কার্তিকের কুয়াশা

বোধ
হুমায়রা হারুন



রৌদ্র ঝলমল সকাল। আনমনে বাইরে তাকিয়ে আছে শীলা। সূর্য রশ্মির অসীম কৃপায় কিভাবে বেঁচে আছে এ জীবজগত আর এ মানব সভ্যতা, এসব কথা পড়াতে হবে আজকের ক্লাসে। কোয়ান্টাম তত্ত্ব। ফোটন কণিকার রহস্য ভেদ। বিজ্ঞানীরা যে ভাবে অগ্রসর হচ্ছেন তাতে বুঝি আর কোন রহস্যই অজানা থাকবে না। শীলা সেদিন খুব সহজেই ব্যাখ্যা করছিল খুব জটিল একটা জিনিস। প্রকৃতির নিয়মগুলো কিভাবে এত সুনিপুণ ভাবে পরিচালিত হচ্ছে ভেবে নিজের অজান্তেই নিজেকে সমর্পণ করেছিল প্রকৃতির কাছে। এই প্রকৃতিই হল বোধ, যার নিজের রয়েছে নিয়ন্ত্রণ করার অপার ক্ষমতা। যদি ধরে নেয়া যায় বিন্দুসম এক একটি আলোক কণা এক একটি বোধ, যাদের নিজেদেরই ক্ষমতা রয়েছে সিদ্ধান্ত গ্রহণের। ছাত্রদের মাঝ থেকে একটি প্রশ্ন এলো,
- যেমন?
শীলা বলল,
- একটি আলোক বিন্দু বহুদূর পথ পাড়ি দিয়ে এ পৃথিবীতে এসে পড়ছে। সেই সূর্যদেবতার আধারে জন্ম নিয়ে এই পথ পাড়ি দিয়েছে সে স্বীয় ইচ্ছায়। উদ্দেশ্য পৃথিবীতে যাবে। পৃথিবীর বুকে এসে এর তাপ, উষ্ণতা, আলো সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করবে। তাই স্বেচ্ছায় সে বরণ করেছে এই ভ্রমণ। চেষ্টা করবে পৃথিবীতে জীবনের স্পন্দন টিকিয়ে রাখতে। তার বোধ তাকে নিবেদিত করেছে এ লক্ষ্যে। তার এ অনুধাবন শক্তি এতটাই প্রখর যে সে জীবিতকে দান করে প্রাণ আর মৃতকে দান করে জীবন।
আবারো প্রশ্ন,
- সেই জীবন প্রদীপ নিভু নিভু এক দৃষ্টিহীন মানুষের কথা কি বলবেন, যাকে নিয়ে গবেষণার সূত্রপাত?
শীলা আগেও বলেছিল এ কথা তার ক্লাসে। লোকটি বেঁচে আছে তার চোখের অসাড় স্নায়ুগুলো নিয়ে দুই দশক ধরে। শীলা ভেবেছে ফোটন কণাগুলোর কথা। যদি তা হয় অফুরান প্রাণশক্তির আধার, তারাই কি পারে না এই মৃত স্নায়ুগুলোকে আবারো প্রাণবন্ত করে তুলতে? এ ভাবনা থেকেই যাত্রা শুরু ওর গবেষণার। প্রতিদিনই ঘন্টা দু’য়েক করে আলোক তরঙ্গ প্রবাহিত করে চোখের স্নায়ুগুলো পুনুরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে ও। কারণ আলোক তরঙ্গ বহন করছে একটি নয়, দু’টি নয়, অজস্র আলোক কণিকা। তারা প্রত্যেকেই স্বতন্ত্র বোধে বলীয়ান। তারাই পারবে প্রাণহীন স্নায়ুকোষগুলো সজীব করে তুলতে।
এই ব্যাখ্যায় তার লেকচার হয়ে উঠেছিল আরো বিস্ময়ের। ছাত্রদের মাঝ থেকে একটি প্রশ্ন ছিল বেশ ভাল।
- ফোটন কণিকার, সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা বর্জন করে, নির্দিষ্ট পথ পরিভ্রমণের ক্ষমতা যদি থেকেই থাকে তাহলে আমরা এই আস্ত বড় বড় মানুষগুলো সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছি কেন?

ল্যাবে সবচেয়ে সপ্রতিভ সহকর্মীর নাম জিসান। চিন্তাগুলো তার খুব ধারালো। আজ তার প্রশ্নটা ছিল বড্ড অদ্ভুত। প্রশ্নের সাথে তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মনে করিয়ে দেয় সে যেন সবকিছুই আগেভাগে জানে। গত মাসের রিসার্চের ফলাফল সম্বন্ধে ক্লাস লেকচারে সে এ নিয়ে অনেক কথা বলেছে। আজও জানতে চেয়েছে সেই অন্ধ লোকটির কথা। উত্তর দিতে গিয়ে শীলার শুধু মনে হয়েছে জিসান যেন এ রিসার্চের ফলাফলে অনেকটা আশাবাদী। জিসানের প্রশ্ন করার ভঙ্গী যেন উত্তরের প্রত্যাশায় নয় বরং ওকে যাচাই করার আশায়। মাঝে মাঝে ওর মনে হয় জিসান বুঝি মানুষ বেশধারী অন্য কোন জগত থেকে আসা আগুন্তুক, যারা কিনা সে জগতে অনেক বেশী প্রগতিশীল সভ্যতার ধারক। জিসান এ জগতে এ সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে তার সহকর্মী, তার গাইড। কিন্তু অন্য কোন জগতে হয়তো বা তার শিক্ষক। অন্তত জিসানের বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান দেখে শীলার অবচেতন মনে এটাই দৃঢ় বিশ্বাস হয়ে গেঁথে গেছে।


এখন গ্রীষ্মের ছুটি এসে পড়েছে প্রায় দুই মাসের। এই সময়টুকু শুধুই ল্যাবের কাজটুকু সেরে নিতে পারবে। এই সময়ে ক্লাসের তাড়া নেই। নিজের জন্য যথেষ্ট সময় নিয়েই বাসা থেকে বেরুলো। গাড়ির দরজার কাছে এসে চাবিটা বের করতেই মনে হল চাবিটা তো আনা হয়নি। আসলে আজ সকালে হাতের ধাক্কায় চাবিটা টেবিলের ওপর থেকে নীচে পড়ে গিয়েছিল। আলসেমি করে তখন আর তুলে রাখা হয়নি। আবার তাই ফিরে এলো ঘরে। চাবি, মানিব্যাগ, কয়েন আর টুকটাক কাগজপত্রগুলো অফিস হতে এসে টেবিলের প্রান্তে রাখে। ঘর ঢুকে দেখল সব কিছু ঠিকঠাক আছে, জায়গা মতো, এমনকি পড়ে যাওয়া চাবিটাও হয়তোবা টেবিলের তলায়। কিন্তু নাহ্‌, নেই তো ওখানে। পায়ের ধাক্কায় পাশের সোফার নীচে চলে গেল নাকি? কিন্তু তাও তো না। শীলা বুঝে উঠতে পারেনা মাঝে মাঝে কিভাবে তার সামনে থেকে জিনিসগুলো উধাও হয়ে যায়। ওকি ভুলোমন হয়ে যাচ্ছে আজকাল? নাকি বিশ্বাস করে নেবে চাবিটা অন্য কোন ডাইমেনশানে স্থানান্তরিত হয়ে গেছে। ফেরত না আসা পর্যন্ত তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। এসব আজগুবি চিন্তা মাথায় নিয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকা তো সম্ভব নয়। অফিসে যেতে হবে। তারপর ল্যাব ওয়ার্ক। আর সময় নেই হাতে। ঝটপট একটা ট্যাক্সি ডেকে অফিসে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল।


অন্ধ রোগীটি জন্ম থেকে অন্ধ নয়। সময়ের সাথে সাথে অন্ধত্বকে বরণ করে নিতে হয়েছে। নিয়তি। কিন্তু কদিন ধরে খেয়াল করছে ওর দৃষ্টির কিছুটা পরিবর্তন। কেউ সামনে দাঁড়ালে সে দেখতে পায় আবছা ছায়া। ডাক্তার, নার্সরা এতেই খুশী। তার স্নায়ুতে প্রেরিত আলোর কণাগুলো যেন এক একটা সৈনিক। আসাড় কোষগুলোকে উজ্জীবিত করার চেষ্টায় তারা সংগ্রামরত। সফল হতে পারলে এ চিকিতসা যুগান্তকারী সাফল্য আনবে চিকিতসা বিজ্ঞানে। এসব ভাবতে ভাবতে শীলা করিডোরে মুখোমুখি হল জিসানের।
-কিভাবে এলে? জিসানের প্রশ্ন। যেন জেনেই বলছে আজ ওর চাবিটা খোয়া গেছে।
বেশ অবাক হয়েই শীলা বলল, গাড়িতে তো নয়, বাসে।
জিসানের দ্বিতীয় প্রশ্ন, চাবিটা কি হারিয়ে গেছে?
শীলা এবার হেসেই ফেললো। বললো, তুমি জানলে কিভাবে?
জিসান এবার বেশ স্থির গলায় বললো, তোমার রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবে।
-তাই ভাব?
-না ভাবি না। এটাই নিয়ম।
-নিয়ম মানে?
-সব কিছুরই বোধ আছে এ জগতে। কম হোক আর বেশী হোক। এই বোধগুলো সকলেই তাদের নিয়ম পালন করতে চায়, দায়িত্ব সম্পূর্ণ করতে চায়। ব্যাতিক্রম শুধু তোমাদের গ্রহের মানুষগুলো।
এবার শীলার ধাক্কা খাবার জোগাড়।
-আমাদের গ্রহ মানে? এ গ্রহ কি তোমার নয় জিসান?
জিসান আর কোন কথা বললো না। আজ একটি বিশেষ দিন। আজ জিসান চলে যাবে অন্য কোথাও। এই স্পেইস-টাইম থেকে অন্য কোথাও। শীলাকে জানাবে না তা। ওর যে বড্ড মন খারাপ হবে। শীলার কাজ দেখার জন্যই জিসান এসেছিল এই স্পেইস-টাইমে । পৌছে দিয়েছিল একটি কি-ওয়ার্ড ওর মনোজগতে।
বোধ। যা থেকে পরবর্তীতে শীলার এ গবেষণার শুরু। এই শুরু একদিন এ গ্রহের মানুষদের অমরত্ব দান করবে। জিসানের দায়িত্বটুকু তাই আজ শেষ। এখনই ওর যাবার সময়, এখান হতে অনেক দূরে।


সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত প্রায়। ল্যাব থেকে বেরিয়ে বাড়ি অভিমুখে রওনা দিল শীলা । বেশ ক্লান্ত সারাদিনের পর। ঘরে এসে আলো জ্বালালো। প্রথমেই চোখে পড়লো গাড়ির চাবিটা। কেউ যেন সযত্নে রেখে গেছে টেবিলের ওপরে। হঠাতই ফোন বেজে উঠলো। এত রাতে! আলসেমি লাগছে খুব, তাই ফোনটা ধরলো না। মেসেজ মেশিনে চলে গেছে ইনকামিং কল। জিসানের কন্ঠস্বর।
-ভাল থেকো শীলা। চাবিটা খুঁজে পেয়েছ এতক্ষণে? কাল আর ঝামেলা হবে না ল্যাবে আসতে। আমি যদিও কাল হতে ল্যাবে আর আসবোনা। আমার যে যেতে হবে এবার। লং ট্যুরে।

মন্ট্রিয়ল
০৪.০৪.০৯

Share on Facebook