টরন্টো, ২৬শে অক্টোবর, ২০২৩, নভো সংখ্যা ৪০ 
              
হোমপেজ সম্পাদকীয় পাঠক পরিষদের কথা কবিতা ছোট গল্প ধারাবাহিক সাহিত্য সংবাদ ভ্রমণ কাহিনি নিবন্ধ প্রেমপত্র বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রকৌশল আবৃত্তি / কণ্ঠসঙ্গীত পাঠাগার আর্কাইভ লেখক পরিচিতি যোগাযোগ

কার্তিকের কুয়াশা

জলে বিজলি

এ কে এম সাইদুজ্জামান, পি এইচ ডি, পি এন্জ




শিল্প-কারখানায় ব্যবহারযোগ্য পানি সরবরাহের উৎস হিসেবে পৌর বর্জ্য পানি একটি মূল্যবান সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হলেও পানি প্রকৌশলের এই গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে পৌর–বর্জ্য পানির নতুন নতুন সমস্যা প্রতিনিয়ত উপস্থাপিত হচ্ছে । পৌর–বর্জ্য পানি অথবা গার্হস্থ্য বর্জ্য পানি বলতে বুঝতে হবে পয়ঃবর্জ্য (টয়লেট, স্নানাগার থেকে নিষ্কাশিত পানি) এবং গৃহস্থালির কাজে ব্যবহৃত পানি যেমন রান্নাঘরে ব্যবহৃত পানি, কাপড় ধোয়ায় ব্যবহৃত পানি ইত্যাদি। খাল-বিল, নদী-নালা, সমুদ্র এবং ভূগর্ভস্থ পানি সংগ্রহ এবং শোধন করে ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া অর্থাৎ পানি সরবরাহ যেমন আছে, তেমনি এই পানি ব্যবহারের পর তার সুষ্ঠ নিষ্কাশন, শোধন এবং অপসারণ (নদী-নালা, খাল-বিল, সমুদ্রে ফেরৎ পাঠানো) অর্থাৎ “পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা” আছে। এ প্রসঙ্গে "পানি সরবরাহ ব্যবস্থা" এবং “পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা” - এদুটির সংজ্ঞা তুলে ধরি। “পানি সরবরাহ ব্যবস্থা” অর্থ পানি সংগ্রহ, শোধন, পাম্পিং, সঞ্চয় এবং সরবরাহ করার ব্যবস্থা। “পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা” অর্থ স্বাস্থ্য, পয়ঃ এবং শিল্পবর্জ্য সংগ্রহ, পাম্পিং, শোধন এবং অপসারণের জন্য সর্বপ্রকার পয়ঃপ্রণালীর ব্যবস্থা ।
যাহোক, যা বলতে শুরু করেছিলাম, সাম্প্রতিক কাল অবধিও, বিদ্যুৎ উৎপাদন খুব সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল কারণ এখানে প্রযুক্তিগত প্রক্রিয়ার জন্য পানি সরবরাহ হিসেবে উচ্চ মানের প্রাকৃতিক পানি ব্যবহৃত হতো। এই সুবিধাজনক অবস্থান রক্ষার সহায়ক ভূমিকা পালন করে বাষ্প এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের অপারেটিং শর্তসমূহ।  সক্রিয়তার এই শর্তগুলিই মূলত সৃষ্টি করে  তীব্র উত্তাপ এবং অপদ্রব্যের উচ্চ সমাহরণ। সুতরাং, পৌর–বর্জ্য পানি পরিশোধন এবং তৃতীয় স্তরের পরিশোধনের ক্ষেত্রে বৃহত্তর গবেষণা থাকা সত্ত্বেও, তাপ এবং পারমাণবিক শক্তি কেন্দ্রগুলিতে এই পরিশোধিত পানি ব্যবহারের সম্ভাবনাগুলি আগে সেরকম অধ্যয়ন করা হয়নি।
শিল্পের বিকাশে এবং প্রাত্যহিক গৃহকার্যে ব্যবহারযোগ্য পানি সরবরাহের চাহিদা বৃদ্ধির ফলে জেনারেশন স্টেশনগুলি থেকে নিঃসৃত পানির পরিমাণ যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে; বিশেষত তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলি শহরের মোট পানি সরবরাহ ব্যালেন্সের ৫০% থেকে ৮০% অবদান রাখছে । প্রাকৃতিক মিষ্টি পানির উৎসের উপর ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে তাপ ও পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে পরিশোধিত পৌর–বর্জ্য পানি ব্যবহার করার কাজ আরও জরুরি হয়ে পড়েছে। বলতেই হয় যে নগর পানিশোধন কেন্দ্রগুলিতে ব্যাপকভাবে পৌর–বর্জ্য পানির অপর্যাপ্ত স্তরীয় পরিশোধন প্রক্রিয়া এবং অবশিষ্টাংশ অপসারণের জন্য ব্যবহৃত রাসায়নিক প্রক্রিয়া গুলিতে উপযুক্ত পানিশোধন প্রক্রিয়া না থাকায় বিদ্যুৎ উৎপাদন শিল্প এখনও এই পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত নয়। উপরোল্লিখিত বিষয়গুলির পাশাপাশি আরও একটি মনস্তাত্ত্বিক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে - বিদ্যুৎ প্রকৌশলীরা পৌর–বর্জ্য পানির গঠন এবং বৈশিষ্ট্য অথবা পরিশোধনের ব্যাপকতা সম্বন্ধে সম্যক ধারণা রাখেন না। এছাড়াও রয়েছে, পৌর–বর্জ্য পানি ব্যবহারে স্বাস্থ্যগত নির্নায়ক বা স্বাস্থ্যগত মানদণ্ডের একধরণের নির্বিচার ব্যাখ্যা। এই ঘাটতিগুলি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চিন্তাভাবনা এবং সংকীর্ণ মনোভাবের কারণে সংঘটিত হয়। পাশাপাশি পানি যে কেবল একটি কাঁচামালই নয়, জীবন সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় প্রকৃতির এক অমূল্য সৃষ্টি এই সত্য উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হওয়াও অন্যতম প্রধান কারণ। এই সমস্যা সমাধানের কাজটি প্রায়শই অন্যান্য শিল্পের কাঁধে চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করা হয়। বিদ্যুৎ উৎপাদনই যে সমস্ত শিল্প –কারখানার মধ্যে সবচেয়ে বড় পানির গ্রাহক – এই সত্যটিকে উপেক্ষা করা হয়। এই সমস্ত কারণে অন্য অনেক কিছুর সাথে সাথে বৈদেশিক অনুশীলন থেকে বাংলাদেশ পিছনে পড়ে আছে যেখানে (বিদেশে) কিনা তাপ এবং পারমাণবিক শক্তি কেন্দ্রে পরিশোধিত পৌর–বর্জ্য পানি ব্যবহারে অনেক বছরের অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়ে আছে।
এটি খুব তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় যে, এখন পর্যন্ত, বাংলাদেশে একটিও বিদ্যুৎ কেন্দ্র নেই যেখানে পরিশোধিত পৌর–বর্জ্য পানি ব্যবহার করা হয়। আমার ধারাবাহিক এই রচনায় তাপ এবং পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলিতে পৌর – বর্জ্য পানি ব্যবহারের গুরুত্ব এবং অসুবিধা আলোচনা করা হবে। প্রকৃত প্রযুক্তিগত বিবিধ নকশা এবং শিল্পভিত্তিক অভিজ্ঞতাগুলি উদাহরণের মাধ্যমে আলোচনা করা হবে। পৌর – বর্জ্য পানি ব্যবহারের প্রবর্তনকে ত্বরান্বিত করার প্রয়োজনীয়তা এবং সম্ভাবনা নিয়েও  বিস্তারিত     আলোচনা করা হবে।
পৌর বর্জ্য পানিতে বিভিন্ন ধরণের অপদ্রব্যের উপস্থিতিই এই পানিকে প্রাকৃতিক পানি থেকে পৃথক করে রেখেছে । উপরোল্লিখিত বিষয়টি পানি পরিশোধন এবং কন্ডিশনিং এ প্রচলিত প্রযুক্তিতে পরিবর্তন এবং তঞ্চন, পরিস্রাবণ, শোষণ, আয়ন বিনিময় এবং পাতনের প্রচলিত প্রক্রিয়াগুলিতে নতুন ভাবে পরিবর্তন ও প্রসারের দাবি করে।
আমার "বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলিতে জল সরবরাহ ব্যবস্থায় পৌর বর্জ্য জল ব্যবহার করার সময়" -র পর্যালোচনায় স্যানিটারি এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিবেচনা প্রসঙ্গে বিশেষভাবে মনোযোগ দেওয়া হবে। সেখানে বিভিন্ন সিস্টেমের যথাযথ শ্রেণিবদ্ধকরণ এবং প্রতিটি সিস্টেমের পরিশোধন মানদণ্ডের পছন্দকে সমর্থন করার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় মহামারী ও অগতান্ত্রিক (টক্সিকোলজিক্যাল ) নিরাপত্তা অর্জনের পদ্ধতিগুলি নিয়ে আলোচনা করা হবে । আয়ুর্বেদে একটি আলাদা বিভাগই ছিল “অগদতন্ত্র” নামে, যা আজকে Toxicology নামে পরিচিত।


(পূর্বপ্রকাশিতের পর) Back to Top

পৃথিবীতে মোট পানিসম্পদের পরিমাণ ১৩৮৬ মিলিয়ন ঘনকিলোমিটার। কেবল ২.৫%, অর্থাৎ, ৩৫ মিলিয়ন ঘনকিলোমিটার, স্বাদু পানি; বাকি ৯৭.৫ % হ'ল বিশ্বের মহাসাগর, লবণের হ্রদ এবং লবণাক্ত ভূগর্ভস্থ খনিজযুক্ত জলাশয়। কেউ হয়তো ভাববেন যে মিঠা পানির এই মজুদগুলি যথেষ্ট পর্যাপ্ত হবার কথা বিশ্ব জনসংখ্যার মাথাপিছু প্রায় ৮ মিলিয়ন ঘনমিটার, তবে পানির এই বৃহৎ অংশটুকু কার্যত অকেজো। প্রায় ৭০% হিমবাহে আবদ্ধ, প্রায় ৩০% ভূগর্ভে এবং মাত্র ০.০০৬% বিশ্বের নদীতে পাওয়া যায়। পরিস্থিতিটি এমনই জটিল যে স্বাদু পানির এই সামান্য পরিমাণও সমানভাবে ছড়িয়ে নেই পৃথিবী জুড়ে।

আজকাল প্রায় ৬০% শুকনো জমিই শুষ্ক (বৃষ্টিপাতহীন) ও আধা শুষ্ক এবং ফলস্বরূপ, কিছু দেশ সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে মিঠা পানি থেকে বঞ্চিত; এইসব দেশের ভেতর অন্তর্ভুক্ত সৌদি আরব, চিলি, কুয়েত, মেক্সিকো এবং আফ্রিকার উত্তরের দেশগুলি।


যদিও বাংলাদেশে সাধারণত মিঠা পানির ভালো সরবরাহই আছে, নদীর পানি এতই দূষিত যে তাকে আর স্বাদু পানি বলা যায় না। সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায়ও স্বাদু পানির সংকট তীব্রভাবেই অনুভূত হয়।

সুতরাং, বিশ্বের অনেক দেশের জন্য, এবং বাংলাদেশেরও বিভিন্ন অঞ্চলে জল সরবরাহ ইতোমধ্যে শিল্প ও কৃষি বিকাশের সমস্যা সমাধানের সময় এক নির্ধারক হয়ে উঠেছে। সীমাবদ্ধ মিঠা পানির সংস্থান, পানি সরবরাহের নতুন উৎস অনুসন্ধানকে প্রায় অপরিহার্য করে তুলছে । বর্তমানে এটি একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা।

পানি সম্পদ খনিজায়ন বৃদ্ধির কারণেও পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে। প্রতি বছর মিলিয়ন মিলিয়ন ঘনমিটার শিল্পবর্জ্য ও গার্হস্থ্য বর্জ্য জলাশয়ে নিষ্কাশন করা হয় এবং তা রাসায়নিকভাবে নিষ্ক্রিয় বা প্রশমিত করতে পাঁচ থেকে বারো গুন স্বাদু পানির দরকার হয়। সুতরাং, একদিকে, সীমাবদ্ধ মিঠা পানির সংস্থান এবং অন্যদিকে, তাদের ব্যাপক দূষণের কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে মিঠা পানির যথেষ্ট ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
নতুন নতুন জলের উৎ্স অনুসন্ধান কেবল শুষ্ক অঞ্চলগুলিতেই শুধু জরুরি নয়, ঘনবসতিযুক্ত শিল্প অঞ্চলেও জরুরি, যেখানে আরও বেশি জলের ব্যবহার এবং দূষণ ঘটে। জল সরবরাহের এ সমস্যার দীর্ঘমেয়াদী সমাধানগুলোর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ পথ দুটি হলো বিলবণীকরণ এবং গার্হস্থ্য ও শিল্প বর্জ্যজলের পুনঃব্যবহার। বিশ্বে বিলবণীকরণ প্রক্রিয়ায় পানি বিশোধনের ক্ষমতা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে - বছরে প্রায় ১৮%। বিলবণীকরণের ব্যয় গত ২৫ বছরে পাঁচ ছয় গুন হ্রাস পেয়েছে এবং উন্নয়নের এই ক্ষেত্রে কাজ এখনও অব্যাহত আছে। খনিজযুক্ত জলের বিলবণীকরণ প্রক্রিয়াটির উত্তরোত্তর উন্নয়ন এবং বিকাশ উপকূলীয় অঞ্চল বা যেসব অঞ্চলগুলিতে লবণাক্ত ভূগর্ভস্থ জলের যথেষ্ট পরিমাণে অস্তিত্ব পাওয়া যায়, সেখানে মিঠা পানির ঘাটতি হ্রাস করবে। তবে বর্তমানে বিলবণীকরণ প্রক্রিয়ায় বিশোধিত পানি বিশ্বের মোট পানি সরবরাহের মাত্র ০.০৫ % অবদান রাখে।

বৃহৎ আধুনিক শহরগুলিতে, যেখানে প্রতিদিনের পানির ব্যবহার শত শত হাজার, কোথাও কোথাও এমনকি মিলিয়ন মিলিয়ন ঘনমিটার হয়ে থাকে, সেখানে পৌর বর্জ্যজলের পুনঃব্যবহারের বিকল্প নেই। আয়তন এবং সুস্থিত অবস্থার কারণে পৌর বর্জ্যজলকে একটি নির্ভরযোগ্য উৎস হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
এখন অবধি, পরিশোধিত পৌর বর্জ্যজল প্রধানত শীতলীকরণ ব্যবস্থায়ই ব্যবহৃত হয়েছে, কিন্তু সেগুলি অন্যান্য প্রযুক্তিগত উদ্দেশ্যেও ক্রমবর্ধমানভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, পরিশোধন করা বর্জ্য জলের উল্লেখযোগ্য পুনঃব্যবহার এখন চলছে দক্ষিন আফ্রিকায়। ভারতে বর্জ্য জল কুলিং সিস্টেম এবং বয়লার উভয় স্থানেই ব্যবহৃত হয় শিল্প কারখানায়। ভারতের প্রথম বর্জ্য জল পুনঃব্যবহারের জন্য শোধনাগারগুলিতে বর্জ্য জলের ব্যবহার ছিল প্রায় দিনপ্রতি ৪৫০০ ঘনমিটার। জাপানে তীব্র মিষ্টি পানির ঘাটতির কারণে ব্যাপকভাবে পরিশোধিত বর্জ্য জল ব্যবহারের পরিকল্পনা করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ২০০২ সালের এক হিসাব অনুযায়ী দিনপ্রতি ১.৭ বিলিয়ন গ্যালন (৬,৪০০,০০ ঘনমিটার)পরিশোধিত বর্জ্য জল ব্যবহৃত হয়েছিল।

চলবে .. .