কার্তিকের কুয়াশা

ছোটগল্প

ছোটগল্প সাহিত্যের একটি শাখা (literary genre) সাধারণত কল্পকাহিনীর বর্ণনামূলক গদ্য (fictional narrative prose) এবং উপন্যাসের (novel) তুলনায় অধিকতর সংক্ষিপ্ত এবং লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট। প্রথম ও শেষ অনুচ্ছেদে এই লক্ষ্যটির সুস্পষ্ট প্রকাশই একটি ছোটগল্পকে একাধিক পাঠের আয়ু দিতে পারে। প্রথম অনুচ্ছেদে বললাম কি বলতে চাই, গল্পের শরীরে সে অভিপ্রায় বর্ণিত হলো আর পরিশেষে কি বললাম তা সংক্ষেপে বলেই গল্প বলা শেষ করলাম।

-পাঠক পরিষদ


সূর্যালোকে অন্ধকারের পদধ্বনি
-লীমা জামান শিল্পী
সিলেট, বাংলাদেশ

ইচ্ছে ছিল ছবির মতো বাড়ী না হোক অন্তত একটা ঘর হবে নিজের। কতো কি অসম্ভব ইচ্ছেই না ছিল। ভাবতে ভাবতে মুখে জলের ঝাপটা দিতে চোখে পড়লো বাথরুমের ছোট আয়নায় প্রতিবিম্বটিও যে আঁকা ছবির চেয়ে কম নয় সে কথা নিজে স্বীকার না করলেও অনেকের সুদৃঢ় চোখে তা ধরা পড়ে। ওর সাহসী পদচারণা ওর সৌন্দর্য ঠিক যেন ‘হঠাৎ’ এর মত বিস্ময় জাগায়, আলোকিত করে চারদিক শবনম। জেরিন শবনম শুধু নারী মাত্র নয় সে একজন ভিন্ন নারী। একজন আলাদা মানুষ সকল স্নিগ্ধতা তার শরীর ছাপিয়ে আরো কোথায় যেন গড়িয়ে যায়। কোথায়? হয়তো কেউ ভাবে। হাস্যময় প্রানবন্ত এই নারী কালো রাতে একা জেগে কবিতা রচনা করে চোখের জল আর দীর্ঘশ্বাসের মিশ্র কালিতে।
ভালো থেকো সোনা মাণিক
ভালো থেকো সুখের কান্না
ভালো থেকো হিরেখন্ড
ভালো থেকো চুনী পান্না !
আট মাসের বুবুনকে নিয়ে সোনার শেকল ছিঁড়ে অর্গল ভেঙ্গে আর্কিটেক্ট ফাইয়াজ ফারহান এর ঘর ছেড়ে পথে নেমেছিল শবনম।
বহুদিন ধরে শবনম কিছু লিখতে পারছে না। একটা শব্দ ও মাথা থেকে বের হচ্ছে না। একটা কথা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। বুবুনের ভবিষ্যৎ ঘন্টার পর ঘন্টা আওড়াচ্ছে নক্ষত্র মানে তারা পাঞ্জা, মানে করতল। বুবুন বলতো পাঞ্জা মানে কি? ও উত্তর দিতে পারে না। ভয় পাওয়া চোখে থাকিয়ে থাকে। পড়ার টেবিলে কতরকম ছবি একেঁছে বইয়ের পাতায় টেবিল ক্লথে নিজ হাতে। কি পড়ে মাথায় ঢোকে না। পড়ার সময় দু হাতে ছবি এঁকে চলে। মাঝে মাঝে নিজেকে ধরে রাখা কঠিন হয় ধৈর্য শব্দটি মনে পড়। বুবুন কেক পছন্দ করে না। পুডিং বানায় শবনম, এগারোটা চল্লিশ। বুবুন টিভি দেখছে। লাফাতে লাফাতে এক বার এসে মাকে দেখে গেল।
মা মনি এতোকিছু রান্না করছো কেন? তোর জন্য রান্না করছি। যা, তোর ইচ্ছে মতো জামা কাপড় পড় ছবি তুলবো। ফোন বাজছে। বুবুন ফোন ধরল ঘড়িতে বারোটা দুই।
: হ্যালো আমি বুবুন বলছি
: হ্যাপি বার্থডে। হ্যাপি বার্থডে ডিয়ার বুবুন
বুবুন অবাক হয়ে ধন্যবাদ দিতে ভুলে যায়। বুঝতে পারে আজ তার জন্ম দিন তাইতো মা মনি এতোকিছু রাঁধছে। সে দ্রুত জিজ্ঞেস করে আপনি কে বলছেন?
: আমি ফাদার মাইকেল এরিক বলছি। তুমি কি আমাকে চিনতে পেরেছো বায়েজিদ?
: ফাদার মাইকেল মামনির কাছ থেকে গল্প শুনেছি। আপনাকে কখনো দেখিনি।
: দু’বছর আগেও তুমি আমাকে দেখেছো বন্ধুকে ভুলে গেছো? অবশ্য তুমি তখন আরো ছোট ছিলে তাই মনে নেই, তুমি আমাকে তুমি করে বলতে।
: মা মনি আমার বেস্টফ্রেন্ড।
: আর আমি তোমার ভালো বন্ধু মা কোথায়?
: মামনি ফাদার ফাদার!
: হ্যালো
: হায় মারিয়া!
: ও মাইকেল কবে ফিরলে, কেমন আছো?
: পুরো দশদিন আগে এত ব্যস্ত ফোন করতে পারিনি।
: আশ্চর্য বুবুনের জন্মদিন মনে আছে তোমার। কতোদিন পর তোমার গলা শুনলাম ভীষন ভালো লাগছে।
: তোমার বায়েজিদ বোস্তামী এখন ভীষন দুষ্টু হয়েছে, এই কাল তোমার সময় হবে? কবে সাধুর চরণধুলি পড়বে আমার গায়।
: তুমিও কিন্তু একটু দুষ্টু হয়েছ।
: খুব যন্ত্রণার মধ্যে দিন কাটছিল মনে হতো চোখ অন্ধ হয়ে গেছে কোন দিন আলো দেখবে না। অথচ তুমি এসেছো সব অন্ধকার মুছে গেছে। আলো আমার আলো ওগো আলোয় ভুবন ভরা আলো নয়ন ধোয়া আমার আলো হৃদয় হরা।
: কাল কেন এক সপ্তাহ কাজ আর কাজ সময় বের করে বল দেবো রাখছি। গডব্লেস ইউ ডিয়ার?
: মাই চাইল্ড বলবেন না?
: তুমি পারোও
: এই শোন কি কিনবো তোমার জন্য? শপিংয়ে যাবো সকালে।
: ফতুয়া আর কিসের মালা যেন পরাবে বলছিলে?
: রুদ্র্রাক্ষের মালা? না না ওটা আর দেবোনা বলে ঠিক করেছি। রাখছি বাই।
সময় কত দ্রুত যায় বুবুন আট বছরে পা দিল শবনমের মনে পড়ে মাইকেলের সাথে পরিচয়ের প্রথম দিন ২৬ ডিসেম্বর বিকেল বেলা, বেল বাজতেই দরজা খুলে দেখে অচেনা এক যুবক হাসি মুখে হ্যান্ডশেক করার ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে ইংরেজীতে বললো,
: আপনি নিশ্চয় শবনম?
শবনম একটু বিব্রত বোধ করলো হ্যান্ডশেক করতে।
: আমি একজন ধর্মযাজক গতকাল পত্রিকায় একটা ভিন্ন ধর্মী ছবি দেখলাম। খুব বিস্মিত হয়েছি।
: কিসের ছবি? আমি কিছু বঝতে পারছি না।
লোকটি পত্রিকা বের করে ছবি দেখালো যিশুর কাঁধে হাত রেখে শবনম মিটিমিটি হাসছে। অভিভূত শবনম।
: এই কাজ কোন পাগল করেছে?
: জ্বি সেই পাগল আপনার ঠিকানা দিলো
: আসেন ভিতরে আসেন প্লীজ বসেন
: জেনেছি আপনি কবি, আমি অবশ্য কবিতা বুঝিনা
: ক্ষমা করবেন আমি ইংরেজী বুঝিনা আপনি বাংলায় বলেন আর আমি কবি নই লিখলই কবিতা হয় নাকি।
: দু:খিত শুভ জনমদিন।
: ওটাতো গতকাল ছিল।
: ঈসা নবীর জন্মক্ষনে আল্লাহ আপনাকে পাঠিয়েছেন অভিনন্দন আপনাকে। আপনার জীবনটা ভীষণ কষ্টের, বিনিময়ে আল্লাহ আপনাকে শ্রেষ্ঠ উপহার দান করবেন।
শবনমের ভীষণ হাসি পেলো সে অনেক জোরে হেসে ফেললো। হাসি তোড় সামলে বললো
: আমি মৃত্যুর পর বেহেস্ত চাই না আর আমার জীবনে কোন কষ্ট নেই।
আবার হাসতে শুরু করলো শবনম।
: আপনি হাসলে আপনার চোখ কাঁদে কেন?
: হ্যাঁ। আমি এতে একটা সুবিধা আছে আমি যদি কখনো কাঁদি বুবুন টের পায় না, আমি হাসি ও মনে করে আমি আসলেই হাসছি।
: বুবুনটা বুঝি আপনার ছেলে?
: হ্যাঁ ঘুমাচ্ছে এক্ষুনি উঠে যাবে।
: আপনি কি করছেন?
: আমি একটা কলেজে পড়াই
: কোন সাবজেক্ট সাহিত্য?
: নাহ্ সমাজ কল্যাণ। আপনি কোথায় থাকেন?
মাইকেল ওর ঠিকানা এবং চমৎকার একটি মূর্তি দিয়ে চলে গেল। মূর্তিটি মাদার মেরী ও যীশুর। ওকে বলা হলোনা নদীর কূলের মাটি এনে মেরীর একটা মূর্তি বানিয়েছিল। মা ও শিশুর এই সুন্দর মূর্তিটি কেউ একজন ছুঁড়ে ফেলেছিল। ভেঙ্গে খানখান। সন্তানের মৃত্যুর মত বেদনা বেজেছিল বুকে। যত্ন করে মাটির টুকরোগুলো সিমেন্ট দিয়ে জুড়ে দিয়েছিল শবনম। তারপর সেটা অন্যরকম এক শিল্পে পরিণত হলো। রাতে মাই গুড গড শিরোনামে একটা কবিতা লিখে ফেললো শবনম। খুব হাসি পেল তার ইংরেজী কবিতা এই কবিতা কি মাইকেল তাকে দিয়ে লিখিয়ে নিলো? শবনম আজ নষ্টালজিয়ায় ভাসছে। মাইকেলের সাথে সেই দিনগুলো। প্রথম দিন চলে যাবার সপ্তাহ খানেক পর মাইকেল ফোন করলো
: গুড মর্নিং।
: হ্যালো কে?
: শবনম বলছেন?
: জ্বি বলছি কে?
: ফাদার মাইকেল এরিক এন্ডারসন। চিনতে পারছেন?
: জ্বি চিনেছি।
ওর হাসির শব্দে যেন কান ফেটে গেল
: আপনি রিয়েলি শার্প। আসবেন একদিন আমাদের চার্চে।
: নিশ্চয়ই আসবো। কবে আসবো?
: আজই আসতে পারেন অথবা কাল পরশু।
ছোট বেলা থেকে যিশু সংক্রান্ত সবকিছুতে তার আগ্রহ একটু বেশী ছিল। স্কুল ফাইনালের পর সে একটা চেইন পরতে শুরু করলো ক্রুশচির লকেট। অনেকে অবাক হতো। একদিন মা কঠিন হাতে চেনসহ লকেট ছিড়ে নিলো। তারপর থেকে শবনম কোনদিন গলায় চেন পড়েনি। কাগজে সই করে যেদিন ফারহানের ‘কাগজের বৌ’ হয়ে গেল সেদিন সবাই মিলে গলায় কতোরকম গয়না পরিয়েছিল। সেই দিন ভোর রাতে শবনম গলা থেকে সব খুলেফেলে গান গেয়েছিল ‘এই মণিহার আমায় নাহি সাজে এরে পরতে গেলে বাজে, এরে ছিঁড়তে গেলে লাগে---------।’
শবনম কখনো চার্চে ঢোকেনি। সে আজই যাবে। মাইকেল এমন ভাবে বুবুনকে কোলে নিল যেন বহুদিনের চেনা। মুগ্ধ শবনম। কতলোক আসছে। মাইকেল হাসিমুখে সবার সাথে হ্যান্ডশেক করছে। ঠিক যেন ইংরেজ। নারী পুরুষ কেউ কেউ ওর হাতে চুমু খাচ্ছে কি ভক্তি। কিছু পরে শবনম-কে চার্চের ভেতরে নিয়ে গেল দেয়ালে অসংখ্য পেনটিং মাইকেল ধারাবাহিক ভাবে ছবির ইতিহাস বলে গেল।
: জানেন তো ঈসা নবী মানুষকে পড়তে পারতেন?
শবনম মনেমনে বললো ‘তুমি কি আমাকে পড়াতে পারছো’? আমি আজ ভীষণ ক্লান্ত তবু তোমার কাছে এসেছি তোমার হাসি দেখবো বলে। কি অদ্ভুত কি পবিত্র হাসি। স্বচ্ছ গভীর দৃষ্টি নিষ্কাম নিস্কলুষ। উহ এতো হাসি কি করে হাসে। মহাপুরুষরা কি কখনো বিষন্নতায় ডোবেনা? এই মানুষটা কতো সহজে নিজের জীবনটা উৎসর্গ করেছে মানুষের সেবায়। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার পর শবনম এক বার ঘর থেকে বেরিয়েছিল নান হবে বলে।
: জানেন আমি খুব চেয়েছিলাম আমার মেয়ে হলে নাম রাখবো তেরেসা।
: উয়াও টেরিজা? ওকে আপনি পছন্দ করেন?
: হ্যাঁ ওর একটা কথা আমি ডাইরীতে লিখে রেখেছি। কথাটি কি?
: ‘তুমি যখন প্রার্থনা করবে
তখন বিশ্বাস করবে
যখন বিশ্বাস করবে তখন ভালো বাসবে
যদি ভালোবাস তবে সেবাও দান করবে।’

শবনম শুধু অবাক হয় ফাদাররা যে চিরকুমার থাকে জানতো না। মাইকেল কতো দেশে ঘোরে, মৃতকে দাফন করে, নামাজ পড়ায় কতো নারী পুরুষকে বিয়ে বন্ধনে বেঁধে দেয়। তাইতো ওর কোন বন্ধন থাকতে নেই।
প্রায়ই শবনম চার্চে যায় অনেক ব্যস্ততা উপেক্ষা করে মাইকেল দূরের গ্রামে ওদের বেড়াতে নিয়ে যায়। বুবুনের সাথে খেলতে খেলতে হঠাৎ শবনমের চোখে তাকায় মধুর হাসে। শবনম তর্ক করে ‘আত্মা সসীম তাই অসীম। পরমাত্মার সাথে তার মিলন সম্ভব নয়। তোমার চিন্তায় ছোট্ট একটু ভুল আছে মাইকেল!’ মাইকেল কিছু বলতে যায়। শবনম রেগে যায় । মাইকেলের ভুবন কাঁপানো হাসিতে শবনম বার বার মোহিত হয়। সবরাগ মিলিয়ে যায় এভাবে ওরা খুব কাছের মানুষ হয়ে যায়। শবনম এই কাছের মানুষকে একটু দূরে রেখে অনেক কাল বাঁচতে চায়। এই কাছের মানুষকে কখনো ছোঁবেনা সে। কাছের মানুষটা থাকবে স্পর্শের বাইরে। সে কখনো মাইকেলের ব্রত নষ্ট হতে দেবে না। ওর সন্ন্যাস জীবনের শান্তিটুকু সে নিজের মধ্যে লালন করবে।
দুই বছরের জন্য মাইকেল মিশনে গেল। শেষ দেখা হয়েছিল ২০০৫ এ। হঠাৎ ফোন এলো
: গুড মর্নিং।
: এই এতো সকালে কি ব্যাপার?
: হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন!
: ও আজকে ১৪ তারিখ?
: নীচে নেমে এসো ।
: মানে কি ?
: আমি তোমার বাসার সামনে
: কি বলছো।
একদম ফান করবে না।
: তুমি কি শাড়ী পড়ে আসবে? সত্যি তুমি এসেছো?
: শাড়ী পড়তে কত মিনিট লাগে।
: উহ্ না শাড়ীটাড়ি বাদ দাও।
: বায়েজিদ বেটাকে আগেই পাঠিয়ে দাও।
সাদা একটা শেলোয়ার কামিজ পড়ে শবনম সিড়ি ধরে নামলো। মাইকেল গাড়ী নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
: কি ব্যাপার বৈরাগী বেশ? শবনম গাড়ীতে উঠে গাইলো, ‘যারে ঘর দিলা সংসার দিলারে তারে বেরাগী মন কেন দিলারে’ বিখ্যাত সেই হাসি হাসলো মাইকেল। হাসতে হাসতে বললো
: আমি কখনো কোন মেয়েকে এতো কাছে টানিনি তুমিই প্রথম।
: দ্বিতীয় তৃতীয় শেষ কারা?
মাইকেল ইংরেজীতে কি যেন বললো। শবনম ওর আনা ফুলের ষ্টিক দিয়ে ওর গালে আঘাত করে বললো
: এই ইংরেজ বাংলা বল।
: ভ্যালেন্টাইন ডে সম্পর্কে তুমি কি জানো?
: কিছুই জানিনা ইতিহাসটা কি?
সুন্দর একটা জায়গায় গাড়ী থামলো
: কই বললে না?।
: জানলে তো বলবো।
: তুমি জানো।
: আমি হয়তো ভুল জানি।
: ভুলটাই শুনবো।
: আমি তো জানি স্কুল গোইং ছেলেমেয়েরা একজন অন্যজনকে ফুল দেয়, কার্ড দেয়, চাইনিজ খায় আরো শুনবে?
: ভ্যালেন্টাইন নামে একজন লোক ভালবাসা প্রতিষ্ঠার জন্য এই দিনে জীবন দিয়েছিল এবং সে ছিল একজন ধর্মযাজক।
শবনম মুগ্ধ হয় কষ্ট পায়। অনেক্ষণ মাইকেল চুপ করে আছে।
: মাইকেল তোমার সুন্দর লকেটটা আমাকে দেবে?
: এটা তো দেয়া যাবে না। এটা একটা সিম্বল শুধু পুরোহিতদের জন্য।
: তুমি যখন বিশপ হবে তখন কি সিম্বলটা চেঞ্জ হয়ে যাবে?
: তুমি কেন অর্নামেন্টস পড়োনা?
: তুমি দাও না তাই পড়িনা।
: আমার মায়ের গয়না তুমি নিবে?
: পাগল? গয়না টয়না শৃংঙ্খলের মতো মনে হয়। হাতে পায়ে বেড়ী পরে নিজেকে মেয়ে ভাবতে ভাল্লাগে না। বুবুন ফাদারের খুব ভক্ত মাছ, ডাল, ভাত, ওদের দুজনের খুব পছন্দের খাবার। বুবুন কাটা চামচ দিয়ে খাওয়া প্র্যাকটিস করছে। অন্ধকার নেমে আসছে। শবনম চিৎকার করে ডাকে। বুবুনকে কাঁধে করে মাইকেল ছুটে আসে গাড়ীতে দুজনেই চুপ। বুবুন ঘুমিয়ে পড়েছে ওকে কোলে নিয়ে মাইকেল একহাতে তালা খুললো, বুবুনকে বিছানায় শুইয়ে দিলো। চলে যাবার সময় কাছে এসে শবনমের মাথায় হাত দিয়ে আশির্বাদ করে শবনম মোমের মতো গলতে থাকে। ওর কান্না পায় জোর করে হাসি টেনে থ্যাংকস বলে বিদায় দেয়। করিডোরে দাঁড়িয়ে শবনম হাত নাড়ে, মনে মনে বলে মাইকেল তুমি আমার জীবনে এক টুকরো আলো, আলোর তো কোন ছায়া পড়েনা তবু তোমার ছায়াহীন একটি ছায়া আমাকে সারাক্ষণ তাড়া করে।
দু’বছর পর মাইকেল কে দেখলো শবনম ওরা আবর আগর মতো বাতাস ডানা মললো শবনম দ বছর ক করে পা করেছে ভাবে মাইকেলের দেয়া ভজন শুনত শুনতে কোথায় যেন হারিয়ে যেত ‘ঈশ্বর নাম মধু নাম বলো ঈশ্বর নাম।’ চোখের জল ঈশ্বর যিশু মাইকেল সব মিলে মিশে একাকার হয়ে যেত।
আজ শবনমের শরীরটা ভালো নেই। সন্ধ্যা হয়ে এলো, কি করছে মাইকেল, নামাজ পড়ছে, তাই ফোনটা বন্ধ, বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছে না। জ্বর জ্বর লাগছে শুয়ে শুয়ে দুর্বল গলায় গাইলো ‘নামাজ পড় হে নামাজী আমার ঘরে আজ তোমার তরে বিছিয়ে দিলাম হৃদয় জায়নামাজ........’ গলা বন্ধ হয়ে আসছে চোখে এত জল কোত্থেকে যে আসে। অস্ফুট স্বরে বলে, ‘তুমি জানোনা মাইকেল তোমাকে ছাড়া কিভাবে বেঁচে আছি। ও ঈশ্বর আমাকে শক্তি দাও।’
মুঠো ফোন বেজে উঠলো। ডাঃ তানভির আহমেদ তনু। একজন শরীর বাদী মানুষ। যে বোঝে মানুষের শরীরের স্বভাব। বোঝে অস্থিমজ্জা কোষ। রক্ত, রক্তের ভেতরকার রসায়ন।
চিরচেনা সুন্দর বন্ধুটি এখন শবনমের কাছে খুব অচেনা লাগে। কেন যে মানুষ বদলে যায়। মেজো খালার ছেলে তনু ওর আট মাসের ছোট। সবনম যখন ঢাকায় খালার বাসায় বেড়াতে আসতো তখন খুব মজা হতো। দুজনই ক্লাস সিক্স এ পড়ে। একদিন দুপুরে বাসায় সবাই ঘুমিয়ে আছে শবনম তনুর ঘরে ঢুকে দেখে ও অংক করছে। শবনম বুঝতে পারে না তনু প্রতি ক্লাসে ফার্স্ট হতে চায় কেন। এও ভেবে পায়না এই অংক জিনিসটা জীবনের কি কাজে লাগে।
: এই গাধা অংক শেষ হয়েছে?
: আয় আয় উপরে দাদুর ঘরে যাবি?
: নাহ্ তোর দাদুকে দেখলে আমার পা কাঁপে। উনি আমাকে দেখলেই ট্রান্সলেশন ধরে।
: তাহলে আমার খাতায় লেখাশেখা।
শবনম খাতায় লিখল ‘বড় যদি হতে চাও ছোট হও তবে’ এই লাইনটি বার বার লিখবি। সুন্দর হাতের লেখা দিয়ে কি হবে? আমিতো তোর মতো ভাল ছাত্র না। আমি তো অংকে গোল্লা পাবো।
: তুই কতো সুন্দর করে গল্প পড়ে শোনাস। নাচতে পারিস, নাচলে তোকে একদম পরীর মতো লাগে। শবনম বললো
: নাচ দেখবি? ছন্দেছন্দে দুলি আনন্দে আমি বনফুল গো।
শীতের দুপুরে একই লেপের তলায় পা ঢুকিয়ে শবনম রূপকথার গল্প পড়তো আর তনু হা করে গিলতো। তনুকে পাঁচ বছরের শিশু মনে হতো। কেমন গাপ্পুস! সেই তনুটা এখন একেবারে অন্য মানুষ। ফোন আবার বাজালো
: হ্যালো
: কিরে ব্যস্ত?
: না কি বলবি বল।
: কি করছিস?
: শুয়ে আছি।
: শরীর খারাপ?
: না, তনু তোর বোধয় বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ মনোবিদ্যার অধ্যায়ে বিচরণ নেই তাই না?
: প্লেটোনিক লাভ? তোর প্লেটো কি ঐ থিত্তরী বিশ্বাস করতো?
: হাসবিনা শুনতে কুৎসিত লগছে।
: বুদ্ধ দেবের সবিনয় নিবেদন পড়েছিস?
: ওটা একটা বাজে গল্প, অবাস্তব।
: বাজে কেন?
: অন্য কথা থাকলে বল।
: কি পড়ে আছিস, শাড়ী? শাড়ীতে তোকে খুব সেক্সি লাগে। তোর ব্রা কি বাজারে পাওয়া যায়। উহ্ যা
: তনু ঐ নেশাখোর মেয়েটা কে বিয়ে করে তোর রুচি অনেক নীচে নেমে গেছে।
: তোকে একবার বিছানায় চাই
: ছোট লোকের মতো কথা বলবি না। এসব আমি ঘৃণা করি।
: তুই কোল্ড সেক্সে ভুগছিস আমার টাচে হট হয়ে যাবি। আমার ওয়াইফ অবশ্য এক্সপার্ট।
: এক্সপার্টকে ছেড়ে আনাড়ীকে চাইছিস কেন?
: তোর অহংকার ভেঙ্গে দেবো বলে।
: আমি বুঝতে পারি না তুই হঠাৎ আমাকে নিয়ে ক্ষেপলি কেন?
: হঠাৎ নয় বহুকাল ধরে তুই আমাকে ক্ষেপিয়েছিস।
: তুই আর কখনো বিরক্ত করবি না। রাখবো।
: এক মিনিট, সিঙ্গাপুর থেকে তোর জন্য একটা গিফ্ট এনেছি।
: ফুলছাড়া আমি কারো গিফ্ট নেই না। তুই নিশ্চয়ই সিঙ্গাপুর থেকে আমার জন্যে সোনার ফুল আনিস নি?
: সোনার চেয়েও দামী।
: যার কাছে মনের চেয়ে শরীর দামী তার সাথে কথা বলার রুচি আমার নেই। তোকে একটা কথা বলতে চাই ভালো করে শুনে রাখ। আমি তোকে হৃদয় দিয়ে ঘৃণা করি। কোনদিন আমাকে ডিসটার্ব করবি না ‘আই হেইট ইউ।’
ফোনটা কেটে গেল। শবনমের মাথাটা ঝিমঝিম করছে। শবনম ক্লান্ত হাতে বইটির পাতা উল্টচ্ছে যেটা সে মাইকেলের জন্য কিনেছে। ফ্রান্সের লেখক ডা: মরিস বুকাইলির ‘লা বাইবেল লা কোরআন য়েট লা সায়েন্স’ অর্থাৎ বাইবেল, কোরআন ও বিজ্ঞান।
রাত দশটায় কে যেন বেল টিপলো।
: বুবুন দেখতো কে?
: আমি তো দাত ব্রাশ করছি।
দ্বিতীয় বার বেল বাজলো শবনম দরজা খুলে অবাক।
: তুমি? একটা ফোন করে আসবে না?
: ফাদার তুমি আমাকে একটা ক্রুশচিহৃ এঁকে দাও।
: আহ্ বুবুন আগে ওকে বসতে দাও।
মাইকেল বুবুনের কপালে চুমু দিয়ে ক্রুশ এঁকে দিলো
শবনম বললো,
: ওটা বোঝার বুদ্ধি ওর হয়নি কাগজে এঁকে দাও।
: তোমার কি শরীর খারাপ? নিজের যত্ন নিও। এই শুয়ে পড়োতো আমি চা করে আনছি।
শবনমের মাথা ঘুরছে জ্বর নাকি বুঝতে পারছে না। বুবুন রং পেন্সিল কাগজ এনেছে মেঝেতে। শবনম উঠতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত বসে পড়লো ঘর ভাসিয়ে বমি করলো। মাইকেল খুব স্বাভাবিক ভাবে বুবুনকে কোলে নিয়ে বললো
: মাম অনিয়ম করে তাই অসুখ করেছে তুমি ভয় পেওনা।
শবনম শুয়ে পড়লো মাইকেল পানি এনে দিলো শবনম ধাক্কা দিয়ে গ্লাস ভেঙ্গে ফেললো।
: কি হয়েছে? অসুখ বাধাবে তুমি আর রাগ করবে আমার উপর? আমি রুটি খেয়ে থাকলে তুমিও উপোস করবে সেটা তো ঠিক না।
: কেন তুমিই শুধু ত্যাগ করতে জানো আর কেউ জানে না?
মাইকেল ঘর পরিষ্কার করতে করতে বললো
: কাল ভোরে অনেক দূরে যাচ্ছি। দেড় মাসের প্রোগ্রাম তাই ভাবলাম তোমাদের দেখে যাই। এটা তোমার জন্য ফিরে এসে এক সাথে খাবো।
: খাবো না পান করবো?
: তুমি জান এই শিশিতে কি?
: নিশ্চয় বিষ নয়।
: দ্রাক্ষা রস।
: কতটা খেতে হয়?
: লিমিটেড
: তোমার সব কিছুতে এতো সীমানা বাধা যে হাঁপিয়ে উঠেছি। আমার কপালে হাত রাখলে কি ক্ষয়ে যাবে সোনার হাত? নাকি উপলব্ধি কাচের গ্লাসের মতো ভেঙ্গে খান খান হয়ে যাবে। চুপ কেন? বলো কিছু....
মাইকেল অমলিন হেসে বলে
: আমি বলতে পারিনা। তুমি বলো শুনছি।
এক মুহূর্তে শবনমের মনে হলো না না মাইকেলই ঠিক আছে। ছুঁলে ভালোবাসা ফুরিয়ে যায়। আজ মাইকেলের সামনে নিজেকে বোকা মনে হচ্ছে। ওর হাসিটা কি যেন বলছে। শবনমের বিশ্বাসকে প্রশ্রয় দিতেই কি মাইকেল নিজেই পান করছে ব্যবধানের বিষ। নিজেকে গুছিয়ে শবনম বললো
: সরি আমাকে ভুল বুঝোনা।
: আমি তোমাকে তোমার চেয়েও বেশী বুঝি জানি।
: গান শুনবে?
: নাহ। তোমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে।
: আমি ঠিক আছি। গান গাইতে কষ্ট হবে না।
: সকালে ডক্টরের কাছে যাবে বুবুন ঘুমিয়ে পড়েছে ওকে শুইয়ে দিচ্ছি। তুমিও ঘুমাতে চেষ্টা করো অনেক রাত হলো।
: গান শুনতে না চাও আমার প্রিয় কবির কবিতা?
: হঠাৎ কবিতা? আমার জন্য তো শুধু গানই বরাদ্দ! ঠিক আছে, ঝটপট বলো কবিতা।
শবনম শুরু করলো কবিতার শিরোনাম ‘চার পাশের সমস্ত পুরুষকে’
‘সকাল থেকে সমস্ত কাজ কাঠের পুতুলেরা করে দেয়।
এই অলীক ব্যঞ্জনার পরও সমস্ত পুরুষ তোমরা মাতৃবন্দনায় রত থাকো।
প্রাতঃরাশ সারতে সারতে প্রতিদিন তোমার এটো থালা চেটে যাচ্ছে পুষি
আর রাতে আমার মুখে তুমি মুখ রাখোনা মুখগহ্বরে অ্যাসিডের নির্মম গন্ধ থেকে যাওয়ায়।
আমি যখন গর্ভিনী পাকস্থলীতে উগরে উঠত সর্বগ্রাসী খিদে।
হে পুরুষ তোমাদের আনা ডিম, কলা ভিটামিন আর ডালিম দানা বড্ডদামী
এই অভিযোগে হিম বাক্সে তালা দিতেন শাশুড়ী ।
আমি একটি হালকা ও মৃত শিশু প্রসব করেছিলাম। গর্ভের দোষ ভেবে,
তোমরা খুব পৌরুষ নিয়ে আকাশ দেখেছিলে
হিম বাক্সে একটিও মৃত আপেল তোমরা দেখতে পাওনি!’
: অভিযোগ নয় প্রশ্ন। এই কবিতাটা শোনাই কি আমার প্রাপ্য ছিলো? এতো নিষ্ঠুরতা কেন? ভালো থেকো ভালো থেকো।
: উত্তর-টা শুনে যাও।
গুলিবিদ্ধ পাখির মতো মাইকেল বেরিয়ে গেল। শবনম গাইলো, ‘মেঘে মঘে উড়ে চলে একটি পাখি হঠাৎ দেখে তার ডানা দুটো ভীষন ভারী। অনেক কষ্টে সে বড়ী ফেরে একাকী।’
রাত প্রায় আড়াটা। শবনম ঘুমর অসুধ খেও গুমতে পারছেনা। উল্টো গুনবে মনে হচ্ছে সোজা গুনতেই ভুলে গেছে। এক... দুই... তিন... চার... পাঁচ... ছয়... সাত না ঠিকই তো আছে। ফোন বাজলো,
: এতো রাতে ফোন কেন?
: এমনিই। তুমি জেগে আছো কেন শরীর খারাপ করবে।
: তুমি রাত জাগলে কিছু হবে না?
: তোমার জন্য একটা নূপুর কিনেছি দাম মাত্র দশ টাকা। আপতত বিছানা ছেড়ে ওঠো হালকা কোন গান দাও। ছোট বেলার নাচটা ঝালাই করো ঠিক ঘুম এসে যাবে।
: মাইকেল আমি নূপুর ছাড়া নাচতে পারি না।
: উহ্ কেন এমন করো। পায়ে ফিতে বেঁধে নাও।
: ফিতেয় হবে না ঐ দশটাকার নূপুর চাই।
: প্লীজ অবুঝের মতো করোনা কাজ শেষে আমি তো আসবোই। বুবুনকে কে দেখবে তুমি সুস্থ না থাকলে।
: আমি মরে গেলে----
: ওহ সুইট আজ আমার খুব মন খারাপ। আরো বেশী খারাপ করে দিতে চাও?
: কি হয়েছে?
: আমার একজন প্রিয় মানুষ আজ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন।
: কে?
: একজন ফাদার গত পঞ্চাশ বছর তিনি দেশ ছেড়ে এ দেশে পড়ে ছিলেন।
: সরি মাইকেল তোমার অবাধ্য কখনো হবোনা।
আমি জানতাম না তোমার মন খারাপ।
: থ্যাংক ইউ! প্রতিদিন জানাবে কঘন্টা করে ঘুমাচ্ছো।
: ঠিক আছে।
: রাখছি টেক কেয়ার ব্লেস ইউ,
: বাই।
শবনম কিছু নতুন কবিতা লিখলো এই প্রথম তেল রং দিয়ে ছবি আঁকার অবকাশ তার হলো। লুকিয়ে চুরিয়ে জলের সাথে রং মিশিয়ে সে গান গাইতো ‘নীল হলুদে, সবুজ হবে কালো লালে খয়েরী গোপালী চাও লালে শাদায় মেশাও না এ বেলা। সে এক মজার খেলা।’ স্কুল ফাইনালের আগেই মার উপর রাগ করে রং তুলী পুকুরে ছুড়ে ফেলেছিল শবনম। ভোরে মাইকেলের ফোন এলো।
: হ্যালো
: গুড মর্নিং।
: ভেরী গুড মর্নিং। কোথায় তুমি?
: একটু বাইরে আসতে পারবে?
: কোথায়? কি হয়েছে।
: পরে ঠিক করবো কোথায়। একটা কথা তোমাকে বলতে হবে মানে বলা দরকার।
: জরুরী কিছু?
: নিশ্চয়ই জরুরী তোমাকে না বললে---
: আমাকে না বললে কি? মুক্তি নেই?
: কার কি সে মুক্তি তাকি কেউ জানে?
: কি এমন ঘটনা রাতারাতি রাতি ঘটলো?
: রাতারাতি নয় সাড়ে সাত বছরেও বলতে পারছি না।
: আজব মানুষ তুমি! আজ তোমাকে কাতুকুতু দিলে তুমি একশো বছর পর হাসবে? গন্ডার কোথাকার। যাও নাটক করতে হবে না। আজ আমি কোথাও যেতে পারবো না।
: সে কোথায়?
: সে কে?
: বায়েজিদ।
: বুবুন বাবার সাথে রাতে ভাইয়ার বাসায় গিয়েছিল। আজ নাকি ওরা চিরিয়া খানায় যাবে।
: বাবা কবে এলেন?
: কালই এসেছে ডাক্তার দেখাতে।
: বুবুন তোমাকে ছেড়ে কখনো থেকেছে?
: না এই প্রথম। ও মহা আনন্দে আছে মাঝখান থেকে আমিই ঘুমাতে পারিনি।
: রাতে ঘুমাওনি এট লিষ্ট বারোটায় একটা কল দিতে পারতে।
: বারোটায় কেন? এই আজ কত তারিখ?
: জানিনা।
: আশ্চর্য আজ ৭ জুলাই। সরি মাইকেল আমি তোমার বার্থডে ভুলে গেছি।
: সরি হতে বলতে হবে না রাখছি।
: তোমার রাগ আছে নাকি?
: তুমি কি আমাকে মানুষ ভাবতে পারোনা? রাগ অভিমানতো বৃক্ষদেরও থাকে।
: প্লীজ আমাকে শাস্তি দাও। আমার ভুলে যাওয়া উচিত হয়নি আমার শাস্তিই পাওনা।
: প্লীজ এভাবে বলোনা। আমি এগারোটা নাগাদ আসছি তুমি রেডি থেকো।
: ওহ ভুলে গেছি হ্যাপি বার্থডে।
: থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ!
: বাই।
আকাশ রঙা শাড়ী পড়েছে শবনম সকাল সাড়ে এগারোটায় ওরা বেরিয়ে পড়লো। মাইকেল বললো,
: যাবে সেই বনে?
: শাড়ী পড়ে বন জঙ্গলে হাঁটতে পারবো? ঠিক আছে কোথায় যেতে চাও। তুমি যা ঠিক করেছো তাই হোক চলো যাই বৃন্দাবনে।
ওরা দুপুর তিনটায় পৌছে গেল মাইকেল চুপ করে একটা উচুঁ জায়গায় বসে আকাশ দেখছে।
: কি হলো আকাশে তাকিয়ে হাসছো কেন? গান শুনবে?
: নাহ।
: প্রতিদিন গান না শুনলে তোমার চলে না আর আজকের দিনে গান নয়?
: আজ নাচ দেখবো।
: পাগল? নাচের তাল নয় কিছু মনে নেই।
: নাচের তালের মতো একদিন আমাকেও তুমি ভুলে যাবে তাই না?
: থাক আর রাগ করোনা। যদি তুমি গাও আমি নাচবো।
: গান? আমি? না না আমার গান আসেনা
: তুমি গাবে।
: মাইরি আমার গান হয়না অন্য কোন শাস্তি নেই?
: ঠিক আছে তোমার গান গাইতে হবে না। কোন গান শুনতে চাও বলো আমি সব গানের সাথেই নাচতে পারি।
: কীর্তন।
শবনম শুরু করলো,
‘সখী গো আমায় কৃষ্ণ এনে দে
আমি মানের গোড়ায় ছাই দিয়েছি
আমার কুষ্ণকে এনে দে।’
‘হোলি খেলে রাই শ্যাম সনে
নিলাম্বরী হলো লাল
আজি শ্রীমতি যে রং মাতাল’
মাইকেলের কন্ঠে চমকে উঠলো শবনম। নাচ থেমে গেল।
: থামলে কেন গাও।
‘আমি জনমে মরণে ধরমো করমে
তোমারি নামতে ভোর । কেন যে বিরহ দিলে অহরহ বলোনা মনচোর
বলনা মনচোর কেন বিরহ দিলে যুগে যুগে তুমি বিরহ দিলে। কভু রাম অবতারে জানো কি তুমি?
আমার শয়নে স্বপনে রাধা আমি যে রাধাময়
জনমেতে রাধা মরনেতে রাধা
রাধাতেই আমি লয়
আমি যে রাধাময়।’
মাইকেল এই প্রথম শবনমের হাত ধরলো শবনম হাসতে হাসতে বললো
এই তুমি যেন কি জরুরী কথা বলবে বলেছিলে?
মাইকেলের সুখের হাসি ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে পকেট থেকে একটি লাল পাথরের আংটি পরিয়ে দিয়ে মাইকেল বললো
: এটি একটি আশীর্বাদিত আংটি।
কি হচ্ছে শবনম বুঝতে পারছে না। সব কিছু কেমন ঘোলাতে লাগছে। শুকনো হেসে কিছুটা স্বস্তি আনার জন্য বললো।
: মাইকেল আমি আংটি চাইনি স্বপ্নের চেয়েও সুন্দর অদেখা দশ টাকা দামের নূপুর পায়ে ঘুমাতে চেয়েছি। শবনম যেন গভীর সাগরে তলিয়ে যাচ্ছে। ভাবছে, কেন মাইকেল টিক চিহ্ন দিয়ে সব কিছু জটিল করে ফেলছে। বসে পড়লো শবনম। তার পা ধরে মাইকেল বলছে
: ও মাই মেরী লাভ ইউ, লাভ ইউ সো মাচ!
শবনম এক পলকে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো। যতোটা ভালোবাসা ততোটা আঘাত দিতে নিজেকে প্রস্তুত করলো। ততক্ষন মাইকেল পা ছেড়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
: এসো মাইকেল কাছে এসো। আমার হাত ধরো হৃদয় স্পন্দন শুনবে না?
মাইকেল ফিরে তাকালো ঠোঁটে এ কেমন হাসি? শবনমের হাত ছাড়িয়ে মাইকেল কঠিন হাতে ওর পা ধরে চুমু দিয়ে কি যেন বললো। শবনম উচুঁ গলায় বলে উঠলো
: নারীরা কোমল হাতে কাছে টেনে নেয় আবার শক্ত পায়ে দূরে ঠেলেও দেয় তা জানো?
শবনম মাইকেলের বুকে লাথি দিলো। প্রায় খাদে পড়ে যাচ্ছিল মাইকেল। শবনমের হাত ধরে গাড়ীতে নিতে চাইলে।
: প্লীজ এমন করোনা কেন এমন করছো? কি বুঝাতে চাও?
: বুঝাতে চাই তোমার জায়গা আমার বুকে নয় পায়ের তলায়।
শবনমের হাত ধরে মাইকেল বললো
: তুমি শান্ত হও। আমি তোমাকে কষ্ট দেবোনা তুমি আমার চেয়ে বড় সাধু কারন আমি জানি আমার অবস্থান তোমার পায়ে নয়। আমাকে তুমি বুকের ভেতরে সোনার কোটায় রাক্ষসের জানের মতো ভ্রমর বানিয়ে লুকিয়ে রেখেছো।
শবনমের হাত ধরে ঠোঁট ছুঁয়ে বললো
: মারিয়া আমি তোমার পায়ে ঠাই পাবার জন্যই প্রার্থনা করেছি। তুমি আমার সাধনা। তুমিই আমার ঈশ্বরী! মাইকেলের চোখের জল শবনমের হাত এবং হাতের আংটি ছুয়ে গেলে ঘরে ফিরে শবনম আশীর্বাদিত আংটির দিকে চেয়ে থাকে। সন্ধ্যার চুরি যাওয়া আলোয় লাল পাথর-টা পুড়ে যাওয়া একটা ছোট ফুল মনে হয়। কিন্তু ঐ কালো ফুলটির নিভে যাওয়া আগুন যেন তাকে সারা জীবন পোড়াবে। পুড়ে পুড়ে খাটি হওয়া ঘরে কেমন আছে মারিয়া সেকথা মাইকেল কি কোনদিন জানবে?
শবনম মাঝরাতে ছয় তলার ছাদে বসে মাইকেলের দেয়া সুন্দর শিশিটার নির্যাসটুকু গিলে ফেলে দুর্বল হাতে আংটি খুলে বোতলে বরে আকাশের দিকে ছুড়ে দেয়। সেটা হয়তো রাস্তায় আছড়ে পড়ে। কাঁচের টুকরোয় যেন ওর হাত কেটে যায়। রক্তের রং লাল চোখের জলের রং এর নাম কি?
শ্রীমতির প্রেম বিকশিত হেম ভালো করে তুমি জানো----
তারপর কি? গান ভুলে যায় সে। হঠাৎ বৃষ্টিতে শবনম ঘরে ফিরে আসে। বাথরুমের ছোট আয়নায় চোখ পড়ে। ছোট বেলায় কতো বৌ বৌ খেলতো। কাদামাটি দিয়ে কোর্মা পোলাও আরো কত কি রাধত।
হার্টের আকৃতির এক ধরের রসালো সবুজ পাতা হাতে ডলে লুচী বানাতো। অন্ধকারে পথ চলতে চলতে সে নিজেই যেন ফুল থেকে পাতা হয়ে গেছে। ঠিক যেন সেই নির্যাসহীন হালকা সবুজ হাতে ডলা ‘লুচীপাতা!’ কি জানি কোনদিন মাইকেলের সন্ধানী চোখে হালকা সবুজ রংটাকে হয়তো ভীষণ কালো দেখাবে। যদি কুৎসিত কালোকে মাইকেল অবহেলা করে। তাই চোখ মুছে শবনম ছেঁড়াখোড়া ছোট্ট জীবনের পান্ডুলিপিটা আর একবার যত্ন করে ঢেকে দেয় সুখ আর হাসির চকচকে সবুজ মলাটে।


Share on Facebook