টরন্টো, ২৬শে অক্টোবর, ২০২৩, নভো সংখ্যা ৪০
              
হোমপেজ সম্পাদকীয় পাঠক পরিষদের কথা কবিতা ছোট গল্প ধারাবাহিক সাহিত্য সংবাদ ভ্রমণ কাহিনি নিবন্ধ প্রেমপত্র বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রকৌশল আবৃত্তি / কণ্ঠসঙ্গীত পাঠাগার আর্কাইভ লেখক পরিচিতি যোগাযোগ

কার্তিকের কুয়াশা

বাংলা চতুর্দশপদী কবিতায় রাইম স্কিম

 

 

 

-সাইদুজ্জামান

 

চতুর্দশপদী কবিতার মধ্যে এক আভিজাত্য আছে বলেই হয়ত মধুসূদন দত্ত থেকে শুরু করে আল মাহমুদ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সৈয়দ সামসুল হক পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য অনেক কবিই চতুর্দশপদী কবিতা লিখেছেন । নবীন কবিরাও লিখছেন, চেষ্টা করছেন । নিয়ম কানুনের অনুশাসন বেশি বলেই সনেট লেখা চ্যালেঞ্জিং । আর চ্যালেঞ্জিং বলেই আমরা আকর্ষণটাও বেশি অনুভব করি, আমার মনে হয় ।
বাংলা চতুর্দশপদী কবিতা অক্ষরবৃত্ত ছন্দেই রচিত হয় । মিল বিন্যাসেরও আছে বিশেষ কিছু নিয়ম, মাত্রার দিক থেকে দেখলেও ধারনা করছি আদর্শ সনেট ১৪ (৮+৬) মাত্রায়ই লেখা হলেও ১৮ মাত্রায় (৮+১০ অথবা ১০+৮) চরণের সনেটই আমার চোখে পড়েছে বেশি। এতো গেল ছন্দের কথা, কাঠামোর কথা। বিষয়বস্তু পরিবেশনেরও বিশেষ নিয়ম আছে । আদর্শ সনেটে কবি প্রথম ৮ চরণে একটা ভাব প্রকাশ করেন এবং পরের ৬ চরণে তার বিশ্লেষণ দেন। এক স্তবক থেকে অন্য স্তবকে অনুপ্রবেশও একটি নিয়ম মেনেই হবার কথা । এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন সনেটকে এই আট চরণের একটি স্তবক (অষ্টক) এবং ছয় চরণের আরেকটি স্তবকে (ষটক) বিভক্ত না করে জুড়ে লেখাই বেশি চোখে পড়ে । আর মিল বিন্যাস ছন্দকে প্রভাবিত করলেও যেহেতু ছন্দের প্রধান অংশ নয়, তাই মিল বিন্যাসকে অনেক ক্ষেত্রেই উপেক্ষা করতে দেখা যায়, আমার মনে হয় । তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি মিল বিন্যাসের পক্ষেই ওকালতি করব ।
অক্ষরবৃত্ত বা মিশ্রবৃত্ত ছন্দে রুদ্ধদল স্থান বিশেষে কখনো ২ মাত্রা আবার কখনো ১ মাত্রা বহন করে । অক্ষরবৃত্ত ছন্দে রুদ্ধদল শব্দের শেষে থাকলে ২ মাত্রা, তবে শব্দের প্রথমে বা মাঝখানে থাকলে ১ মাত্রা। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন মিশ্রকলাবৃত্ত ছন্দের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ-সহ বহু কবিই যুক্তবর্ণে লেখা অপ্রান্তিক (অর্থাৎ শব্দের প্রথমে বা মাঝে ব্যবহৃত) রুদ্ধদল এককলারূপে গণ্য করলেও অযুক্তবর্ণে লেখা অনুরূপ রুদ্ধদল অধিকাংশক্ষেত্রে দুইকলারূপে ধরেছেন। তার ফলে উচ্চারণ কিছুটা বিশ্লিষ্ট, শিথিল হয়ে পড়েছে।
অক্ষর বৃত্তে প্রতি পর্বে শুধু জোড় মাত্রাই চলে যেমন ৪, ৬, ৮, ১০ ইত্যাদি।
রাইম (অন্ত্যমিল) এবং রিদম (ছন্দ) এক নয় বুঝেও অনেক পাঠক চরণশেষে মিল দেখলেই ধরে নেন এ ছন্দোবদ্ধ কবিতা । কথাটা ঠিক নয় । আবার এও বলেছি মিল বিন্যাস ছন্দের উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে সক্ষম।
সনেটে বহুলব্যবহৃত তিনটি রাইম স্কিম নিয়ে দুকথা লিখতেই এতো কথা এসে পড়লো ।
পেত্রার্কীয় সনেটে প্রথম আট লাইনের স্তবকটির (অষ্টক) মিল বিন্যাস এরকম – ABBAABBA; পরবর্তী ছয়লাইনের স্তবকটি্র (ষটক) মিল বিন্যাস এরকম - CDCDCD অথবা CDECDE. অর্থাৎ প্রথম আট লাইনের ক্ষেত্রে – প্রথম চরণের শেষের শব্দটির সাথে চতুর্থ চরণের শেষের শব্দটির ধ্বনিগত মিল থাকবে । দ্বিতীয় চরণের শেষের শব্দটির সাথে তৃতীয় চরণের শেষের শব্দটির ধ্বনিগত মিল থাকবে । অনুরূপভাবে পঞ্চম চরণের শেষের শব্দটির সাথে অষ্টম চরণের শেষের শব্দটির ধ্বনিগত মিল থাকবে ।ষষ্ট চরণের শেষের শব্দটির সাথে সপ্তম চরণের শেষের শব্দটির ধ্বনিগত মিল থাকবে ।
পরবর্তী ছয় লাইনের স্তবকটি্র (ষটক) মিল বিন্যাস এরকম - CDCDCD অথবা CDECDE. অর্থাৎ (CDCDCD ) নবম চরণের শেষের শব্দটির সাথে একাদশ চরণের শেষের শব্দটির ধ্বনিগত মিল থাকবে । দশম চরণের শেষের শব্দটির সাথে দ্বাদশ চরণের শেষের শব্দটির ধ্বনিগত মিল থাকবে । একাদশ চরণের শেষের শব্দটির সাথে ত্রয়োদশ চরণের শেষের শব্দটির ধ্বনিগত মিল থাকবে । দ্বাদশ চরণের শেষের শব্দটির সাথে চতুর্দশ চরণের শেষের শব্দটির ধ্বনিগত মিল থাকবে ।
অথবা CDECDE অর্থাৎ নবম চরণের শেষের শব্দটির সাথে দ্বাদশ চরণের শেষের শব্দটির ধ্বনিগত মিল থাকবে । দশম চরণের শেষের শব্দটির সাথে ত্রয়োদশ চরণের শেষের শব্দটির ধ্বনিগত মিল থাকবে । একাদশ চরণের শেষের শব্দটির সাথে চতুর্দশ চরণের শেষের শব্দটির ধ্বনিগত মিল থাকবে ।
একটি উদাহরণ - ABBAABBA; CDECDE
চেরিপুষ্প
-প্রমথ চৌধুরী
বসন্তের আগমনে আজো আছে দেরি,
পর্বতের স্তরে স্তরে বিরাজে তুষার |
চুরি ক’রে ফিকে রঙ গোলাপী ঊষার,
লাজ মুখে ফুটিয়াছে ঝাঁকে ঝাঁকে চেরি
পত্রহীন শাখাগুলি ফেলিয়াছ ঘেরি,
বষিয়া তাহার অঙ্গে কুঙ্কুম আসার |
সে জানে, যে বোঝে অর্থ ফুলের ভাষার,
বসন্তের ঘোষণার তুমি রত্নভেরি!
মর্মর-কঠিন-শুভ্র তুষারের গায়ে
পড়েছে রূপের তব রঙিন আলোক,
পূর্বরাগে লিপ্ত তব কর-পরশনে,
শিশিরে বসন্ত-স্মৃতি তুলেছে জাগায়ে |
রক্তিম আভায় যেন ভরিয়া ত্রিলোক
শোভিছে উমার মুখ শিব-দরশনে ||
শেক্সপীরীয় সনেট তিনটি চতুষ্ক এবং সর্ব শেষে একটি দ্বিপদী নিয়ে গঠিত হয় . মিল বিন্যাস এরকম – ABAB CDCD EFEF GG
কেন?
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কেন গো এমন স্বরে বাজে তবে বাঁশি,
মধুর সুন্দর রূপে কেঁদে ওঠে হিয়া,
রাঙা অধরের কোণে হেরি মধু হাসি
পুলকে যৌবন কেন উঠে বিকশিয়া!
কেন তনু বাহু ডোরে ধরা দিতে চায়,
ধায় প্রাণ, ছুটি কালো আঁখির উদ্দেশে,
হায় যদি এত লাজ কথায় কথায়,
হায় যদি এত শ্রান্তি নিমেষে নিমেষে!
কেন কাছে ডাকে যদি মাঝে অন্তরাল,
কেন রে কাঁদায় প্রাণ সবি যদি ছায়া,
আজ হাতে তুলে নিয়ে ফেলে দিবে কাল
এরি তরে এত তৃষ্ণা, এ কাহার মায়া!
মানব হৃদয় নিয়ে এত অবহেলা,
খেলা যদি, কেন হেন মর্ম্মভেদী খেলা!
ফরাসী সনেটে প্রথম আট লাইনের স্তবকটির (অষ্টক) মিল বিন্যাস এরকম – ABBAABBA; পরবর্তী ছয় লাইনের স্তবকটি্র (ষটক) মিল বিন্যাস এরকম - CCDEDE অথবা CCDCCD অথবা CCDEED.
নবম এবং দশম লাইন দুটো স্তবক থেকে স্তবকে অনুপ্রবেশের সেতুর মত কাজ করে | এখানে ষটকের প্রথম দুই লাইন দ্বিপদী | প্রমথ চৌধুরী
অন্বেষণ
- প্রমথ চৌধুরী
আজিও জানিনে আমি হেথায় কি চাই!
কখনো রূপেতে খুঁজি নয়ন উৎসব,
পিপাসা মিটাতে চাই ফুলের আসব,
কভু বসি যোগাসনে, অঙ্গে মেখে ছাই॥

কখনো বিজ্ঞানে করি প্রকৃতি যাচাই,
খুঁজি তারে যার গর্ভে জগৎ প্রসব,
পূজা করি নির্ব্বিচারে শিব কি কেশব,—
আজিও জানিনে আমি তাহে কিবা পাই॥

রূপের মাঝারে চাহি অরূপ দর্শন।
অঙ্গের মাঝারে মাগি অনঙ্গস্পর্শন॥

খোঁজা জানি নষ্ট করা সময় বৃথায়,—
দূর তবে কাছে আসে, কাছে যবে দূর।
বিশ্রাম পায় না মন পরের কথায়,
অবিশ্রান্ত খুঁজি তাই অনাহত-সুর॥
বি দ্র যেসব অনুসন্ধিৎসু পাঠক কবিতার নিয়মকানুন জেনে-বুঝে কবিতা লিখতে চাইছেন তাঁদের উদ্দেশ্যে একটি সতর্কবাণী – মনে রাখবেন আপনি যত প্রস্তুতিই নিন না কেন, আপনার চারপাশে গাছের মত দাঁড়িয়ে আছেন অসংখ্য মাস্টারমশাই। এইসব মাস্টারমশাইরা নিজেরা তো নট নড়নচড়ন, তবে আপনাকে দমিয়ে রাখার সব চেষ্টা করবেন ।
টরন্টো, ডিসেম্বর ২২, ২০২২