- অরুণোদয় কুণ্ডু
ইলোরা যাওয়ার পথের দৃশ্য
দৌলতাবাদ দুর্গ, রাস্তা থেকে
ঔরঙ্গজেবের সমাধি
ঘৃষ্ণেশ্বর জ্যোতিলিঙ্গের মন্দির
৪
ইলোরার পথে আরও লুকানো রতন
পরদিন বেড়িয়ে পড়লাম সকাল সকাল, উদ্দেশ্য ইলোরা। আজও যথারীতি ভ্রমনের
দালালরা পসরা সাজিয়ে হাজির হল এক দিনে সব ঘোরানোর অফার নিয়ে। আমরা সে সব
ফাঁদে পা না দিয়ে বাস স্ট্যান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করে উঠে পরলাম কন্নডের বাসে।
এই বাস একঘণ্টা য় পৌঁছে দেবে ভেরুল বা ইলোরা।
বাসে প্রচণ্ড ভীড়। আমরা বসার জায়গা পেয়েছি লড়ে। এদিককার বাসগুলোয় বসার
প্রশস্ত যায়গা। দুজনের সিটে চেপে বসলে তিনজন হয়ে যায়। ভিড়েও দমবন্ধ হয়ে
আসেনা। আমাদের পাশে এক বয়স্ক ভদ্রলোক বসেছিলেন। ওনার সাথে অনেক কথা হল।
দুপাশে বর্ষণ সিক্ত সবুজ পাহাড় মন ভরিয়ে দেয়। এক সময় রাস্তা এক প্রাচীন ফটক
পেরোয়। ওনার কাছ থেকে জানতে পারি এটা দৌলতাবাদ দুর্গের প্রাচীরের একাংশ।
আগে নাকি সাধারণকে এই ফটক সবসময় পেরোতে দেওয়া হতনা। জাতপাতের সমস্যাও ছিল।
বাবাসাহেব এসে নাকি সব ঠিক করে দিয়েছেন।
দৌলতাবাদের পাহাড়জোড়া কেল্লা দেখতে দেখতে এগিয়ে চললাম। এরপর এল খুলদাবাদ।
এখানে ঔরঙ্গজেবের সমাধি রয়েছে। একেবারে সাদামাটা সমাধি। ওনার রাজকার্য
বহির্ভূত ক্ষুন্নিবৃত্তির আয়ে নাকি এই সমাধি বানানো।
আরও অবাক করা ব্যাপার হল, তিনিই একমাত্র মুঘল সম্রাট যার সমাধির মাথায়
রয়েছে তুলসি গাছ। ইতিহাস তাকে জানে হিন্দু মন্দিরের ধ্বংসকারী হিসাবে। শেষ
জীবনে এমন কী হয়েছিল যে নিজের সমাধিতে তুলসী গাছ রাখার কথা বলে গিয়েছিলেন?
জানা নেই। তবে আজ আমরা সমাধি দেখব না। তাই আরো কিছুটা এগিয়ে ইলোরা।
পাশের ভদ্রলোক বললেন ইলোরায় না নেমে তার পরের স্টপেজে নামতে, ওখানে
ঘৃষনেশ্বর শিবের মন্দির আছে। দেখে ৫০০ মিটার মত ফিরে এলেই ইলোরায় ঢোকার
গেট। আমরাও তাই করলাম। ঘৃষনেশ্বর মন্দির এখানের এক ভ্রমণের জায়গার মধ্য
পরে। তখন জানতাম না এটি দ্বাদশ জ্যোতিঃলিঙ্গের একটি।
এই মন্দিরের গর্ভগৃহে পুরুষদের খালিগায়ে ঢুকতে হয়, এমনই রীতি। পুজো দিলাম,
স্পর্শ করলাম জ্যোতিঃলিঙ্গ। মন্দির লালপাথরের কারুকাজে ভরা দক্ষিন ভারতের
মন্দিরের ধাঁচের। তার মধ্য রয়েছে বিষ্ণুর অবতার সমূহ, শিব পুরানের বিভিন্ন
ঘটনাসমূহ।
চব্বিশটি কারুকার্য মন্ডিত থাম বিশিষ্ট নাট মন্দিরে পাথরের নন্দীর মূর্তি।
পরিপাটি ব্যাবস্থা। বেশি ভিড়ের জন্য ব্যারিকেড করা সর্বত্র। মন্দিরের
বাইরের চত্ত্বরে ফুল মালা পুজার পসরা সাজিয়ে বসে আছে, তাদের মধ্যে থেকেই
খুঁজে চললাম গল্প যে গল্প সব দেবস্থানের নিজস্বতা গড়ে দেয়। এখানেও তেমনি
কিংবদন্তীর অভাব নেই।
শিবালয় সরোবর থেকেই এই জ্যোতিঃলিঙ্গ উদ্ভুত। ইলোরার স্থানীয় নাম ভেরুল। এই
ভেরুল ভারুল শব্দের অপভ্রংশ। ভারুল কথাটি এসেছে স্থানীয় ইয়ালা গঙ্গা নদীর
নাম থেকে।এখানে ইয়ালা নামে এক রাজা ছিলেন। স্থানীয় জঙ্গলে শিকারে এসে তিনি
এক মুনিপালিত পশুকে হত্যা করেন। অভিশাপ দেন মুনি। সারা দেহে পোকা আর তার
ক্ষত নিয়ে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে হয় তাঁকে। ঘুরতে ঘুরতে ঘোড়া খুরের আকারের
একটি জলের উৎস পান। যা থেকে জল পানে তার সব ক্ষত ও পোকা থেকে মুক্তি পান।
এরপর তিনি ওই স্থানে তপস্যা শুরু করেন। ব্রহ্মা তাঁর তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে
বর স্বরূপ ওই জায়গায় এক পবিত্র সরোবর নির্মাণ করেন। সেটিই পরবর্তী সময়ে
শিবালয় নামে পরিচিত হয়।
অন্য এক গল্প অনুযায়ী এই সরোবর তৈরি হয়েছে শিবের ত্রিশূলের আঘাতে। এক সময়
কৈলাশে দাবা খেলায় হেরে মহেশ্বর এই অঞ্চলে এসে বসবাস করতে শুরু করেন। তাঁর
মান ভাঙাতে পার্বতীও এখানে এসে হাজির। তারপর এই সব এলাকাজুড়ে তাঁদের
প্রেমের লীলাক্ষেত্র রচিত হয়। যার নাম হয় কাম্যকবন। এমনই কোনও দিনে
পার্বতীর তৃষা মেটাতে গিয়ে মহাদেব তৃশূলাঘাতে পাতাল থেকে তুলে আনেন
অমৃতবারি। সৃষ্টি হয় শিবালয়।
এই শিবালয়েই একদিন প্রসাধনের সময় পার্বতী জাফরান আর সিঁদুর হাতে নিয়ে ঘষতে
ঘষতে আকস্মিক তা সরোবরের মধ্য এক শিবলিঙ্গের আকার নেয়। সেই লিঙ্গই আজকের
ঘৃষনেশ্বর। হাতের ঘর্ষন থেকে উৎপন্ন তাই এই নাম। এছাড়া আরও একটি নাম
প্রচলিত ছিল, কুনকুমেশ্বর।
এই মন্দির বহুবার ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়ে গেছে মারাঠা আর মোগলদের বিবাদের
প্রেক্ষাপটে। শিবাজির দাদু মালজী ভোঁসলে ষোড়শ শতকে এটির পুনর্নির্মাণ করান
যা পরবর্তী সময়ে আবার ক্ষয়ক্ষতির সন্মুখিন হয়। শেষ নির্মাণ হয় ইন্দোরের
রানি অহল্যাবাই হোলকারের আমলে অষ্টাদশ শতাব্দীতে মুঘলদের পতনের পর। সেই
মন্দির আজো দাঁড়িয়ে অনেক ইতিহাস উপকথা আর স্মৃতি কথার সাক্ষি হয়ে। মন্দির
দেখে আর তার নানা রকমের গল্পের সাথে কল্পনায় ভাসতে ভাসতে আমরা হাঁটা দিলাম
ইলোরার গেটের উদ্দেশ্যে।
লেখকঃ অরুণোদয় কুণ্ডু
মোবাইলঃ 9830580357
ঠিকানাঃ 17/7/4 নরসিংহ দত্ত রোড, কদমতলা, হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, পিন – 711101।
17/7/4 Narasingha Dutta Road, kadamtala, Howrah, West Bengal, India,
pin-711101.