কার্তিকের কুয়াশা

সম্পাদকের ডেস্ক থেকে
 
কার্তিকের কুয়াশায় ‘প্রবন্ধ’ নামে গোটা একটি পাতা থাকা সত্ত্বেও ‘মুক্ত গদ্য’ নামে নূতন একটি পাতা সংযোজিত হলো। এ সংযোজন নিছক শ্রেণীভুক্তকরণের বাহুল্যতা নয়, বরং কালের দাবি থেকে উঠে আসা ভাবতেই বেশি ভালো
লাগছে । গদ্যের মুক্তি ? কিসের থেকে এই মুক্তি? পদ্যের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আমাদের প্রায় সবারই জানা, গদ্যের এমনধারা মুক্তির কথা তো এক অর্থে এই প্রথম ।
Vers Libre বা Free Verse বা মুক্ত ছন্দ বিষয়ে অসংখ্য নিবন্ধ আছে বাংলায়ও । তরুণ কবিদের জন্য অপরিহার্য এমন এক গ্রন্থ শঙ্খ ঘোষের “ছন্দের বারান্দা”। মুক্ত ছন্দ কাব্যকলার এমন একটি রূপ যা পূর্বাপর একই রকম ছন্দ:স্পন্দ, অন্তমিল বা লয়ের আদর্শ কোনো রীতি থেকে বিরত থাকে । শঙ্খ ঘোষ তাঁর ছন্দের বারান্দা বইতে লিখেছেন, “ ‘মুক্তি’ কথাটা অবশ্য একটু গোলমেলে। কিসের থেকে মুক্তি? ছন্দ থেকেই? অর্থাৎ পদ্য থেকে গদ্যে পৌঁছনো? বাংলা কবিতা কখনো কখনো সেই মুক্তি চেয়েছে ঠিকই। পদ্যছন্দকে কখনো কখনো আমরা ভেবেছি জীবন-মুখিতার পথে মস্ত বাধা । ভেবেছি যে , কবিতাকে সত্যে এবং ব্যাপ্তিতে পৌঁছে দেবার জন্য খুলে দেওয়া চাই এই বাধা , পদ্যছন্দের ঘর থেকে তাকে এনে দেওয়া চাই একেবারে গদ্যছন্দের পথে । ভেবেছি, এর ই নাম হলো মুক্তি । কিন্তু কেবল এটুকুই নয় । হয়তো আরো এরকম প্রচ্ছন্ন মুক্তি সম্ভব । ছন্দ থেকে নয়; ছন্দের মধ্যেই আছে সেই মুক্তি : ঘর আর পথের মাঝখানে যেন এক খোলা বারান্দা আছে কোথাও। কখনো –বা চলে আসা যায় সেই বারান্দায়, ছন্দের বন্ধনের মধ্যে থেকেই কখনো কখনো ভেঙ্গে দেওয়া যায় তার শুকনো নিয়ম, মিটিয়ে নেওয়া যায় গদ্যপদ্যের পরোক্ষ
বিরোধ । এক হিসেবে, আধুনিক ছন্দের ইতিহাস হলো এই বিরোধমীমাংসারই ইতিহাস।”
তবে মুক্ত গদ্য নিয়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে নিদারুন দ্বিধান্বিত । কিসের এই দ্বিধা? এ প্রশ্নের সরল কোনো উত্তর আমার মনে এখনো ঠিক জন্মে ওঠেনি। এ মুক্তি নিছক সাধু থেকে চলিতে আসার মুক্তি নিশ্চয় নয় । ‘মুক্ত গদ্য’ আমার কাছে যেন এক কিশোরের প্রথম বারের মতো হাতে পাওয়া এক অবৈধ অস্ত্রের মতো এখনো, আত্মরক্ষা নাকি অপরাধ জগতে প্রবেশের জন্য এই অস্ত্র তা যেন ঠিক এখনো নির্ধারিত নয়। এ মুক্তি কাঠামোগত নাকি শুধুই একটি আলাদা বিশেষ বিষয়ের হাতে স্বাধীনতার সনদপত্র সমর্পণ? বিশ্বসাহিত্যে বাংলা সাহিত্যই কি আজ এ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিচ্ছে?
সমালোচনা নয় বরং স্বাগত জানানোই এখানে অভিপ্রায় । বাংলা বানানে কতিপয় অক্ষরের আধুনিক মুক্তিকেও আমরা ইতিপূর্বে সানন্দে স্বাগত
জানিয়েছি । বিবর্তনের ইতিহাস - প্রবর্তন, বিভাজন এবং বহুমুখীতা বা বৈচিত্র্যের ইতিহাস। মুক্ত বানানে বা মুক্ত গদ্যে আমাদের কোনো আপত্তি নেই । তবে যে খেলাটি খেলতে যাচ্ছি তার নিয়ম না জেনে যেমন খেলা যায় না, তেমনি একটি সাধারণ গদ্য রচনাকে কি কারণে মুক্ত গদ্য বলছি তা না জানলে গ্রহণযোগ্যতার জল ঘোলা হবে, রহস্যের কুয়াশা ঘনীভূত হবে, সৃষ্টি থেকে যাবে দৃষ্টিক্ষেত্রের বাইরে। পরিবর্তনের প্রবর্তনকে বিবর্তন পর্যন্ত পৌঁছুতে অভিনব কৌশলটিকে হতেই হবে নিরবচ্ছিন্ন, নিয়ম ভাঙ্গার অনিয়মে নয় বরং সুনির্দিষ্ট নিয়মেই ।


চঞ্চল জামান
টরন্টো, ক্যানাডা, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১১
editor@kartiker-kuasha.nauba-aloke-bangla.com

Share on Facebook