টরন্টো, ২৬শে অক্টোবর, ২০২৩, নভো সংখ্যা ৪০  
              
হোমপেজ সম্পাদকীয় পাঠক পরিষদের কথা কবিতা ছোট গল্প ধারাবাহিক সাহিত্য সংবাদ ভ্রমণ কাহিনি নিবন্ধ প্রেমপত্র বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রকৌশল আবৃত্তি / কণ্ঠসঙ্গীত পাঠাগার আর্কাইভ লেখক পরিচিতি যোগাযোগ

কার্তিকের কুয়াশা

 

গল্পের পাতা 

 

 

 

 

 

 ✍ জাহিদা মেহেরুন্নেসার  গল্প 

নীল শার্ট

 

মানুষ যে মানুষকে অপমান করার জন্য, ছোট করার জন্য, আঘাত করার জন্য, অপদস্ত করার জন্য কত রকমের অস্ত্রে শান দেয় তা আর নতুন করে বলার কী ই বা আছে!
চন্দনা রহমান তার বন্ধু পারভীন আক্তারকে সাথে নিয়ে তার স্বামীর অফিসের গাড়িতে করে একটি শপিংমলে সার্ট কিনতে আসে । দুজনেই একই অফিসে চাকরি করে ।
পারভীন আক্তার যদিও চন্দনা রহমানের ঘনিষ্ট বন্ধু তবুও স্বামীর ব্যাপারটিতে চন্দনা রহমানের নাকটি সব সময়ই অনেক উঁচু । আর উঁচু হবে নাই বা কেন ?
চন্দনা রহমানের স্বামীর আয় রোজগার অনেক বেশি । তার উপরে অফিসের একটি গাড়ি দিনরাত চব্বিশ ঘন্টা চন্দনার পেছনে সার্ভিস দেয়। এমন কী দুজনের অফিসেরও সময় সময় বিভিন্ন কাজে লাগে । এতে চন্দনা রহমান যদি একটু অহংকার করেনই তা তো করতেই পারেন । তাতে পারভীন আক্তারের এত গায়েই বা লাগে কেন? চন্দনা রহমান তো কিছুমাত্র কম করেন না কারো জন্য । পারভীন আক্তারের স্বামী তো আর তেমন কিছু না ।
দুজনেই দোকানে এসে হালকা কালারের দুটো শার্ট পছন্দ করেন ।
চন্দনা পারভীনকে বলেন,
: দেখ আমার হাসব্যান্ড তো অফিসের এক্সিকিঊটিভ বস, এই কালারটি ওকে মানাবে । আমি এটা ওর জন্য নেবো । তুই দেখ অন্য কোনটা নিবি। বুঝিস তো বসদের ব্যাপারটাই অন্য রকম । এক্সিকিউটিভদের এ রকম শার্ট মানায়। ভাই তো আর এক্সিকিউটিভ না।
পারভীন আক্তারের বুকের কোথায় যেন কী একটা বিদ্ধ হয় । অনেক কষ্ট হয় । মনে হয় বিষকাঁটা ঢুকছে কোথাও । সে চন্দনা রহমানের কথাগুলোর অর্থ বোঝে ।
মনে হয় পারভীনের বুকের মধ্য অসংখ্য ভিমরুল হুল ফোটাচ্ছে । নানাবাড়িতে একবার ভিমরুলের আক্রমণের শিকার হয়ে সে বেঁচে গিয়েছিল । এবার বাঁচাটা খুব জরুরী । সে শপিংমল থেকে সোজা বাসার দিকে পা বাড়ায় । পিছনে কোলাহলমুখর শপিংমলে ঝুলতে থাকে এক্সিকিউটিভদের জন্য হালকা নীল রঙের শার্ট ।

 

 

 

 

✍ রত্না চক্রবর্তীর গল্প  

 

ধাই মা
 

৩.১০.২৩
এই ঘটনাটা যিনি আমায় বলেছিলেন তিনি একজন বুড়ি মানুষ তখনই তার অনেক বয়সে তারও আগেকার কথা কিন্তু গল্পটি ভারী সুন্দর আমার খুব ভাল লেগেছিল এরমধ্যে একটি গভীর কথা আমায় খুব নাড়া দিয়েছিল।
সে যুগে ছেলেমেয়েরা বাচ্চা হতে হাসপাতালে নার্সিংহোমে যেতো না। নার্সিংহোমের অস্তিত্বই ছিল না। হাসপাতাল ছিল শহরে। গ্রামেগঞ্জে এত স্বাস্থ্যকেন্দ্র গড়ে ওঠেনি। সদর হাসপাতাল গড়ে উঠেছিল সদরে সদরে। কিন্তু গ্রামেগঞ্জের মধ্যে বড় একটা চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল না। বাচ্চাকাচ্চা হতো ঘরে ঘরে এবং এখনকার থেকে সংখ্যায় অনেক বেশিই হত কিন্তু প্রসব করাতেন ধাত্রীমা, ধাইবমা চলতি কথায় দাই মা। এই দাইমাদের কোন শিক্ষাগত যোগ্যতা বা ট্রেনিং ছিল না। বেশীর ভাগই বংশগত ভাবে এই দাইয়ের কাজ করতেন।
এবং খুব আশ্চর্যের কথা যুগ যুগ ধরে এভাবে বাচ্চা প্রসব করাতে করাতে তাদের এত অভিজ্ঞতা হয়ে যেত যে তারা যার বাচ্চা হবে অর্থাৎ পেটের নাভি দেখে বুঝতে পারতেন তার মেয়ে হবে না ছেলে হবে, কিভাবে হবে, কোনো জটিলতা থাকলে আগেভাগে বলে দিতেন যে "সদরে নে যাও। " মৃত্যুর হার তাদের হাতে খুবই কম ছিল। শিশু মৃত্যুর হার অনেক ছিল অবশ্য কিন্তু প্রসব করাতে গিয়ে মারা গেছে এমন ঘটনা খুবই কম হতো।
কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের কথা সমাজের তাদের কোন সম্মান ছিলনা। প্রথম দিকে ছিল কিনা বলতে পারবো না। কিন্তু যে যুগের ঘটনা আমি শুনছি সে যুগে "নাড়িকাটা দাই "বলে তাদের ছোট করা হতো. গল্পের এই জায়গাটাই আমাকে খুব ব্যথা দিয়েছিল। বাচ্চাদের যারা জন্ম দিতে সাহায্য করেন, শিশুকে পৃথিবীর আলো দেখান তাদের তো ভগবানের জায়গা দেওয়ার কথা! কিন্তু তারা "দুই হাতে নোংরা ঘাটে" এই কথা বলে তাদেরকে প্রায় অছ্যুৎ করে রাখা হত সমাজে। তাদের হাতে জল খেত না কেউ। সমাজে হেয় করা হতো তাদের। অথচ মানুষের সেই বিপদের দিনে তারাই তো ছিল ত্রাতা, তাদের অপমান করার কোন অধিকার নেই সমাজের। আমি এই বছর তিনেক আগেও এক তথাকথিত লেখাপড়া জানা, ভদ্র বলে পরিচিত এক পুরোহিত পরিবারে শুনেছি ছেলের নিজে পছন্দ বিয়েতে তারা প্রচন্ড বিরোধিতা করছেন কারণ পাত্রীর দিদিমা একসময় দাই ছিলেন! ঘেন্নার সঙ্গে কথাটা উচ্চারণ করেছিলেন তারা আর তাদের প্রতি ঘেন্নায় আমি গুটিয়ে গিয়েছিলাম। আমরা তো নার্স
ডাক্তারদের শ্রদ্ধা করি তবে এদের উপর এমন অবিচার কেন?
যাইহোক আমি মনের দুঃখে রাগে একটু অন্যপথে চলে গিয়েছিলাম, এটা আসলে একটি ভৌতিক ঘটনা, ব্যক্তিগত সামাজিক মতপ্রকাশের নয়।
তা এমনই এক দাই ছিলেন সরলা। সরলার কিন্তু অবস্থা খুব ভাল ছিল। ঘরে ঘরে যেমন ছেলেপুলে হতো আর এরা যখন বিপদে দরকারি বলে বিবেচিত হতেন তখন মোটাটাকা জামাকাপড় (সে যুগের মানদণ্ডে অবশ্য) দিতে হতো। এছাড়া তেমন জমিদারবাড়ি বড়লোকের বাচ্চাকাচ্চা হলে সোনাও উপহার পেতেন । সোনার আংটি সোনার কানের দুল এমনসব উপহার পেতেন। তবে দূর থেকে দেওয়া দান দাক্ষিণ্য , মানসম্মান দিত না কেউ।
সরলা বেশ খানিকটা জমি নিয়ে পাকা বাড়ি বানিয়ে ছিল। মস্ত বড় দালান,সেটাও ঘেরা। তার সন্তান সংখ্যাও কম দুটি মাত্র মেয়ে হয়েছিল। অনেককাল আগে বড়টা টাইফয়েড হয়ে মারা গেছে। ছোট মেয়েটিকে সে লেখাপড়া শেখাচ্ছে। লেখাপড়া তখন চল হয়েছিল তবে বড়লোক বা অভিজাত ঘরে যতদূর লেখাপড়া করতো এসব সাধারণ ঘরের তার থেকে কম করত। কিন্তু সরলার ইচ্ছে ছিল তার মেয়ে ভালো লেখাপড়া শিখবে, এরকম গাঁয়ের বদ্ধ জীবনযাত্রায় তার জীবন কাটবে না। খুব ভালো ঘরে বিয়ে দেবে। শহরের মেয়েজামাই সংসার করবে। মেয়ে নিয়ে তার বড় স্বপ্ন ছিল।
মেয়েও বাধ্য সভ্য আর খুবই শান্ত প্রকৃতির ছিল। তবে খুব চাপা প্রকৃতির ছিল।সরলাকে মেয়ে ঘরে রেখে রেখে কাজে যেতে হতো কারণ কার কখন প্রসব ব্যাথা উঠবে সেটা তো আর জানা ছিল না। এখনকার মতো ডেট ফিক্সট হতো না। যেদিকে যেতে হতো সে হয়তো অনেক দূর গ্রামের অন্যপ্রান্তে কিন্তু এই কাজে সে না করতে পারত না কখনো, সে দিনেই হোক বা রাতেই হোক। এটা তার ধর্ম, কাজ নাহলে ভারী অধর্ম হয়ে যায়। রান্নাবান্না কাজকর্ম ফেলে, অসুস্থ শরীরেও তাকে ছুটে যেতে হতো।
এমন অবস্থায় মেয়েটি প্রেমে জড়িয়ে পড়ল গ্রামের এক সম্পন্ন ঘরের ছেলের সঙ্গে
। মেয়ে হেমলতা বেশ সুশ্রী, ফর্সা আর মার আদর যত্নে গাঁয়ের আর পাঁচটা মেয়ের থেকে তাকে আলাদা দেখতে লাগে। যেন একটু শহুরে চেকনাই, তাছাড়া লেখাপড়া করত বলে বেশ একটা অন্যরকম ভাব ছিল যেটা অন্যকে আকর্ষণ করত। হেমলতা জানত সাধন দেখতে ভালো, অল্পবয়স, নিজেদের ধানকল আছে কাজেই সাধন তাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিলে মা অমত করবে না। সাধন তো বলেছে বিয়ে করে শহরে চলে যাবে। সেখানেই তাদের ধানের আড়তের দেখাশোনা করবে।কিন্তু একবার ও ভাবে নি সাধনের বাবা-মা বাড়ির লোক দাইয়ের মেয়ের সাথে বিয়ে দিতে কিছুতেই রাজি হবে না। মেয়ে হবার পরই সরলার বর মরে গিয়েছিল। শক্ত সমর্থ সরলা একলাই মেয়ে মানুষ করেছে। বদমাইশ লোকের হাত থেকে বাঁচার জন্য সে একটু কড়া মেজাজ আর দেমাক রেখে চলত। গাঁয়ের লোকেরা তাই দরকারে হাতেপায়ে ধরলেও ভালোচোখে দেখতো না এটা। সরলা অবশ্য কাউকে পাত্তা দিত না তার কারণ সেই ছিল তিনটি গ্রামের মধ্যে সবচেয়ে বড় নামকরা দাই। আর একজন আছে কিন্তু সে তত দক্ষ নয় বলে তাকে লোকে ডাকে না।
সাধনের বাড়ি জানাজানি হতেই গাঁয়ে ভীষণ আন্দোলন শুরু হয়ে গেল। একটা দাইয়ের এত সাহস যে মেয়েকে প্রশ্রয় দিয়ে একটা বড়লোকের ছেলেকে ফাঁসাতে চেষ্টা করছে! এই নিয়ে বিশাল জটলা হলো। সাধনের বাড়ি থেকে দল বেঁধে এসে সরলাকে যাতা গালাগালি দিয়ে খুব অপমান করে গেল। সরলা গুম খেয়ে সব অপমান হজম করল। সরলার মনে হল শুধু শুধু এমন কথা কেউ বলতে পারে না।তারপর সবাই চলে গেলে সরলা মেয়েকে জিজ্ঞাসা করল কি ব্যাপার। মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে সত্যি কথা স্বীকার করলো। সাধন তাকে ভালবাসে সাধন তাকে বিয়ে করবে বলেছে, সেও সাধনকে বিয়ে করতে চায়। সাধনের মা নরম মনের মানুষ তিনি হেমলতাকে পছন্দ করেন কিন্তু সেটা তিনি পরিবারে বলতে পারবেন না। সাধনের ঠাকুমা এখনও সংসারের সর্বেসর্বা। তিনি তার বৌকে কড়া শাসনে দমিয়ে রাখেন। সাধন বলেছে বাড়ির লোক রাজি নাহলে সাধন তাকে নিয়ে পালিয়ে যাবে শহরে। শহরে সংসার পাতবে। সাধন মা কালীর নাম করে শপথ করেছে। বিয়ে হয়ে গেলে বাড়ির লোকেদের আর কিছু করার থাকবে না। সে তো একটাই ছেলে, বংশধর। পরে ঠিক মেনে নেবে বাড়িতে। চুপ করে বসে রইল সরলা। তার পরদিন সে সাধনের সাথে দেখা করে জানতে চাইল এ কথা সত্যি কিনা।
সাধন মাথা নিচু করে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো সরলা বুঝলো কথাটা সত্যি। সে তখন একটু নরম গলায় বলল, "তবে তোমরা বিয়ে করে নাও. এভাবে বসে থেকে লাভ নেই। আরো ঝামেলা বাড়বে। এখন বাবা ঠাকুমা রাগ করছেন প্রথমে তাদের বোঝাবার চেষ্টা করো, মা তো রাজিই আছেন। তবু তারা রাজি না হলে তোমরা নিজেরাই কলকাতায় গিয়ে বিয়ে করে নাও। আমার একটাই মেয়ে, আমার এই বাড়ি ঘর যা আছে সব আমি যতদিন আছি ভোগ করছি, না থাকলে এসব বিক্রি-বাট্টা করে তোমরা শহরে কিছু করে নিও। "
সাধন নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো কিন্তু তার মুখ দেখে মনে হলো না যে কথাটা সে মেনে নিয়েছে। সরলার কেমন সন্দেহ হলো সে জিজ্ঞাসা করলো, " তা তুমি কি করতে চাও? তুমি এখন তাহলে কি করবে?"
সাধন বলল," আমার পক্ষে বাবার কথা না শুনে উপায় নেই। আমি আলাদা কিছু কাজ করি না। পালিয়ে বিয়ে করলে আমার বাবা যে শুধু আমার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করবেন তাই নয় আমার ঠাকুমা বলেছেন তিনি আত্মহত্যা করবেন । মা কিছু বলতে গেছিলেন, বাবা বলেছেন তাকে মামার বাড়ি তুলে দিয়ে আসবেন। "
সরলা গনগনে রাগের মুখে বলল, "তাহলে তুমি কি বলছ এখন? তুমি ওকে বিয়ে করবে না? সারা গ্রামে যে কথাটা রটে গেলো? এতো লোক জানে এখন তুমি বলছ যে তাকে বিয়ে করবেনা! এ তোমার কেমন ব্যবহার! তখন ভালবেসেছিলে কেন, মেলামেশা করেছিলে কেন? বাপের মতামত তখন নাও নি কেন? "
সঙ্গে সঙ্গে সাধনের মুখ চোখ বদলে গেল সে বলল, "আমি একা মিশলে কি এতটা হত? আপনি কি জানেন আমি মিশেছি না আপনার মেয়ে যেচে এসে মিশেছে? ওই তো আমায় রঙঢঙ করে ভুলিয়েছিল। তাকে জিজ্ঞাসা করুন সে পোড়োমন্দিরে দেখা করতে যেত কিনা না? আমি তো কখনও এ বাড়িতে পা দিই নি। ও কি জানত না যে গ্রামে এমন বিয়ে হয় না! তবে সে কিসের লোভে মিশেছিল আমার সঙ্গে?"
সরলার মাথায় আগুন জ্বলতে লাগল।কিন্তু হঠাৎ সে পিছনে একটা ধপ করে একটা শব্দ পেয়ে তাকিয়ে দেখল তার মেয়ে হেমলতা কখন ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে, আর কথাবার্তা শুনে সে ধপ করে মাটিতে বসে পড়েছে তার মুখ রক্তশূণ্য, হাত-পা কাঁপছে, যেন অজ্ঞান হয়ে যাবে।
সাধন দুমদুম করে চলে গেল। সরলা নিজেকে সামলে নিল। সে মেয়ের কাছে গিয়ে বসে বলল," কি সর্বনাশ করেছিস দেখলি তো? আমাকে একবার জানালি না পর্যন্ত! আমি তাহলে তো বলতে পারতাম এই হারামজাদা তোর জন্য না, এদের সাথে আমাদের কাজ চলে না। কেন এমন করলি বলতো? "
মেয়ে কিছু বলল না, মায়ের কোলে মাথা রেখে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলো। একটা মেয়ে মরেছে, এই মেয়ে নিয়েই তার জীবন। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, "আমি গ্রামের জায়গা-জমি সব বিক্রি করে শহরে চলে যাব, সেখানে তোর বিয়ের ব্যবস্থা করব। আমি ঠিক কাজ জুটিয়ে নেব সেখানে , আমি যে কাজ জানি তাতে ভাতের অভাব শহরে গেলে অন্তত হবে না।
কিছু না কাজ পাই অন্তত আয়ার কাজটা পাব। শহরে এই কাজটা বেশ মেলে। আমি দু চারজন বড় বড় বাবুকে চিনি তাদের ধরে প্রথমে কটা কাজ জুটিয়ে নিলে অনেক কাজ আসবে, মা-মেয়ের চলে যাবে। তোকে আমি ভালো ঘরে বিয়ে দেবো তুই কাঁদিস না মা। "
কিন্তু বেচারা সরলা এতগুলো বাচ্চা প্রসব করিয়েও বুঝতে পারিনি যে মেয়ের শরীরে আর এক ঘটনা ঘটে গেছে। তার মেয়েই পোয়াতি। জানতে পারল পরদিন যখন দেখল মেয়ে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলছে! পাগল হয়ে গেল সরলা, তার হেমলতা এভাবে শুকিয়ে যাবে তা সে ভাবতে পারিনি।
মেয়ের দেহটা আগলে পাগলের মতো বসে ছিল সে। গাঁয়ের লোকেরা এসে জোর করে নিয়ে যায় দেহ। আড়ালে উঁচু ঘরের লোকেরা বলাবলি করছিল " এই জন্য বলে, অতি বাড় ভালো না, ভদ্রলোক হবার শখ এত দেমাক ভগবানের সয়না। "
কিন্তু মরা ঘরে পচবে সেটাও তো আর হয় না। তাই তারা সরলার জাতের লোক ডেকে আনল, তারা মরা নিয়ে গেল।
চারদিন সরলা একই ভাবে বসেছিল। সরলার মাথাটা বোধহয় খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। পাঁচদিনের দিন সেও গলায় দড়ি দিয়ে মরলো।
এবার গাঁয়ের সবাই নিন্দা করতে লাগল ধানকলের মালিক ও তার ছেলে সাধনকে। এমন মেয়েকে বিয়ে যখন করা যায়না তখন কেন এত বড় সর্বনাশ করল! কিন্ত নিন্দা ও প্রশংসায় তখন আর কিছু আসে যায় না মৃতা মা-মেয়ের।
মালিকবিহীন বাড়িটা পড়ে রইল। কেউ ভোগ দখল করতে এল না। ভূতুড়ে বাড়ি হয়ে গেল ওটা। এরপর বাড়ির বাইরে কেউ ওই মা মেয়েকে দেখেনি কখনো। কিন্তু অনেকেই নাকি সন্ধ্যের সময় ওখানে দেখেছে সরলাকে কাজ করতে,উঠোন ঝাঁট দিতে, কুয়ো থেকে জল তুলতে। তার মেয়েকে শুধু জানলা ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যেত হামেশাই । সন্ধ্যাবেলা খোলা জানলা পথে দেখেছে অনেকে একটা দেহ ঝুলছে কড়িকাঠের থেকে, হাওয়ায় দুলছে সেটা। একজন নয় অনেকেই দেখেছে। কেউ ওই বাড়ির ধারেকাছে যেত না। ধীরে ধীরে সরলার সাধের বাগান জঙ্গুলে হয়ে গেল।একবার সরলার দূর সম্পর্কের এক বোনপো এসেছিল থাকতে কিন্তু খুব ভয় পেয়েছিল।
সে কোনমতে একটা ঘর পরিষ্কার করে রাতে ছিল। মাঝরাতে গায়ে টপ টপ করে কি যেন পড়তে লাগল।চমকে উঠে দেখে চটচটে রক্ত পড়েছে বুকে। আঁতকে উপরে তাকিয়ে দেখে সরলার দেহটা ঝুলছে আর তার জিভ, চোখ ঠেলে বেরিয়ে এসেছে। কশ বেয়ে রক্ত পড়ছে টপটপ করে। সেই যে সে চিৎকার করে ছুটে বেরিয়ে এসে সামনের একটা বাড়ির দরজার সামনে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল আর ফেরেনি ওই বাড়িতে ।আর কেউ আসে নি ও বাড়িতে।
তারপর সাধনের বিয়ে হয়েছে অনেকবছর হয়ে গেল। পাশের গ্রামেরই এক সমৃদ্ধশালী পরিবারের মেয়ে। সাধন সুস্থ সবল আর তার বৌ ও স্বাস্থ্যবতী। কিন্তু বৌ যতবার গর্ভবতী হয় ততবার বাচ্চা নষ্ট হয়ে যায়। এমন করে ছয়বার হল। প্রচুর ডাক্তারবৈদ্য কোবরেজ, হাকিম, হোমিওপ্যাথি করা হল। কোন রোগ পাওয়া গেল না বৌ বা ছেলের শরীরে। এবার মাদুলি, তাবিজ, কবচ করা হল কিন্তু কিছুই হল না। সবাই বলতে লাগল সরলা আর তার মেয়ের অভিশাপ লেগেছে, সাধনের ছেলেপুলে হবে না।
তা প্রায় আট নয়বছর হয়ে গেল, সাধনের বোন পুচকুলিরও তো বিয়ে হয়ে গেল। বছর পার হতে চললো, এবার সেই পুচকুলির বাচ্চা হবে। সে তার মা বাপের বড় আদরের মেয়ে। প্রথম পোয়াতি বাপের বাড়ি থেকেই হয়।কিন্তু এরও কাছেই শ্বশুরবাড়ি। তাই মেয়ে শ্বশুরবাড়িতেই ছিল। তখন বর্ষাকাল। গাঁয়ের শেষ প্রান্তে তার শ্বশুরবাড়ি। পুচকুলির শ্বশুর নেই, শ্বাশুড়ি লোক ভালো, লক্ষণ বুঝে আগে থেকেই খবর দিয়েছিলেন মেয়ের মাকে, শরীরগতিক ভালো যাচ্ছে না পুচকুলির । সামনে অমাবস্যার টান,হয়তো বাচ্চা হতে পারে। মা থাকলে মেয়ে ভালো থাকবে। নির্বিরোধী সাধনের মাকে তার বেয়ান খুব ভালোবাসতেন। এক গাঁয়েই বাড়ি, তাই পুচকুলিরর মাও এসেছিল।
এখন গাঁয়ে আর প্রসব হয় না । সরলার মতো দাই আর নেই, তাছাড়া স্বাস্থ্যকেন্দ্র হয়েছে পাশের গ্রামেই। সহজেই নিয়ে যাওয়া যাবে।সেখানেই দেখানো হয়েছিল। সন্ধ্যের পর মেয়ের প্রসব বেদনা শুরু হতে জামাই ছুটল ভ্যানরিক্সা ডাকতে,বলাই ছিল আগে থেকে।
কিন্তু সে রাতে হঠাৎই ভয়ানক ঝড় উঠল। পুচকুলির শ্বাশুড়ি চট করে ঠাকুরঘরে গেলেন, গুছিয়ে ঠাকুরকে শয়ান দিয়ে আসতে। তার ঘরে শুভঅশৌচ হবে নাতিনাতনি হলে, পূজোবন্ধ থাকবে। পুচকুলির মাকে বলে গেলেন বৌকে একটু গরম দুধ খাইয়ে দিতে, বুকে বল পাবে। এমন ঝড় উঠেছ যে বাড়ি কাঁপছে,জানলার পাল্লা দড়ামদড়াম করে পড়ছে। পুচকুলির মা রান্নাঘরে গেলেন দুধ আনতে। একটা ছেলে সাইকেল নিয়ে সাধনদের বাড়ি খবর দিয়ে এসেছে।সাধনও এসে পড়ল সাইকেল নিয়ে। সাধন যেই বাড়িতে পা দিয়েছে আর পুচকুলির মা রান্না করে পা দিয়েছে সেই মস্ত এক বাজ পড়ল আর সশব্দে পুচকুলি যে ঘরে আছে তার দরজা বন্ধ হয়ে গেল। পুচকুলি ভয়ে ব্যথায় কেঁদে উঠল আর দমকা হাওয়ায় একসাথে বাড়ির সব বাতি, হ্যারিকেন আচমকা নিভে গেল। পুচকুলির না আর শ্বশুড়ি একসাথে আর্তনাদ করে উঠলেন "ওমা কি কান্ড! একি হল গো!" শুধু ঠাকুর ঘরের প্রদীপটা জ্বলছে। পুচকুলির ঘরের দরজা পুচকুলি খুলতে পারছে না এমন ভাবে আটকে গেছে, বেদনা বাড়ছে পুচকুলি ভয়ে গোঁঙাতে লাগল।সাধন ছুটে গেল দরজা খুলতে, বোনকে ভ্যানরিক্সায় তুলবে। পুচকুলির বর, সাধন, সাধনের মা, শ্বাশুড়ি পরিষ্কার দেখল দরজা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে এক ছায়া নারী, সে দুহাত দিয়ে আগলে রেখেছে দোর খুলতে দেবে না। ওই একটা প্রদীপের আলোয় তার মুখচোখ বোঝা না গেলেও তার চেহারা আর দাঁড়াবার ভঙ্গিতে পরিষ্কার বোঝা যায় সে সরলা! আঁতকে কাঁটা হয়ে গেলে সবাই, সামনে এগোতে পারছে না, ঝড়ে ছায়া মূর্তির ছায়া চুল উড়ছে।
পুচকুলি কেঁদে উঠল "ওমা মাগো আর পারছি না গো, আমার ভয় করছে গো,দোর খোল। "
ঘনঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বৃষ্টিটা কমের দিকে, কিন্তু বাজ হাঁকছে। এবার ছুটে এল পুচকুলির মা সে সেই দরজা আগলানো ছায়ার সামনে এসে মাটিতে বসে পড়ল, দুমদুম করে মাটিতে মাথা ঠুকে কাঁদতে কাঁদতে বলল, " দয়া কর৷ ক্ষমা কর। আমি তো কখনো বলিনি আমার ছেলের ঘরে নাতিপুতি হয় নি কেন, আমি তো জানি এ তার পাপের ফল।ছেলে তারবাপ অন্যায় করেছে, বৌ সব ঘটনা জেনেশুনে বিয়ে করেছে কিন্তু মেয়েটা যে আমার নিস্পাপ, সে অবোধ দয়া কর তাকে... "
ছায়ামূর্তি অনড়, ঠিক কোন কথা নয় একটা চাপা হাহাকার যেন শোনা যাচ্ছে "আমার মেয়েটা" ... যেন হাওয়া কথা কইছে।
ছটফট করে কাঁদতে কাঁদতে সাধনের মা বলতে লাগল," তুমি তো শতশত বাচ্চা পোসব করিয়েছ, তুমিও তো মা, এ যাতনা তো তুমি জান আর কষ্ট দিও না... দাই তো শুধু দাই নয় ধাইমা যে, ওগো আমার এই অবহেলার জেবনটা নাও গো আমার মেয়েটাকে বাঁচিয়ে দাও, ভিতর থেকে তীক্ষ্ণ আর্তনাদ এল, "ওগো বাবা এ কি হচ্ছে গো, আমি আর পাচ্চি না গো..."
এবার চঞ্চল হয়ে উঠল ছায়া মূর্তি, দোরটা যেন কেঁপে উঠল তারপর মিলিয়ে গেল মূর্তিটা। ছুটে গেল সাধনের মা আর শ্বাশুড়ি দোরের কাছে৷ মা আছড়ে পড়ল দরজায়, বন্ধ দরজা খুলল না। পুচকুলির কান্না মেশানো হেঁচকির শব্দ কানে এল। অসহায় কান্না মায়ের, তার বেয়ানও তাকে ধরে কাঁদছেন। জামাই আতঙ্কিতের মতো তাকিয়ে আছে দরজার দিকে। পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে সাধন। বাইরে ঝড় বৃষ্টি থেমে গেছে।হঠাৎ একটা তীব্র চিৎকার করে উঠল পুচকুলি, আর সাথে সাথে একটা শিশুর কান্না। পুচকুলির আর গলা পাওয়া যাচ্ছে না। পুচকুলির মা মাটিতে লুটিয়ে কাঁদছেন।একটু বাদেই বন্ধ দরজা আপনিই খুলে গেল। ছুটে গেলেন দুই মা, নবজাতক চিল চিৎকার করে কাঁদছে আর পুচকুলি অবসন্নের মতো চোখ বুজিয়ে আছে, বুক ওঠানামা করছে ধীর ছন্দে। চোখের নিমেষে
শ্বাশুড়ি ছুটলেন গরম জল আনতে, নাতনিকে তুলে নিলেন দিদিমা, সদ্যপিতা ছুটেছে স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে দিদিমণিকে ধরে আনতে।
পুচকুলি পরে বলেছিল একদম শেষে দাই এসেছিল, সেই বাচ্চাকে প্রসব করায়৷ তখন পুচকুলি আধা অচৈতন্য... মনের ভুলও হতে পারে।
যে যাই বলুক বা ভাবুক পুচকুলির মা কিন্তু একমাস পরে পুচকুলিকে নিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল সরলার সেই জঙ্গুলে ভিটের সামনে। দেবস্থানে যেমন প্রণাম জানায় তেমন করে প্রণাম করেছিল নাকে খত দিয়েছিল মা মেয়ে।ভালোই ছিল পুচকুলি আর তার বাচ্চা। সাধনের মা এবার আর বর শ্বাশুড়িকে ভয় করেনি আর সত্যি বলতে কি তারাও আর কোন কথা বলেনি।