বুদ্ধির জোরে
ফিরোজা হারুন
যুঁই আর চামেলী, দুই বোন। একজনের বয়স আট বছর, আরেকজনের ছয়। তারা দেখতে ফুলের মত সুন্দর। যেমন ফুটফুটে তেমন চঞ্চল। কাজে, খেলাধুলায় তাদের অনেক উৎসাহ। রোজ ভোরে তাদের মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙ্গে। মা খুব সুন্দর একটি কবিতা বলে তাদের জাগায়।
‘ভোল
হল,
দোর খোল,
খুকুমণি উঠরে, ঐ ডাকে যুঁই শাখে ফুল খুকী ছোট রে।’
ভোরে এই ডাকটুকু তাদের খুব মধুর লাগে। যুঁই চামেলী চটপট উঠে তাদের
বিছানা গোছায়। তারপর চলে যায় পুকুর-ঘাটে। হাত-মুখ ধুয়ে তারা ফিরে
আসে বাড়ি। বই নিয়ে বসে মাদুর পাতা বারান্দার এক কোণে। প্রথমে পড়ে
কায়দা। তাদের আরবী বই। তারপর স্কুলের অন্য বই। পড়া শেষ করে আসে মায়ের
কাছে রান্না ঘরে। মাকে একটু সাহায্য করে দুবোন। নাস্তা নিয়ে যায় মাঠে।
তাদের বাবা ভোরে চলে যায় মাঠে,
ক্ষেতের কাজে।
সকালে কোমল রোদ। মৃদুমন্দ বাতাস বইতে থাকে। মাঠের মাঝ খানে দাঁড়িয়ে আছে একটি ঝাঁকড়া মাথা শেওড়া গাছ। যুঁই চামেলী খাবারের পুটলি নিয়ে সেই শেওড়া গাছের ছায়ায় গিয়ে দাঁড়ায়। তাদের বাবা তাদের দেখতে পায়। হাত-পা ধুয়ে গাছের ছায়ায় চলে আসে। দুইটি বালিকা কোমল হাতে তাদের বাবাকে খাবার বের করে দেয়। তাদের বাবা ওসমান মিয়া তৃপ্তি সহকারে নাস্তা খায়। কন্যাদের সঙ্গে একটু কথা বলে। এই ফাঁকে একটু জিরিয়ে নেয়। ফেরার সময় বলে দেয় তারা যেন সময় মত স্কুলে যায়। নতুন প্রাইমারী স্কুলটি তাদের বাড়ির কাছেই। ওসমান মিয়া লেখাপড়া পছন্দ করে। সে মনে করে ছেলে হোক, মেয়ে হোক, সকলের লেখাপড়া শেখা উচিত। সে নিজে লেখা-পড়া শিখে নাই। সেই সময় লেখাপড়া শেখার তেমন প্রচলন ছিল না। স্কুল ছিল পাঁচ মাইল দূরে। সেই রেল লাইনের ধারে। তবে যুঁই চামেলীর মা পড়তে পারে, লিখতে পারে না, তবে ছড়া, কবিতা, পুঁথি সুন্দর করে পড়ে। ভোরে মায়ের মুখে ঘুম জাগানী ছড়া শুনে ওদের দু বোনের কি যে ভাল লাগে! তাদের ইচ্ছে করে অনেক লেখা-পড়া শিখতে। তাই তারা চটপট উঠে পড়ে। মাঠ থেকে ফিরে এসেই গোসল করে রোজ তারা স্কুলে যায়।
এমনি একদিন দু’বোনে
পুকুর ঘাটে গেল। ঘাটে তাদের জন্য বাঁশের খুঁটি পোতা আছে। ঐ খুঁটি ধরে
যুঁই-চামেলী সাঁতার শেখে। হঠাৎ
যুঁইর হাত খুঁটি থেকে ফসকে যায়। পুনরায় খুঁটি
ধরার চেষ্টা করতেই সে আরও পিছিয়ে গিয়ে ডুবে যায়। চামেলী একা। যুঁই তার
পাশে নেই। সে কি করবে ভেবে পায় না। তখনই পাড়ে উঠে আসে। দেখে দুজন লোক
পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। সে চিৎকার
করে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তার ব্যাকুলতা দেখে লোক দুটি এগিয়ে আসে।
তখন চামেলী যুঁই এর ডুবে
যাওয়ার কথা বলে। লোকজন তখনি পানিতে নামে। অল্প সময়ের মধ্যে তারা যুঁইকে
তুলে আনে। এদিকে চামেলীর কান্না শুনে তার মা বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন।
ঘটনা দেখে তিনি কাঁদতে শুরু করেন। গ্রামের অন্যান্য লোকেরা কাজ ফেলে
ছুটে আসে। সকলে মিলে মেয়েটিকে বাঁচাবার কাজে লেগে যায়। একজন যুঁইকে
মাথায় নিয়ে ঘুরতে থাকে। তখন যুঁই এর পেট থেকে পানি বেরিয়ে আসে মুখ
দিয়ে। ইতিমধ্যে প্রচুর পানি ঢুকে গিয়েছিলো তার পেটে। কিছুক্ষণ চেষ্টা
করার পর যুঁই শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে আরম্ভ করে। তখন সকলে বুঝতে পারে যে
মেয়েটি বেঁচে উঠবে। যুঁই-চামেলীর মায়ের কান্না যেন শেষ হতে চায় না।
তাদের বাবাও এলেন মাঠ থেকে। বাড়িতে
এত
লোকের সমাগম দেখে তিনি তো হতবাক। তার প্রিয় কন্যার এহেন অবস্থা দেখে
তিনি বড়ই পীড়িত হলেন। আর একটু পরে যুঁই-এর চোখের পাতা নড়ে উঠলো। সকলেই
বলছে, ‘যুঁই
চোখ মেলে তাকাও।’
এমন সময় যুঁই সত্যি চোখ মেলে চাইলো। সবার আনন্দ আর ধরে না। ছোট্ট একটি
প্রাণ এতক্ষণ কোথায় ছিল?
সে ছিল তার মায়ের কোলে। কাঁদতে শুরু করলো সে তার মাকে দেখে। এতক্ষণ
চামেলী ছিল দূরে দাঁড়িয়ে। এবার সে কাছে এলো। কাঁদতে লাগলো বোনকে জড়িয়ে
ধরে। সবাই জানতে চাইলো যুঁই কিভাবে ডুবে গিয়েছিল। চামেলীর মুখে সব কথা
শুনে চামেলীর বুদ্ধির প্রশংসা করতে লাগলো সবাই। চামেলী যদি তখনই সে লোক
দুটিকে ডেকে না আনতো তবে যুঁইকে বাঁচানো সম্ভব হত না। এই ছোট্ট মেয়েটির
উপস্থিত বুদ্ধির জন্য সকলে ধন্য ধন্য করতে লাগলো।
বেলা অনেক হল। ছেলে-মেয়েরা স্কুলে গিয়ে বসলো। দুইজন অনুপস্থিত। তারা আর কেউ নয় যুঁই-চামেলী। শিক্ষকগণ ছেলে-মেয়েদের কাছ থেকে যুঁই চামেলীর সব ঘটনা শুনলেন। তাঁরা চামেলীর বুদ্ধির প্রশংসা করলেন। ওর বুদ্ধির জোরেই যুঁই এর প্রাণ রক্ষা পেল।