কার্তিকের কুয়াশা

ছন্দে পতন
হুমায়রা হারুন



সায়েম ওর স্পেসশিপ নিয়ে সারাদিন ঘুরে বেড়িয়েছে। বেড়াতে ওর খুব ভাল লাগে। সময় পেলেই কাজের ফাঁকে ফাঁকে চলে যায় গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে, গ্যালাক্সী থেকে গ্যালাক্সীতে।মহাশূন্য ভ্রমণকালে একবার হঠাত করেই মিল্কিওয়ে ছায়াপথে তার প্রবেশ। তারপর একবার নয় বেশ কয়েকবারই এসেছে সে এখানে। যে গ্যালাক্সী থেকে সে এসেছে তার নাম সানফ্লাওয়ার গ্যালাক্সী।তার বাসস্থান থেকে পৃথিবী নামক গ্রহের দূরত্ব ৩৫ মিলিয়ন আলোকবর্ষ মাত্র। সূর্যমুখী ফুলের মত দেখতে বলেই গ্যালাক্সীটির এরূপ নামকরণ। পৃথিবীতে এর আরো একটি নাম রয়েছে আর তা হলো M63।এর সর্পিলাকার বাহুগুলো কেন্দ্রের সাথে শক্তভাবে যুক্ত। মিল্কিওয়ের মতো এর বিশাল বপু নেই। ব্যাস মাত্র ৬০ লক্ষ আলোকবর্ষ, মিল্কিওয়ে থেকে ৪০ লক্ষ আলোকবর্ষ কম বলেই মাত্র দশ বিলিয়ন নক্ষত্র নিয়ে মহাকাশে তার অবস্থান।
পৃথিবী গ্রহটি কেমন সায়েম প্রথমদিকে তেমন বিশেষ কিছু জানতনা। ঘুরতে ঘুরতে এই ছায়াপথের কতনা নক্ষত্রের এ পাশ ওপাশ পেরিয়ে এ সৌরজগতে সেদিন তার প্রথম প্রবেশ। এর আনাচে কানাচে ঘুরে যেই না চলে যাবে বলে সিদ্ধান্ত নিল হঠাতই চোখে পড়লো সবুজ শ্যামলিমার এক বনভূমি। কি ওটা? সায়েম বুঝেনি যে সে এই দূর আকাশ থেকে পৃথিবীর বুকের ঘন আমাজন জঙ্গলটা দেখতে পাচ্ছে। উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়েছিল। কি যে সুন্দর লাগছে । একবার গেলে কেমন হয়? যেই ভাবা সেই কাজ। প্রবেশ করলো পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে। যতই গ্রহটির কাছে আসছে, ততই সুন্দর লাগছে। সবুজ ছোপ ছোপ জঙ্গল, মাঝে মাঝে নীল নীল সাগর মহাসাগর মন মাতানো দৃশ্য তৈরী করেছে বটে। কিন্তু আজ হাতে তেমন সময় নেই।অফিসে প্রচুর কাজ পড়ে আছে। ফিরে যেতে হবে তার নিজ গ্রহে। দ্রুত দিক পরিবর্তন করে ফিরে এলো মিল্কিওয়ে গ্যালক্সীর একদম বাইরে। মিনিট পাঁচেকের ভ্রমণ। তারপরেই তার আবাসস্থল। কিন্তু সারাদিনই ভেবেছে পৃথিবীকে নিয়ে।। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বলা চলে একে। আবারো ওখানে যাবে, কাল না হয় পরশু।
পরদিন খুব সকালে বের হলো বাসা থেকে। এবার তার স্পেশসিপের দিক মিল্কিওয়ের দিকে। তথ্যও পেয়েছে অনেক। স্পাইরাল আকারের এই গ্যালাক্সীটির ব্যাসার্ধ ১ লক্ষ আলোক বর্ষ। ২০০ থেকে ৪০০ মিলিয়ন নক্ষত্রের সমাহার এতে। গ্যালাক্সীটির কেন্দ্র হতে ২৬,০০+ ১৪০০ আলোকবর্ষ দূরে সূর্যের অবস্থান। এর মাঝে প্রবেশ করতেই সায়েম লক্ষ্য করলো পাশ দিয়ে শনির বলয় আর বৃহস্পতির বিশাল বপু। একটু আগালে হালকা গোলাপী রঙের মঙ্গলের আকাশ। আর তারপরেই পৃথিবীর নীল আকাশ। ঐতো সেই ঘন সবুজ আমাজনের জঙ্গল। এবার স্পেসশীপটা একটু নীচু করে চালালে আরো ভাল করে দেখা যাবে পৃথিবীকে। চমতকার সব পর্বতশৃঙ্গ।
সায়েমদের মত মানুষ সদৃশ কেউ কি আছে এ গ্রহে?
খোঁজ করলে পেতেও পারে।
তারা কি প্রযুক্তির দিক দিয়ে খুব উন্নত? এতগুল প্রশ্ন মনে ভীড় করেছে একসঙ্গে। জানার ইচ্ছের শেষ নেই। কিন্তু কিভাবে জানবে? মন্দ হয়না যদি স্পেসশিপটা কোথাও পার্ক করে পৃথিবীর বুকে কিছুক্ষণ বিচরণ করে ওদের সকল তথ্যগুলো জানা যায়। সভ্যতার কত সাল অতিক্রম করছে তা জানা গেলেও ধারণা পাওয়া যাবে। চলার পথে লক্ষ্য করলো পৃথিবীর আবহাওয়া তার গতিপথে বাধা সৃষ্টি করছে না। এঁকে বেঁকে সায়েম এগিয়ে চলছে পৃথিবীর আকাশ পথে।
বাহ্‌ , ওদের কিছু উড়োজাহাজ আছে দেখছি। বেশ শব্দ করে চলে তারা। ওড়ার লক্ষণ দেখে মনে হচ্ছে তারা সায়েমকে দেখতে পাচ্ছে না। সুতরাং ওকে বেশ সাবধান থাকতে হবে। এঁকে বেঁকে চলার মাঝে যে আনন্দ তাতে ছন্দপতন সে একেবারেই চায় না। কারো সাথে ধাক্কা লেগে গেলে নির্ঘাত অ্যাকসিডেন্ট। ওর ক্ষতির সম্ভবনা কম কারণ ওর শিপ হালকা হলেও মজবুত এবং টেকসই। এ প্রযুক্তি ব্যবহার করতে বুঝা যাচ্ছে আরো একশত বছর সময় লাগবে এখানকার বাসিন্দাদের। ওরা ন্যানো প্রযুক্তির বোধহয় খুব প্রারম্ভে!
সায়েম মাটি থেকে এখন মাত্র কয়েক ফিট উপরে। বেশ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে ব্লক ব্লক ঘরবাড়ি, রাস্তায় স্রোতের মত মানুষ। কিছু দূর এগুতেই অনিচ্ছাকৃত ধাক্কা লেগে গেল ফ্যান মিলের ব্লেডের সাথে। এত শব্দ হল কেন? ব্লেডের সাথে আঘাত লাগায় কিছুটা বিমর্ষ হয়ে সিদ্ধান্ত নিল আজ আর নয় এখানে, ফিরে যাবে এখনই এই মুহূর্তে।



মিসেস ক্লিফোর্ড তখনও কিছু টের পাননি। সায়েম চলে যাওয়ার ঘন্টা দু’য়েক পরের কথা। শহর থেকে খাবার কিনে বাড়ি ফিরছেলেন মিসেস ক্লিফোর্ড। উনি শহর থেকে দূরে একটি ছোট্ট গ্রামে নিরিবিলি থাকতে অভ্যস্ত। সপ্তাহান্তে বাজার করতে শহরে যান। ওনার গ্রামটি পাহাড়ের ঠিক পাদদেশে। সুইজারল্যান্ডের পাহাড়ী ভূ-প্রকৃতি খুবই মনোরম। ঐ উঁচু জায়গায় তিনি বাড়ির বৈদ্যুতিক শক্তি সরবরাহের জন্য ১২০ ফুট উচুঁতে উইন্ডমিল স্থাপন করেছেন। এরই একটি ফ্যানের ব্লেড ভেঙে যাওয়াতে আজ মিসেস ক্লিফোর্ড তার বাড়ীর আলোহীন দশা দেখে হতবাক। ঝড়ের গতি সইবার মতন করেই ফ্যানের ব্লেডগুলো বানানো। আজকের আবহাওয়া ও চমতকার। তাহলে কি এমন উড়ে এসে পড়লো আর ব্লেডটি ভেগে গেল তা ঠিক বুঝে উঠতে পারলেন না মিসেস ক্লিফোর্ড । আজ রাতটুকু তাকে অন্ধকারেই কাটাতে হবে। ছেলেকে জানিয়েছেন ইতিমধ্যে। যা করবার কাল সকালে হবে।



সায়েম এবারের সপ্তাহান্তে আবারো ঠিক করলো পৃথিবীকে দেখতে যাবে। এবার ও এমন একটা স্পেসশীপ নেবে যা পৃথিবীর র্যাোডারে ধরা পড়ে। মজাই হবে এবার। এমন একজন আগুন্তককে দেখে ওদের বেশ অবাক লাগবে বোধহয়। এসব ভাবতে ভাবতেই সায়েম তার খুব প্রিয় সাদা রূপালী প্রলেপের স্পেসশীপটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। এই ক্রাফটি গোলাকার চাকতির মতোন দেখতে। ভিতরে তার প্রিয় রিডিং রুমও আছে।
পৃথিবীর আকাশে পৌঁছে দেখতে পেল নীচে একটা খোলা মাঠ। ওখানে নেমে আশপাশটা খেয়াল করতে চোখে পড়লো একটু কাছেই গাছ গাছালীতে ঘেরা সুন্দর একটা বাড়ি। বাড়ির জানালা ভেদ করে ছোট্ট একটি শিশুর অবাক করা দৃষ্টি ঠিক তার ওপর। কাছে যেয়ে জিজ্ঞেস করবে নাকি কেমন আছ? তাই করো। ততক্ষণাত শিশুটি দৌড়ে কোথায় যেন চলে গেল। হায়রে অর্বাচীন, ভয় পেয়েছে বোধহয়।
মিস্টার ও মিসেস হ্যারিসন নর্থ ক্যারলিনার এই উপশহরে বসবাস করে আসছেন বছর দশেক ধরে। এখানেই তাদের একমাত্র সন্তান হ্যারির জন্ম। বছর তিনেক আগে স্কুলে ভর্তি হয়েছে সে। এখন থার্ড গ্রেডে। এই ৮ বছর বয়সেই তার ছোট্ট পৃথিবীর আনাচে কানাচে তার চেনা। কিন্তু আজকের এই বিশাল গোলাকার আকাশযানটির নিঃশব্দ অবতরণ এবং ঠিক তার জানালার পাশে-এ যেন তার কাছে অবিশ্বাস্য এবং অচেনা। ও খেলতে খেলতেই খেয়াল করেছে স্পেসশীপটি । গুটিগুটি করে এগিয়ে গেছে জানলার কাছে। এত্তবড় স্পেসক্র্যাফটি এত নিঃশব্দে চলে কি করে? কিছুই বুঝতে পারছে না হ্যারি। নীচের তলার লিভিং রুমের পাশের জানালায় কে যেন এসে দাঁড়িয়েছে। ওই ক্র্যাফট থেকেই সম্ভবত বের হয়ে এসেছেন তিনি। ভয়ে হ্যারি চলে এলো দোতলার টিভি রুমে বাবা মার কাছে। হ্যারির ভীতসন্ত্রস্ত বর্ণনায় ওনারা কিছুই বুঝলেন না। বাচ্চাদের কল্পনাপ্রবণ মন কত কিছুই না ভাবে। হ্যারিকে ঘুম পাড়িয়ে লেইট নাইটের নিউজ দেখে হ্যারিসন দম্পতি ঘুমানোর প্রস্তুতি নিতে গেলেন। টিভিটা খোলাই ছিল। হঠাত একটি বিশেষ খবর দুই লাইনে স্ক্রিনের পর্দায় ভেসে উঠলো। খবরটা বেশ চমকপ্রদও। আজ সন্ধ্যা ৭ টায় তাদের শহরের আকাশে গোলাকার রূপালী সাদা আভা ছড়ানো একটি শব্দহীন উড়ন্ত বস্তু দেখা গেছে। শহরের পূর্বদিকের এয়ারফোর্স বেইজের র্যাাডার পর্যবেক্ষণ দলটিও যেন ছোট্ট হ্যারির মত মন গড়া ইউ এফ ও দেখা শুরু করেছে- ভেবে বেশ মজাই পেলেন তারা। ভাবলেন কল্পলোকে ভেসে যেতে কার না ইচ্ছে করে!



নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে হেমন্তের মেঘমুক্ত আকাশে নর্থ ক্যারোলিনার এই ছোট্ট গ্রামে ছোট বড় সকলেই ঘুড়ি খেলায় মত্ত থাকে । প্রতিযোগীতার সময়ে আকাশ ছেয়ে যায় অজস্র ঘুড়িতে। সে সময়ে সায়েমের স্পেস্ক্র্যাফট চালানো তার সাবলীল গতি হারিয়ে ফেলে। চলার ছন্দে পতন অনুভব করে। তবুও সায়েম সাবধান থাকে ঘুড়িগুলো রক্ষা করার জন্য-মাঝে মাঝে দু একটা দুষ্টুমি করা ছাড়া।
আজ একটা লাল ঘুড়ি বেশ উপরে উঠেছে। সুতোটা কেটে দিতে ইচ্ছে হল খুব । যার ঘুড়ি তার না হয় একটু খারাপ লাগবে। কিন্তু খালি আকাশে ঘুড়ির সুতো কাটার রহস্য কখনো কি টের পাবে?
জ্যাকের হাতের মাপটা ভীষণ ভাল। সুতোর টান আর বাতাসের গতির সাথে তাল মিলিয়ে ওর ঘুড়ি ওড়ানো এতই নিখুঁত হয় যে, ঘুড়িটা তার চোখের সীমানা পেরিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়ে আবার ফিরে আসে। কিন্তু আজ কেন এর ব্যতিক্রম হচ্ছে ও বুঝতে পারছে না। সেই যে দূর আকাশে ঘুড়িটা উড়ে গেছে , আজ আর তা ফিরে আসার নামও নেই। জ্যাকের হঠাতই মনে হল শক্ত কিছুর সাথে যেন আটকে গেছে তার ঘুড়ি। মেঘমুক্ত নীল আকাশে তেমন কিছু চোখেও পড়ছে না। অত্ত দূরে দেখাও কঠিন কিন্তু আটকে যাবার টান আজ সে ঠিকই অনুভুব করেছে। বন্ধুদের বলেও লাভ নেই এই কথা, বাবা মাকে বলেও না। কেউই মানবে না জ্যাকের কথা। ঘুড়ি তো হারিয়ে যেতেই পারে তাই বলে অদৃশ্য স্পেস্ক্র্যাফটের সাথে ঘুড়ির সুতো আটকে যাবে নাকি?
কিন্তু আজ ঠিক তাই-ই হলো। লাল ঘুড়িটা আজ সায়েমের দখলে। আর কাটা সুতোই শেষমেশ জ্যাকের প্রাপ্তি । সান্ত্বনা দিয়ে ভাবলো ঘুড়ি না হারালে কি ঘুড়ি খেলা নেশা ধরাতে পারে?



সায়েমের সহপাঠী রবিন পুরোপুরি উশৃঙ্খল। যখন যা মন চায় তাই করে বেড়ানো তার স্বভাব। ও যেন সায়েমেরই বিপরীত রূপ- এক অনাহুত- সায়েমের অ্যান্টি ইউনিভার্স থেকে। রবিনের বাবা মায়ের আদি নিবাস পিন হুইল গ্যলাক্সি M 33 তে।এর ব্যাসার্ধ ২৫ হাজার আলোকবর্ষ। অ্যান্ড্রমিডা থেকে আরোও অর্ধ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে অর্থাৎ পৃথিবী থেকে ৩ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে এর অবস্থান। ওখান থেকে এসে তারা বসতি স্থাপন করেছেন সানফ্লাওয়ারে। রবিনের জন্মও এখানে। কিন্তু পিন-হুইলে প্রায়ই সে বেড়াতে যায়। মিল্কিওয়ের কথা সে জেনেছে সায়েমের কাছ থেকে। আর তারপর থেকেই পৃথিবীতে তার আগমন।
সেদিন পৃথিবীর আকাশ ছেড়ে বাড়ি ফিরবার সময়ে রবিনের স্পেসক্রাফটের সাথে তার ছোটখাটো একটা যুদ্ধই বেঁধে গেল। কারণ খুব সামান্য। সায়েম চায়নি রবিন তার পেনসিল টর্চের আলো ফেলে যখন তখন পৃথিবীর আকাশে বিদ্যুতের চমক সৃষ্ট করুক। ঝড় বাদল নেই এমন আবহাওয়ায় পৃথিবীর মানুষগুলো যথাসম্ভব চেষ্টা করে বাড়ির বাইরের কাজগুলো সেরে ফেলতে। আর অমন সময়ে রবিনের টর্চ লাইটের হাজার ভোল্টের বিদ্যুত চমক গত বছরই জ্যাকির বাবাকে পঙ্গু করে ফেলেছে। প্রাণহানি হবার ও সম্ভবনা থাকে বিদ্যুত চমকে। বয়েজ স্কাউটের সেই ১১ জন স্কাউট গতবছরই ক্যম্পিং এর সময়ে ভর দুপুরে বিদ্যুত চমকে নিহত হয়েছে শুধুমাত্র রবিনের কারণে। ক্যালিফোর্নিয়ায় যখন তখন দাবানলে পুড়ে ছারখার হয়ে পড়ে লক্ষ লক্ষ একর জমি শুধু মাত্র রবিনের একটা পেন্সিল টর্চের আলোতে।কিন্তু কেন এসব খেলা রবিনের ভাল লাগে তা সায়েম বুঝে উঠতে পারেনা।
তখন সময় ২০০৬ সাল। টেক্সাসের সীমানা বরাবর দাবানলের প্রজ্জ্বলিত শিখা টেক্সাসের ম্যাপকে রাতের অন্ধকারে প্রকট করে তুলেছিল। যেন পুরো ম্যাপের সীমানা ধরে জ্বলছে মশাল মিছিল। রবিন সে সময়কার অনেকগুলো স্ক্রিনশট নিয়ে রেখেছিল। তারও তিনবছর পর অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে প্রায় ২০০ লোকের প্রাণহানি ঘটেছে। দাবানলের আগুন ধেয়ে এসেছিল জনপদে। মানুষগুলো কিভাবে বিচলিত হচ্ছিল দেখে রবিন হেসে বলে ফেলেছিল ‘পুওর আর্থ ক্রিয়েচার!’
এই গ্রহের বিজ্ঞানীদের ধারণা গ্রীষ্মের প্রচন্ড দাবদাহ শুষ্ক বনাঞ্চলে এই বিপর্যয় সৃষ্টি করে। আরও বহু ব্যাখ্যা তাদের ঝুলিতে সবসময়ই মজুদ থাকে। কিন্তু তারা ভাবতেও পারেনা সানফ্লাওয়ার গ্যালাক্সি থেকে আগত রবিনের কীর্তিকলাপের কথা। যার নীরব সাক্ষী শুধু সায়েম।
রবিনের সাথে সায়েমের ছোটখাটো যুদ্ধ বেঁধে যাওয়ার সময় অ্যারিজোনার এয়ারফোর্স বেইজের রাডারে তা ধরা পড়ে গেল। সাথে সাথেই ওদের কিছু যুদ্ধ জাহাজ আকাশে অবস্থান গ্রহন করলো। সময় সকাল আটটা হবে। ইউ এফ ও দুটির যুদ্ধ দেখতে পেলেও পৃথিবীর ফাইটার জেটের চালকরা লক্ষ্য করলো একটি নির্দিষ্ট সীমারেখা অতিক্রম করে তারা কিছুতেই ইউ এফ ও-র কাছ ঘেষঁতে পারছে না। যেন এক অজানা শক্তি বলয় ঘিরে রেখেছে ইউ এফ ও দুটির চারিধার।
সেদিনই রবিন শেষবারের মতো জানিয়ে দিল সায়েমকে, সে আরো কিছু করবে এ পৃথিবীতে যা সায়েমের কখনোই পছন্দ হবে না।
ও যেন দিনদিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে। তাই সায়েমের সাথে যুদ্ধ থামিয়ে রওনা দিল নিউইয়র্কের আকাশে ।



নিউইইয়র্কের বাফেলো শহরের বিমানবন্দরটি পৃথিবীর ব্যস্ততম বিমানবন্দর। রবিন কিছুদূর এসেই লক্ষ্য করলো প্রায় ৪০/৫০ জন যাত্রীর কন্টিনেন্টাল এয়ারক্রাফট-৩০৩৭ অবতরণের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
একটা ধাক্কা।
নিমেষে প্লেনট ভূপাতিত হলো।সব মিলিয়ে পাঁচ সেকেন্ড হবে। যাত্রীরা কিছু বুঝে উঠবার আগেই প্রচন্ড বেগে কন্টিনেন্টাল এয়ারক্রাফট-৩০৩৭ বাফেলো শহরের একটি বাড়ীর ছাদে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেল। সময়টা পৃথিবীর মানুষের কাছে ১৩ ই ফেব্রুয়ারি, ২০০৯. সেইদিনের কন্ট্রোল টাওয়ারটির সাথে প্লেনটির অতর্কিত সংযোগ বিচ্ছিন্ন হবার কারণ আজও তাই রহস্যজনক।
পৃথিবীর মহাকাশ গবেষকরা বহুদিনের সাধনায় মঙ্গল গ্রহে তাদের চালিত রোবট টি থেকে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে আসছে বছর পাঁচেক ধরে। ল্যান্ড রোভার, মঙ্গলের পাথুরে ভূ-অঞ্চল, জলপ্রবাহের ছাপ বিশিষ্ট শুকিয়ে যাওয়া নদীপথ, পিরামিড সদৃশ বিভিন্ন স্থাপনার চিত্র পাঠাতে শুরু করেছে ২০০০ সালের গোড়ার দিক থেকে। এই ল্যান্ড রোভারের সাথে পৃথবীর যোগাযোগ ব্যবস্থা এতটাই সুনিপুণ যে বিজ্ঞানীরা গর্বিত তাদের গবেষণায় অর্জিত সাফল্যে। কিন্ত এতটা এগিয়ে যাওয়া গবেষণাকে থমকে দেয়া রবিনের জন্য কোন ব্যাপারই না। আর কাজটা সে করে বসলো ঝোঁকের মাথায়। তারিখ পৃথিবীর সময় অনুযায়ী ২০০৯ এর জানুয়ারীর শেষ সপ্তাহ হবে। নতুন প্রেসিডেন্ট আমেরিকায় শপথ নিয়েছেন। তার কিছুদিন পরই বিজ্ঞনীরা লক্ষ্য করলেন মঙ্গলের ল্যান্ড রোভার তাদের সাথে সকল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে। শত চেষ্টায়ও যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব হচ্ছেনা। পৃথিবীর কোন সংকেতই যেন সে সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারছে না। কোন অজানা কারণে তার অবস্থাগত পার্থক্যের দরুণ কর্মসম্পাদন বিঘ্নিত হচ্ছে কি না এরকম হাজারো প্রশ্ন বিজ্ঞানীদের মনে ঘুরপাক খেলেও রবিনের দুষ্টুমি তাদেরকে চরম বিপদে ফেলে দিয়েছে। এতদিনের পরিশ্রম সাধনা যেন কোন কারণ ছাড়াই সমাপ্ত হয়ে গেল। তারা জানলেনও না রবিন মাত্র ৫৬ হজার আলোকবর্ষ দূরের প্রতিবেশী। ও একটু নয়, বেশ কিছুটা বেপরোয়া বলে সামনে তাদের কাজে আরো বিপত্তি অপেক্ষা করছে।



ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০০৯.
সকালে ঘুম থেকে উঠে যে খবরটা সকলের চোখে পড়লো তা ভয়ানক। অতলান্তিক মহাসাগরের নীচে ব্রিটিশ ও ফ্রান্সের সাবমেরিনের অতর্কিত সংঘর্ষে সবমেরিনে সংরক্ষিত নিউক্লিয়ার বোমার বিস্ফারণ। সাগরতলে প্রলয়লীলার আশংকা। সাবমেরিন দুটির সকল ক্রুসহ সে অঞ্চলের কোন প্রানীর বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে সবকিছু।
খবরটা সায়েমের ভাল লাগেনি। এমন একটা ঘটনা সত্যিই দুঃখজনক। কিন্তু ঘটনাটা যখন ঘটেছিল, রবিন তখন কোথায় ছিল? রবিনকে বেশ কিছুদিন ধরেই দেখছে না সায়েম। সেদিনের বিবাদের পর রবিন যেন নিরুদ্দেশ। কোথায় কোন অঘটন ঘটাচ্ছে কিনা কে জানে।
যেকোন দুঃসংবাদে সায়েমের মন যটটা খারাপ হয় রবিন যেন ততটুকুই আনন্দিত হয়। কিন্তু কেন এমন হবে? সব ভালোর সাথে কি সমানরকমের খারাপও থাকতে হবে? খারাপের অস্তিত্ব প্রকৃতিতে না থাকলে কি হতোনা? সমস্যা যেটা হতো তা হল ভালোর সংঙ্গা নির্ণায়ন সম্ভবপর হতোনা। আর এই বিপরীত দুই বৈশিষ্ট্যই দুটি অস্তিত্বের জন্ম দিয়েছে। একজন সায়েম, আরেকজন রবিন।
রবিন কেন পারেনি সেই কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখতে যেদিন সে সাইবেরিয়ার আকাশের ৫০০ মাইল উপরে কসমস আর ইরিডিয়াম স্যাটেলাইট দুটোর সংঘর্ষ বাঁধালো? পৃথিবীর তারিখ ফেব্রুয়ারি ৭, ২০০৯, জিএমটি সময় ১৬টা ৫৫ মিনিট। হঠাতই পৃথিবীতে সংবাদ এলো সংঘর্ষের। প্রায় ৯০০ কেজি ওজনের রাশান মিলিটারি স্যাটেলাইট কসমস ভেঙে গুড়োগুড়ো হয়ে গিয়েছে ৫৬০ কেজি ওজনের ইউএস স্যাটেলাইট ইরিডিয়ামের সাথে ধাক্কা লেগে। দূর আকাশে থেকে পৃথিবীকে যেন স্পষ্ট ভাবে দেখা যাচ্ছেনা। পৃথিবীর চিত্র যেন আবৃত হয়ে আছে স্যাটেলাইটের অসংখ্য খন্ড খন্ড কণা দিয়ে। হয়তোবা গুড়ো গুড়ো অংশগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়বে এ গ্রহে ইতস্তত ভাবে।
১৯৫৭ সালে রাশিয়া যখন স্পুতনিক-১ উত্থাপন করলো তারপর হতে ২০০০ সাল পর্যন্ত ২৬৭১ টি স্যাটেলাইট উত্থিত হয়েছে। আর এ সময়ের মধ্যে প্রায় ১৭০০০ বস্তুর খন্ডাংশ বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে এসে পড়েছে। তবে ইউএস সারিভিয়্যালান্স মিশনের বরাতে যেটুকু আশার বাণী শুনা যায় তা হলো পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে প্রবেশের সাথে সাথে সেই খন্ডাংশটুকু প্রজ্জ্বলিত হয়ে শেষ হয়ে যায় অথবা সাগরে পড়ে সাগরের জলে হারিয়ে যায়। অতিপ্রাকৃত এসব ঘটনায় এই গ্রহের মানুষগুলো আতঙ্কিত হয়ে পড়লেও ভীন গ্রহ থেকে আসা রবিনের কাজের ছন্দপতন কখনই ঘটে না।

Share on Facebook