অরুণোদয় কুন্ডু
পুস্তক পরিচয়
ভোলগা থেকে গঙ্গা, রাহুল সাংকৃত্যায়ন
ইতিহাসের প্রতি একটা বিরক্তি, অনীহা ছেলেবেলা থেকেই ছিল। আমার মনে হয়
শুধু আমার একার নয় আরও অনেকেরই এই বিরক্তি রয়েছে। আসলে ইতিহাস বললেই যে
ভেসে ওঠে, পাতার পর পাতা নোটস, আর মুখস্থ করতে না পারলেই স্যারের থেকে
বকুনি খাওয়ার ভয়। ইতিহাসের ক্লাসে সব মুখস্থ করে গড়গড় করে বলতে পারা
কিছু ছেলেপিলে ছিল বটে, কিন্তু তাদের মত হতে হবে এ কথাটা কখনও মনে হয়নি।
পরে কলেজের সময়েও দেখেছি ইতিহাসকে বিষয় হিসাবে নেওয়ার প্রতি অনীহা।
ব্যতিক্রম সর্বত্রই থাকে কিন্তু সাধারণের কাছে বিষয়টা কেমন যেন একটা
মুখস্থ আর বোরিং লেখালিখির ব্যাপার হয়েই রয়ে গেছে। উল্টো দিকে আমরা সবাই
গল্প শুনতে ভালোবাসি, ঠাকুমার কাছে পুরাণের গল্প বা পুরনো উপকথার গল্পের
টানে রাত জাগা কোনও ব্যাপারই নয়।
হাল ফ্যাশনের লোকজনকে দেখুন ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট নিয়ে তৈরি সিনেমা ওয়েব
সিরিজ কিন্তু রমরমিয়ে চলে। ঘুরতে গিয়েও সেই তাজমহল, আগ্রা ফোর্ট, অজন্তা
বা খাজুরাহো নয়তো বা পিরামিড বা আঙ্করভাট কিংবা কলোসিয়াম বা পর্থেনন।
লোকের লাট লেগে যায় এই সব জায়গা দেখতে। তাহলে পড়ার বেলায় নীরস বলে নাক
সিঁটকানো, এদিকে অন্য সব দিকেই তাকে দরাজ ভাবে বুকে জড়িয়ে নেওয়া। এই
দ্বিচারিতা কেন? ইদানিং একটা বই আমাকে এই প্রশ্নের একটা সদুত্তর দিয়েছে।
বইটা অনেক দিনের হলেও আমি পড়লাম এখন। আর ইতিহাসের একটা নতুন জানালা যেন
খুলে গেল।
আসলে আমরা সবাই গল্প খুঁজি। জীবনের গল্প। পরিসংখ্যান নয়। ওইসব নীরস তথ্যের
দরকার থাকতে পারে বড়সড় পরিকল্পনায় বা কোনও কিছুকে বিশেষ ভাবে বোঝার
জন্য। কিন্তু সে'সব গম্ভীর ব্যপার। তাতে বিনোদন নেই। নেই উপলব্ধির সাগরে গা
ভাসানোর আনন্দ। তাই ভাসতে গেলে গল্পের ভেলাটা তো লাগবেই। সময়ের অন্তহীন
সমুদ্র কী আর সাঁতরে পেরোনো যায়। গল্পের ভেলা হলে তবু চেষ্টা করা যেতে
পারে। তেমনই ইতিহাসের সমুদ্র পেরোনোর একটা ভেলা থুড়ি জাহাজ বানিয়েছেন
রাহুল সাংকৃত্যায়ন।
সেই ভেলা ভোলগা নদীর তীরের কাঁচা মাংস খাওয়া আদিম মানুষ থেকে কোন অমোঘ
টানে আপনাকে বিংশ শতাব্দীর গঙ্গতটে এনে ফেলবে, আপনি ধরতেই পারবেন না। শুধু
প্রতি গল্পের উপরে দেওয়া সন তারিখ বলে যাবে,,,, সময় চলছে তার আপন গতিতে।
অতীতের কষ্ট কল্পনায় আঁকা চরিত্র গুলো যখন রক্ত মাংসের মানুষ হয়ে বইয়ের
পাতা থেকে আপনার মনের পথে ঘাটে চলাফেরা শুরু করবে, তখন ভাবুক মনে নিজেকে
সেই আদিম মানুষদের একজন মনে হতেই পারে। যেখানে পেটের খিদেটাই আসল।
কিন্তু মানুষ যে পশু নয়। তাই পেটের সাথে সাথে মনের খিদেটাও রয়েছে, রয়েছে
কামনা, ক্ষমতা দখলের ইচ্ছা। সেই ইচ্ছা আলাদা জায়গায় আলাদা ভাবে চলে, তাই
নিয়েই মতভেদ, যুদ্ধ, আর নতুন নতুন ভাবনায় নিজেকে আর নিজের চারপাশকে ভেঙে
গড়ে নেওয়ার চেষ্টা। সেখান থেকেই একে একে পাথর থেকে তামার পথ ধরে লোহার
যুগে আসা। আর্য অনার্য ভাবধারার সংঘাত আবার ধীরে ধীরে কালের নিয়মে মিলে
মিশে নতুন সংস্কৃতি তৈরি হতে দেখবেন অক্ষরে অক্ষরে।
দেখা মিলবে, মানুষ থেকে ইতিহাস আর লোককথার মোড়কে ঈশ্বর তৈরি হওয়ার
অধ্যায়ের। ক্ষমতাশালী মানুষের হাতে সেই দেবত্বের হাতিয়ার কিভাবে যুগে
যুগে শাসকের ইচ্ছায় রূপ বদল হয়েছে, খোঁজ মিলবে তারও। পুরাণ কিভাবে
ইতিহাসের সাথে কল্পনা মিশিয়ে গল্পের ছলে মানুষকে ওঠবস করায় তার একটা
জীবন্ত অধ্যায় দেখা যাবে গল্পে গল্পে।
একসময় পড়তে পড়তে মনে হতে পারে তাহলে ঠাকুর দেবতা সবটাই কি ভাওতা। তখন
একটা কথাই মনে রাখতে হবে ধর্ম আর আধ্যাত্মিকতার একটা সীমারেখা রয়েছে। সেই
সীমারেখা মুছে গেলেই পবিত্র আধ্যাত্মিকতার গায়ে লেগে যায়
সাম্প্রদায়িকতার কালি। আর সবকিছুতেই শেষ কথা বলে মানুষ। সেই কবিতা টা মনে
পড়ে যাচ্ছে, মানুষই দেবতা গড়ে তাহারই পূজার পরে, করে দেব মহিমা নির্ভর।
তাই মানুষের চিন্তা ভাবনা নিয়েই এই বই, ধর্মীয় ভাবনা বলার অবকাশ এখানে
নেই। ইতিহাসের গতিপথে যে সমস্ত চিন্তারা দিন বদলের ইঙ্গিত দিয়েছে, এনেছে
যুগান্তর সেই সব চিন্তাকেই কাহিনীর মালায় লেখক বেঁধেছেন দুই মলাটের মধ্যে।
সেখানে ইন্দ্রের অনার্য বিজয় যেমন এসেছে, তেমনই এসেছে আর্য অনার্যদের
যুদ্ধ প্রসঙ্গে রামের কথা, যে ঐতিহাসিক রাজার ছায়াতে রাম চরিত্র তৈরি তারও
দেখা মিলবে গল্পের ছলে।
ষোড়শ মহাজন পদ থেকে সার্বভৌম মৌর্য সাম্রাজ্য গড়ে ওঠা, আবার গুপ্ত যুগের
স্বর্ণালী অধ্যায়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকা নোংরামি আর কু সংস্কার মানুষের
মনে থিতু হয়ে বসা। অবশেষে মুসলিম আর ব্রিটিশ শাসনের যুগ। সব যুগের
প্রতিনিধিরাই এগিয়ে এসেছেন গল্পের চরিত্র হিসেবে। যুক্তি দিয়ে গেছেন
নিজেদের স্বপক্ষে। যা আপনাকে ভাবাবে, ইতিহাসের বই পড়ে যাকে ভিলেন মনে
হয়েছে কখনও তার প্রতি এনে দেবে একটুকরো সহানুভূতি, কখনও আবার রাগে ফেটে
পড়বেন কোনও ইতিহাসের নায়কের বিরুদ্ধে। সব মিলে এক অনন্য দৃষ্টিভঙ্গিতে
আপনার সামনে হাজির হবে পৃথিবী। ভাবনার এক নতুন জানালা খুলে দিয়ে যাবে,
একচোখো ইতিহাস পড়তে পড়তে হাঁফিয়ে ওঠা ভাবুক পাঠকের মনে।