কার্তিকের কুয়াশা

পরীর দেশে খোকন
ফিরোজা হারুন

‘খোকন সোনা চাঁদের কণা এক রত্তি ছেলে, আর কিছু ধন চায় না খোকন মায়ের কোলটি পেলে।’ মায়ের কোলে শুয়ে শুয়ে খোকন বায়না ধরে সেই গল্পটি শোনার জন্যে। গল্প না শুনলে তার ঘুম আসে না। চার বছর বয়স হতে চললো খোকনের। ছোট্ট আদুরে চেহারা। দেখলে মায়া হয়। বেশীর ভাগ সময় তার মায়ের সঙ্গেই কাটে। মা তাকে ঘুম পাড়ানো ছড়া শোনান। তারপর বলেন সেই লাল পরীর গল্প।
এক দেশে এক রাজা ছিল। তার ছিল একটি সুন্দর ফুটফুটে মেয়ে। তার বয়সও চার বছর। সে হাসলে মানিক ঝরতো। কাঁদলে চোখের পানির ফোঁটা মুক্তা হয়ে যেত। তার পায়ে ছিল সোনার নূপুর। হাঁটার সময় মিষ্টি শব্দ হত। সেই শব্দে রাজপূরীর সবাই খুশী হত। সেই রাজকন্যার নাম ছিল চম্পা। রাজার বাড়িতে ছিল বিরাট ফুলের বাগান। রাজ্যের যত ফুল ঐ বাগানে ফুটতো। বাগানের জন্য ছিল শত শত মালী। তারা সারাদিন বাগানে কাজ করতো। ফুলের গাছের যত্নই আসল কথা। আগাছা পরিষ্কার করা পনি দেওয়া, সময়মত সার দেওয়া, সব কাজ মালীরা করতো। বাগানে ছিল মার্বেল পাথরে বাঁধানো রাস্তা। এই রাস্তা দিয়ে হেঁটে ঘুরে বেড়ানো যেত সারা বাগানময়। মাঝখানে ছিল একটি ছোট্ট হ্রদ। তারও চারিধার পাথরে বাঁধানো। চতুর্দিকে বসার জায়গা। জোতস্না রাতে বাগানটি অপূর্ব সুন্দর দেখায়।
বাগানে পূর্ণিমা রাতে পরীরা বেড়াতে আসে। লাল পরী, নীল পরী, হলুদ পরী, সাদা পরী তাদের নাম। নাচের পোশাক পরে তারা, গলায় পরে ফুলের মালা। সারা শরীরে মনি মুক্তার গহনা, পায়ে সোনার ঝুমুর। হাতে ফুলের সাজি। পরীরা ফুল খুব ভালবাসে। ফুল যেমন সুন্দর, পরীরা তেমন সুন্দর। তারা নেচে নেচে ফুল তুলে আর সাজি ভরে। তাদের নাচের আওয়াজের তালে তালে চারিদিক হয় মুখরিত। সে শব্দ কিন্তু সবাই শুনতে পায় না। কেবল রাজকন্যা চম্পা আর তার মা-রাণী মা শুনতে পান। তেমনি এক পূর্ণিমা তিথিতে রাজকন্যা বাগানে গেল তার মায়ের সঙ্গে। পরীরা ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে এলো। পরীরা থাকে কুকাফ পাহাড়ে। বিশাল বাগানে এসে ছুটোছুটি শুরু করে দিল তারা। ফুলে ফুলে সাজি সাজি ভরে ফেললো। ফুলের সাজি বাঁধানো শ্বেত শুভ্র চত্বরে রেখে শুরু করলো নাচ। এমন সময় রাজকন্যা চম্পার হলো আগমন। পরীরা চম্পাকে কোলে তুলে নিল। চম্পাকে পেয়ে তারা মহাখুশী। নাচতে শুরু করলো ওকে সাথে করে। চম্পা পরীদের দেশে যেতে চাইলো। পরীরা চম্পার মাকে অনুরোধ করে চম্পাকে নিয়ে যাবার জন্য। রাণীমা বললেন, নিয়ে যাও। আবার দিয়ে যেও। দেরী করো না যেন। পরীরা চম্পাকে উড়িয়ে নিয়ে চলে গেল তাদের দেশে, সেই কুকাফ পাহাড়ে। সে এক সুন্দর দেশ।
সে দেশের সবুজ বনানী, দেখলে নয়ন জুড়িয়ে যায়। রকমারি ফুলের গাছ।
ফুলের অন্ত নেই। ফুলের সুবাসে চারিদিক মৌ মৌ করছে। সবুজ নরম ঘাস। মখমলের মত। অনেক ফলের গাছ। মিষ্টি রসে ভরা সব ফল। পাখি আছে বিচিত্র বর্ণের। তাদের কলকাকলীতে পরীর রাজ্য মুখরিত। পাহাড়ের পাশে বয়ে চলেছে রূপালী নদী। রূপালী নদীতে ভেসে বেড়াচ্ছে সোনালী মাছেরা। পাহাড়ের গায়ে আছে ঝর্ণা। সুন্দরী ঝর্ণার পানি মিষ্টি। পরীরা চম্পাকে সব দেখালো। চম্পা মুগ্ধ হল। পরীরা তাকে অনেক উপহার দিল। হীরা, চুনী, পান্নার হার। সোনার থালা, রূপার গ্লাস। নয়ন ভোলানো পোশাক, প্রচুর ফুল। ঝুরি ভরে দিল অনেক সুমিষ্ট মেওয়া। তারপর লাল পরী, নীল পরী, হলুদ পরীÑসবাই মিলে চম্পাকে কোলে নিয়ে উড়ে চলে এলো রাজবাড়ির বাগানে। পরীরা চম্পাকে অনেক আদর করে বললো, চম্পা তুমি খুব মিষ্টি করে কথা বল। সকলকে ভালবাস। কাউকে দুঃখ দাওনা। বড় হয়েও তুমি যেন একরম ভাল থেকো।
পরদিন সকালে চম্পার ঘুম ভাঙ্গলো। সে তার মায়ের কোলে। সেদিন ছিল তার জন্মদিন। মা বললেন, শুভ জন্মদিন, চম্পামণি! জাগো, চোখ মেলো, চেয়ে দেখো, কি সুন্দর দিন আজ। আজ তোমার জন্মদিন। ছোট্ট রাজকন্যা চোখ মেলে চাইলো। দেখলো তার পালংক উপহারে ভরা। সেইসব উপহার যেগুলো পরীরা তাকে দিয়েছে। তার খুশী আর ধরে না। পালংক ছেড়ে সে নেমে এলো। আনন্দে নাচতে লাগলো। রাজা মহাশয়ও এলেন চম্পার ঘরে, তাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানোর জন্য। রাজা তার প্রিয় কন্যাকে আদর করে কোলে তুলে নিলেন। রাজপুরীতে আনন্দের বান এলো। সেই আনন্দের ধারা দেশের সকলের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেল। রাজকন্যার মনে পড়তে লাগলো পরীদের শেষ কথাগুলো কারও মনে দুঃখ দিও না......।
মায়ের কাছে চম্পার গল্প শুনে শুনে খোকন সোনা কল্পনার পাখা মেলে দিল। সেও রাজকন্যার সঙ্গে পরীদের রাজ্যে ঘুরে বেড়াতে লাগলো। পরীদের সঙ্গে নাচলো, গাইলো, সব কিছু দেখলো। উপহার নিল। লাল পরী, নীল পরীরা চম্পাকে যেসব প্রশংসা করলো সেগুলো তার মনেও গাঁথা হয়ে রইল। সেও বড় হয়ে চম্পার মত সবাইকে ভালবাসবে। কাউকে দুঃখ দিবে না। মায়ের গল্প বলা শেষ হলো। খোকন সোনার চোখের পাতায় ঘুম নেমে এলো। সে তার মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে, বুকে মাথা রেখে, পরম সুখে নিদ্রার কোলে ঢলে পড়লো।
পরদিন খোকন সোনার ঘুম ভাঙ্গলো মায়ের ডাকে। মা বললেন, শুভ জন্মদিন খোকা সোনা। জাগো, চেয়ে দেখ, তোমার জন্য কত উপহার। সত্যি খোকনের বিছানায় ছিল সুন্দর পোশাক, তার পছন্দের লাল-নীল-ঘুড়ি ছড়ার বই, খেলনা। মা আরো বললেন, কালো সাদা চান কপালে ছাগল ছানাটিও আজ থেকে তোমার। বাড়ির সবাই খোকনের ঘরে এলো জন্মদিনের আদর নিয়ে। ছোট ছেলেমেয়েরা খোকনের সঙ্গে আনন্দে মেতে উঠলো। দেখাদেখি ছাগল ছানাটিও তিড়িং-বিড়িং লাফতে লাগলো।


Share on Facebook