক সময় আমার মনের আর কলমের সব যুদ্ধ থেমে যায়। ভয় পেতে পেতে এক
সময় মরিয়া হয়ে উঠে আমি দাঁড়াই মুখোমুখি সত্যের। নিজেকে চিনতে
পারি। বুঝতে পারি ভয় পেতে পেতে এক সময় সত্যকে আমি অস্বীকার
করেছি, ভুলে থাকতে ছেয়েছি আমার আসল ভাবনা কে আর তাই আমার
অবচেতন মন কলমের সাথে ষড়যন্ত্র করে আমার সমস্ত লেখার টেবিল
জুড়ে বিদ্রোহ করে চলে।
এই অপরাহ্ন বেলায় তাকে দেখে চিন্তে পারি
সে বড় অবুঝ রাখাল
ছায়া পেলে সেও নিদ্রা যায়।
সে কখনো আসবেই ভাবতে ভাবতে বিদ্ধ হয়েছে আমার চরাচর। সে কি ভীষণ
নিষাদ? নাকি তীরন্দাজ? কে সে? যার লক্ষে থেকেছি আমি অবিচল
স্থির। মাছের সূক্ষ্ম চোখে অর্জুন যে প্রতিদিন তারই সম্মানে
খুলে রাখো টুপি, নতজানু হও অরণ্য চূড়ায় – এসব কথা লিখতে গেলে
মোহনা প্রেমিক নদী কে ঈর্ষা করি, সমুদ্রে এত জল তবু নদীকে
খাবেই সে জেনে ও বুঝে মেঘে মেঘে বেলা বাড়ার দিকে তাকাই, সময়ের
হিমবাহ ক্রমশ গলে, ভাবনার সঙ্গে দূরত্ব বাড়ে, পারাপারের
একমাত্র লেভেল ক্রশিং বেশির ভাগ বন্ধ, ফিসফাস শুনি............