টরন্টো, ২৬শে অক্টোবর, ২০২৩, নভো সংখ্যা ৪০ 
              
হোমপেজ সম্পাদকীয় পাঠক পরিষদের কথা কবিতা ছোট গল্প ধারাবাহিক সাহিত্য সংবাদ ভ্রমণ কাহিনি নিবন্ধ প্রেমপত্র বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রকৌশল আবৃত্তি / কণ্ঠসঙ্গীত পাঠাগার আর্কাইভ লেখক পরিচিতি যোগাযোগ

কার্তিকের কুয়াশা

রবিবারের রং কি?

 

-সাইদুজ্জামান

 

গল্প এবং সংবাদের মধ্যে একটা পার্থক্য নিশ্চয় আছে। প্রেম-পিরীতির গল্প বলে কথা আছে বটে, তবে প্রেম-পিরীতির সংবাদ বলে এমন কোনো আজগুবি কথা এই ত্রিভুবনে কেউ শুনেছে? প্রেম বলে কিছু নেই, কিছুই নেই? তা সে যাই হোক, স্বল্প কথায় বলি আমার একটা গল্প আছে বলার, আর একটা ভয়ও আছে আর কখনো যদি এই গল্প-টি বলা না হয়ে ওঠে।

 

টরন্টোর স্বল্পায়ু গ্রীষ্মকালে আলস্যময় রবিবারে স্মৃতির ভিতর থেকে গল্পের জামা কাপড় খুলে বেরিয়ে আসে নগ্ন একটি সংবাদ।

 

রবিবার, মে ৫, ১৯৯৬ইং। শুভময়ের বউ অনুরাধা আত্মহত্যা করে ঐদিন।

 

রবিবার, মে ৫, ২০১১ ইং অনুরাধার মেয়ে অহনার বয়স ১৮ বছর হয়ে এলো।

 

রবিবার, মে ৫, ২০১১ ইং শুভময় নিজেকে শুধোয় রবিবারের রং কিগো? সে দুকান ভরে শোনে বর্ণের কোলাহল, দুচোখ ভরে দেখে শব্দের অপরূপ রূপ। বিজ্ঞানীরা একেই কি বলে সপ্তম ইন্দ্রীয়, নাকি সিনেস্থেঝিয়া?

 

শুভময় ১৮ বছর বয়সেই বিদেশে চলে যায় এঞ্জিনিয়ারিং পড়তে। ১৯৮২, কোলকাতা-মস্কো, জীবনের প্রথম উড়োজাহাজ ভ্রমণ। জীবনের প্রথম পিছনে ফেলে যাওয়া এক অমীমাংসিত ভালোবাসা, একজন অনুরাধা সরে গেলো দূরে, সরে গেলো জীবন থেকে। সামনে অহংকারী সুবর্ণ সোভিয়েত দেশ। অনুরাধার সাথে তার সম্পর্ক যে বিভিন্ন কারণে অসম্ভব, তা দেশ ছাড়ার আগেই জানতে পারে শুভময়। অনুরাধা-শুভময় খুব নিকট না হলেও আত্মীয়, রক্তের সম্পর্কও আছে। অনুরাধার দিদিমা আর শুভময়ের ঠাকুরদা আপন ভাই-বোন। যদিও দু’বাড়ির মধ্যে সাধারণ যোগাযোগ আছে, অনুরাধার বাবা-মা দুজনেই ওদের সম্পর্কের প্রতিকূলে। ওর বাবা এবং দাদা অনুরাধাকে মারধোরও করেছে। বুকের ভিতর এক তীব্র ব্যথা পেঁচিয়ে ওঠে শুভময়ের, মানুষের নির্বুদ্ধিতার কি সীমা-পরিসীমা নেই? প্রকৃতই সীমা-পরিসীমা নেই, তাই তো শুভময় আর পিছনের দিকে তাকাতে চায় না। সে এই নতুন প্রবাসী কর্মচঞ্চল জীবনে নিজেকে ডুবিয়ে দেয়। সময় বয়ে যায়। ইভান বুনিন, বরিস পাস্তেরনাক, সের্গেই ইয়েসেনিন – অন্যান্য আরও অনেক কিছুর সাথে এইসব বিখ্যাত লেখকদের মূল রচনা নিয়ে তার জীবন ভালই কাটছিলো। বছর পাঁচেক এ রকম ভালো থাকা।

 

তারপর একদিন ডাকে চিঠি আসে কোলকাতা থেকে। অনুরাধার চিঠি। সংক্ষিপ্ত এবং স্পষ্ট। ‘তোমার ঠিকানা পেয়েছি তোমার বোন স্মিতার কাছে। যদি অসম্ভব না হয় একবার দেশে এস। আমি ভালো নেই, তুমি ভালো থেকো। -অনুরাধা’। ‘আমি আসছি অনু...আমি আসছি...অ...নু...’ , এই অনন্য চিত্কার অনন্ত কুয়োর গভীরে এক প্রতিধ্বনির মতো শোনায়। এইসব ধ্বনি-প্রতিধ্বনির সাক্ষী থাকে না।

 

শুভময়ের সুখের ট্রেন ভুতের কিলে লাইনচ্যুত হয়ে গেলো। খাদের পাশে চাঁদের ডাকে ফিরে এলো সে কোলকাতায়, ঘুরে দাঁড়ালেও ক্ষতি কিছু ছিল না তবু ফিরে এলো একাকী অনুরাধার আয় আয় ডাকে। ভেন্যু: কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ঝোপের ছায়ায় খোলা মাঠের ঘাস। দীর্ঘতম পাঁচটি বছর পর এই দেখা হওয়া। শুভময় তাকিয়ে থাকে অনুরাধার চোখে চোখ রেখে। ফুরিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে না এই মুহূর্ত। কিছু শুনতে চায় না, যেতে চায় না কোথাও। শুধু তকিয়ে থাকতে ভালো লাগে অনুরাধার দুচোখ থেকে বেরিয়ে আসা সাংঘাতিক সুন্দর বিপজ্জনক এক জোছনার দিকে। শুভময়ের কোনো বক্তব্য নেই, অনুরাধার কিছু বলার আছে।

 

- আমার অনেক দুর্ঘটনা ঘটেছে শুভ, এই গত বছরগুলোতে। - অনু, আমাকে আজো তুমি বন্ধু ভাবলে বলতে পারো কি হয়েছে, আমি যদি পারি সাহায্য করবো। - তোমার শুনতে খারাপ লাগবে শুভ। - না লাগবে না, আমার কোনো কিছুতেই খারাপ লাগে না। - শুভ, আমি এক ছেলের হাত ধরে চলে গিয়েছিলাম পালিয়ে বিয়ে করতে, বিয়েটা যদিও শেষমেষ হয় নি।

 

এমন কিছুই কি হওয়ার কথা ছিল না? অনুরাধার মতো সুন্দরী মেয়ে কোলকাতায় হাত গুটিয়ে বসে থাকবে সেরকম আশা শুভময় করেনি। ওর কাছে খুব-ই স্বাভাবিক মনে হয়েছে অনুরাধার সংক্ষিপ্ত ব্যর্থ প্রেমের দুর্ঘটনা। তবু আরো একবার বুকের ভিতর তীব্র ব্যথা পেঁচিয়ে ওঠে। পেঁচিয়ে ওঠে রেস্তরাঁর নীল আলোয় সিগ্রেটের ধোয়ার মতো। সামলে নেয় শুভময়। তার সামনে যে মেয়েটি তার নিতান্ত ব্যক্তিগত এবং কষ্টকর অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করছে, তার কষ্ট নিশ্চয়ই শুভময়ের চেয়েও বেশি। শুভময় বন্ধুত্বের হাত বাড়ায়, সে শুনতে চায় সমস্যার কথা, দিতে চায় সমাধান। অনুরাধা বলতে থাকে এক এক করে সব। সেই ছেলেটির কথা যাকে ভালোবেসে পালিয়ে বিয়ে করতে চেয়েছিলো। সেই মাঝবয়সী ম্যাজিস্ট্রেটের কথা যে হতে দেয় নি এই বিয়ে, ফিরিয়ে এনেছে তাকে তার বাবা-মার কাছে। এ পর্যন্ত গল্পটি জলের মতো সহজ হতে পারতো, জীবন মানেই সব সময় নদীর মতো সরল গা ভাসানো নয়, জলপ্রপাতের মতো জটিল ক্রুদ্ধ আছড়ে পড়াও আছে। ম্যাজিস্ট্রেট ক্ষমা করেনি অনুরাধার যৌবনকে, পেশাগত নীতিমালা, দায়িত্বে সততা, বয়সের ব্যবধান সবই কি তুচ্ছ হয়ে যায় যৌনতার জাদুঘরে? সর্বত্রই নয়, শুধু অনন্ত কুয়োর জলে ব্যাঙ এই বঙ্গভূমে। রবি কবির সেই বিখ্যাত লাইনটি মনে পড়ে শুভময়ের: সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করনি। রাশিয়ায় হলে এমনটি হতে পারতো? না, পারতো না। এতগুলো বছর ইউরোপে থেকে শুভময়ের দৃষ্টি যেনো খুলে গেছে অনেক, বাঙালি বলে গর্ব করার ভরসা সে খুব একটা পায় না, নিজ বঙ্গভূমে বালক-বৃদ্ধ-বণিতা নির্বিশেষে মানুষের মানসিক দীনতা তাকে আহত করে। বড় ইচ্ছে হয় অনুরাধা নাম্নী এই ডিপ্রেস্ড মেয়েটিকে সাহায্য করতে যে কোনো মূল্যেই। শুভময় অনুরাধাকে ভালোবাসে, দান দিয়ে প্রতিদানের আশায় নয় এই সাহায্য করতে চাওয়া। এই ভালোবাসা নিঃস্বার্থ। একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধে নামার মতো এই ভালোবাসা। শুভময় প্রস্তাব করেঃ অনু, তুমি আমাকে বিয়ে করবে? আমাকে তোমার বাবামার সাথে কথা বলতে দাও, তোমারতো পুরো জীবনটাই প্রায় সামনে পড়ে আছে। বাবা-মার সাথে কথা বলার ব্যাপারে অনুরাধা পাশ কাটে, রাজি হয় না। ও প্রস্তাব করে কোর্টে বিয়ে করতে। কোর্ট তা কোর্টই হত, অনুর দাবি ওর সেই ম্যাজিস্ট্রেটের কাছেই যেতে হবে। হৃদয়ের চেয়ে শারীরিক সম্পর্কই বোধ হয় প্রবল বেশি, যত দূরই হোক না কেন সেই স্মৃতি। অনুরাধার সাথে মধ্য বয়স্ক বিবাহিত ম্যাজিস্ট্রেটের সম্পর্কটি যত কালোই দেখাক না কেন, মানুষের শ্রেষ্ঠ জীববৈজ্ঞানিক রসিকতাটি এই যে কাঙ্খিত বা অনাকাঙ্খিত, স্বল্পায়ু বা দীর্ঘায়ু, মধুর বা বেদনা বিধুর যে কোনো যৌন সম্পর্কই হৃদয়ে এক দীর্ঘস্থায়ী স্থান দখল করে থাকে, তা কখনই সম্পূর্ণ ঘৃণার নয়, কে জানে হয়তো আদৌ ঘৃণার নয়। ভালো লাগে না শুভময়ের এইসব। তবু সে মেনে নিতে থাকে এক এক করে সবই যা তার ভবিষ্যত স্ত্রী করতে চায়। অনুরাধার প্রাক্তন বুড়ো প্রেমিক ওদের বিয়ের কাগজ রেজিস্ট্রি করে। অনুরাধার চোখের তারায় বুড়ো প্রেমিকটির জন্য এক বিশেষ মায়া শুভময়ের দৃষ্টি এড়াতে ব্যর্থ হলো। নাটকটির যবনিকা পতন হওয়া উচিত ছিল এখানেই, তবে হলো না। আরও অনেক কিছু দেখার আছে। শুভময় দেখবে। দেখে যাওয়ার জন্যই কি এই জন্ম শুভময়ের?

 

বিয়ে ফেরত শুভময় একাকী বিদেশে। বুকের ভিতর তীব্র ব্যথা পেঁচিয়ে ওঠে। সুরঞ্জনা সাপের মতো পেঁচিয়ে ওঠে বুকের ভিতর বুকের ব্যথা, মাঝে মধ্যে উঠে আসে গলার কাছে, পেঁচিয়ে গোল হয়ে থাকে, কোথাও বিশেষ পালিয়ে যায় না। কোলকাতা থেকে অনুরাধার ডাক-চিঠি আসে নিয়ম মাফিক। অনুরাধার মত বদলেছে। কোর্টের বিয়ে কোনো কাজের কথা নয়, ধুম-ধাম করে এবার বিয়ের পার্টি করতে হবে। বাবামাকে এবার একটু শান্তি দিতে চায় অনুরাধা। বাবামাকে এই একটু শান্তি দেওয়ার কথা অনুরাধা আর একটু আগে ভাবলেও পারতো। শুভময় নিজেই তো তাকে সেরকম কথাই বলেছিলো তখন।

 

আবার কোলকাতা। কলিকাল কি কলিকাতাতেই? খুব ধুমধাম করে ধর্ম মতে বিয়ের পার্টি করাটাই মুখ্য নয়, অনুরাধার এবারেও কিছু কথা আছে। ইশ্বর মুক্তি দাও, জানো তো পারবো না সইতে এতসব। মুক্তি? এক্ষুনি? একটু অসম্ভব – এই প্রেক্ষাগৃহে তুমিই নির্বাচিত দর্শক শুভময়। দেখে যাও, শুধু চোখ মেলে দেখে যাওয়া, আর তো কিছু নয়। অনুরাধার এবারের প্রেমিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, একই সাথে পড়ে। অনুরাধা যদি তার এই বারবার প্রেমে পড়ার বিষয় আশয় গোপন রাখতো তাহলেই বরং শুভময় বুঝি খুশি হত বেশি। তা কি করে হয়? অনুরাধা ঠকাতে চায় না বরকে। কবে কখন ওর মরুভূমির মতো খা খা করা ঠোঁটে পদ্মাপাড়ের এই ব্র্যান্ড নিউ যুবক প্রেমিকটি চুম্বন ভোগ করেছিলো তার নিখুঁত বর্ণনা দিলো অনুরাধা। বাধ্য করলো ব্যক্তিগত সাক্ষাতেও। বিয়ে–পার্টির আয়োজন নিস্তরঙ্গ হলো না। শুভময়ের দেওয়া শাড়ি গহনার কিছুই অনুরাধা পরিবারের পছন্দ হলো না। যাদের সাধ্য থাকে না তাদের সাধ আসে কোত্থেকে এই কথাটা অনুরাধার বাবামার মাথায় এক সুদীর্ঘ সময় ধরে সেধোলো না কিছুতে। অনেক পিষ্ট হলো, তিক্ত হলো লেবু। বিবাহ উত্সবে যুবক প্রেমিক ভগ্ন বুকে বর কনের ছবি তুলে গেলো। শুভময় তাকিয়ে দেখে যুবকের মুখে অন্ধকার আর বিষাদ। হে ঈশ্বর!

 

ফুলশয্যার রাতে বর, বধু, ফুল, অথবা শয্যা কোনটাই সেরকম অর্থ বহন করলো না। জীবনে একবার আসা এমন রাতেও রবীন্দ্রনাথের কোনো কবিতা মনে এলো না। বাংলা সাহিত্যের অন্য একজন কবি শুভময়ের জীবনে খুব প্রভাব ফেলেছেন, অগত্যা তিনি-ই এলেন। কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়। ‘রাত দুপুরের শ্মশান চিতা আমাকে দাও কোল’ কবিতাটাই বারবার খুব মনে পড়লো। ফুল শয্যার ফুলগুলো শুকনো ডালপালার মতই মনে হলো তার। বিরতি বিহীন সুখী মুখের জন্য এইভাবে সংগ্রাম করে যাওয়া। বুকের ভিতর সুরঞ্জনা সাপটি খেলায় মত্ত, বুক থেকে গলা, গলা থেকে মাথার ভিতর উঠে পড়ে কখনো সখনো। বাথরুমের আর্শিতে পরীক্ষা করে দেখে শুভ - চোখের কোথাও আকস্মিক জল আছে কি না। না নেই। সে এবারও পেরেছে চেপে যেতে বুকের নিদারুণ ব্যথা।

 

আর মাতৃভূমি নয়, এখন থেকে ফুলটাইম প্রবাসী জীবন। অনুরাধার মতো বউকে শুধু বউ হিসেবে বিদেশে নিয়ে যাওয়া যায় না। সে ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ছিল, তার ভবিষ্যত ক্যারিয়ার নষ্ট করা অমানবিক দেখায়। স্কলারশিপ দিয়ে তবেই তাকে বিদেশে নিতে হবে। অনুরাধার বাবা যেরকম প্রভাবশালী ব্যক্তি, উনি ইচ্ছে করলেই দু দশ জনকে স্কলারশিপ দিয়ে রাশিয়ার মতো দেশে পাঠাতে পারেন। তবে সেতো অনুরাধার বাবার যোগ্যতা, ও কথা তোলার এখন কোনো মানেই হয় না। অনুরাধা এখন শুভময়ের বউ, বাবার সাহায্য এখন কেন নেবে? সাধ আছে সাধ্য নেই? শুভময়কে অনুরাধা পরিষ্কার জানিয়ে দিলো বাবার সাহায্য সে নিতে পারবে না, তবে যে ক’ টা দিন শুভময় অনুরাধার জন্য স্কলারশিপ না জুটিয়ে দিতে পারছে সে বাপের বাড়িতেই থাকবে। অনুরাধা, অনুরাধার বাবা, মা, দাদা, এমন কি কাজের ঝিও শুভময়কে জানিয়ে রাখলো শুধু শুভময় ছাড়া ও পরিবারের আর কারো সাথে মিশবার অভিপ্রায় এ পরিবারের কারোরই নাই। শুভময়, একমাত্র তুমিই ভালো, তুমিই ব্যতিক্রমী, তুমি ছাড়া তোমার অন্য কোনো স্বজন আমাদের সমাজের যোগ্য নয়। এটাই পরিষ্কার জানিয়ে রাখলো অনুরাধার পরিবার। শুভময় দেখলো, শুনলো, ভাবলো, শুধু বললো না কিছুই। মনে মনে একটু হাসলও বুঝি সে। শুভময়ের ঠাকুরদা অভিজাত জমিদার বংশের শেষ জমিদার ছিলেন অনুরাধার দিদিমা তা ভালই জানেন। একটা সময় ছিল অনুরাধার বাবা শুভময়ের পরিবারে দাসত্বের যোগ্যতাও পেত কি না যথেষ্ট সন্দেহ হয় শুভময়ের। খুব হাসি পায় শুভময়ের। সে নিজেও দেখেছে চোদ্দটা খালি সিন্দুক, ওগুলোর ভেতর এক সময় ইটের মতো সোনার বার সাজানো থাকতো, ঘোড়াশালে ঘোড়া থাকতো, হাতি-ও ছিল। ঠাকুরদা হাতি চড়ে বাজার করতে যেতেন। তাঁর বাজার করা শেষ হোলে তবেই অন্যরা বাজার করার সুযোগ পেত। ঠাকুরদাটা এক জীবনে জমিদারির পুরোটাই সব উড়িয়ে দিলেন। ভালই করেছেন বোধ হয় ঠাকুরদা। জাগতিক বিষয় আশয়ের প্রতি শুভময়ের মোহ মমতা হয় না। তবে তার পারিবারিক ইতিহাসটা খুব ভালো লাগে। সেই একদা জমিদার পরিবারের কারো যোগ্যতা আজ আর নাই অনুরাধাদের সাথে মিশবার? খুব হাসি পায় শুভময়ের। একটা সময় ছিল – সেই সময় এখন আর নাই। মেয়ে মানুষের অভাব পৃথিবীতে খুব একটা নেই, শুভময়ের জন্যও নেই। ইচ্ছে করলেই সে নাটকের দৃশ্য বদল করে দিতে পারে। কাগজে যে স্বাক্ষরে অনুরাধা ‘বউ’ হয়েছে ঐ একই স্বাক্ষরে সে ডিভোর্সী হতে পারে, এমন কিছু কঠিন কাজ তো নয়। তবে ঐ যে প্রেক্ষাগৃহের নির্বাচিত একক দর্শক শুভময়, চলচ্চিত্রটি যে এখনো শেষ হয় নি।

 

মস্কোয় সোভিয়েত শিক্ষা মন্ত্রণালয় শুভময়ের আবেদন মঞ্জুর করলো। পেট্রোকেমিক্যাল এঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্কলারশিপ পেলো অনুরাধা। প্রথম বছর রুশ ভাষা শেখা। এ ভাষাতেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা। রুশ ভাষা শেখা কতটা সহজ বা কতটা কঠিন তার উপর পাতার পর পাতা লেখা যেতে পারে, তবে ঐ বিষয়টা প্রাসঙ্গিক নয় এখানে। যে কোনো শিক্ষাই ইচ্ছা নির্ভর বলে মনে করে শুভময়। অনুরাধার ভিতর ঐ ইচ্ছা নেই। বাঙালি মেয়ে মাত্রই কি প্রবাসে জীবন্ত শবদেহের মতো? সম্ভবত নয়, তবু শুভময়ের এই শবদেহ কাঁধে নিয়ে ফেরা। প্রতিদিন বাড়ি থেকে শ্রেণীকক্ষের দোরগোড়া পর্যন্ত দিয়ে যাওয়া, নিয়ে যাওয়া, বাজার করা, রান্না করা, রাতে হোমওয়ার্ক করে দেয়া। শুধু তারপর রাতদুপুর হয়ে এলে, ব্যালকনির নিঃসঙ্গ চেয়ারে বসে সিগ্রেটে একটি সুখের টান দিয়ে দূর অন্ধকারের দিকে বিষন্ন তাকিয়ে শুভময় বলতে পারেঃ হে ইশ্বর!

 

এতদিন তবু সহনীয় ছিল, অনুরাধা এবার তার সেরা খেলাটি খেলতে শুরু করলো। প্রতীয়মান কোনো কারণ ছাড়াই ব্লেডে শরীরের বিভিন্ন স্থান কাটছে – রক্তপাত হলে নাকি তার ভালো লাগে। শরীরের অনাবৃত অংশের ভিতর দু হাতে এবং মুখে ভরে থাকছে অসংখ্য দাগ। কয়েকবার আত্মহত্যার চেষ্টাও সে করলো ঘুমের অসুধ খেয়ে। হাসপাতালে নিয়ে যেতে হলো বার দুয়েক, পুলিশের মুখোমুখিও হতে হলো শুভময়ের। অনুরাধাদের ডীন শুভময়কে ডেকে অনুরাধা কোনো নার্কটিকে আসক্ত কিনা এ নিয়ে নানারকম সংশয় প্রকাশ করলেন। একদা উচ্চশির শুভময়ের মাথা ক্রমাগত হেঁট হতে থাকলো।

 

দাম্পত্য যুদ্ধ বেঁধে গেলে বুদ্ধি দিতে কিভাবে যেন লোক জড়ো হয়ে যায়। তাদেরকে দোষ দেয়া যায় না। অনেকেই পরিষ্কার বুঝলো সমস্যার মূলে রয়েছে একটি সন্তানের অভাব। আজকাল খুব ক্লান্ত বোধ করে শুভময়, স্রোতের অনুকূলে গা ভাসিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। দশজন বিচক্ষণের ধারণা মিথ্যে করার জন্যই বুঝি অনুরাধা গর্ভবতী হলো একদিন। অন্য আর একদিন অনুরাধার উপর্যুপরি তর্জন গর্জন এবং হুমকির মুখে শুভময়কে ব্যবস্থা নিতে হলো অকারণ গর্ভনাশের।

 

বাপের বাড়ি কোলকাতা ঘুরে এলো অনুরাধা গ্রীষ্মের ছুটিতে। মস্কো ফিরে এসে শুভময়ের সাথে সে আর ঘর করবে না পরিষ্কার জানিয়ে দিলো। শুভময়ের কোনো আপত্তিই নেই। বিদেশে ডিভোর্স দূতাবাসেই হয়। দূতাবাসে আবেদন করা হলো যথারীতি। কয়েক ঘন্টার মধ্যেই অনুরাধা উচ্চপদস্থ অফিসারদের সাথে তুমুল বাধিয়ে নিলো। অনুরাধার বাবামা ফোনে অনেক কাকুতিমিনতি করলো শুভময়ের কাছে, বিয়েটা যেন কোনভাবেই ভেঙ্গে না যায় এই বলে। আর একটু হলে বেঁচে যেতে পারতো শুভময়, তা আর পারলো না। বিবাহ বিচ্ছেদ ভেঙ্গে গেলো, শুভময়ের করুণাবশে।

 

কয়েক মাস পর শুভময় নিজে কোলকাতায় বেড়াতে এলো একাই। অন্তহীন জামাই আদর পেলো। শুভময়ের মতো মহামানব নাকি অনুরাধার বাবামা তাদের জীবনে আর দেখে নি। শুভময়ের যথেষ্ট আপত্তি থাকা সত্ত্বেও তার পকেটে একলক্ষ টাকার পরিমানে ডলার গুজে দিলো ওরা। শুভময় কারো সাথেই টাকা পয়সার সম্পর্কটা রাখতে চায় না। তবু বাধ্য হয়েই নিলো, সে জানে এ পয়সার একটিও সে নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করবে না।

 

শুভময় পি এইচ ডি করছে। ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে খুব। বৌয়ের পাগলামি কমে নি কিছুই। এতদিন ওরা ভাড়া বাড়িতেই থাকতো। সে এবার ইন্টারন্যাশনাল হস্টেলে মুভ করার সিদ্ধান্ত নিলো। ওখানে ওদের মতোই নানা দেশের অনেক ছাত্র-ছাত্রী আছে। অনুরাধার সময়টা হয়তো ভালো কাটবে। ওরা ফ্যমিলি রুম পেলো হস্টেলে। অনেক বাঙালি ছাত্রও আছে ওখানে, বাঙালি মেয়ে বলতে বিশেষ কেউ নেই। যারা আছে তারা অনুরাধার মনের মতো নয়। বাঙালি এক যুবকের সাথে বেশ ভাব হয়ে গেলো অনুরাধার। যুবকের নাম অতীন। শুভময়কে আর যাই হোক রিটার্ডেড বলা চলে না। সংসারে বৌয়ের নখর থেকে গা বাঁচাতে শুভময়ের মতো কোটি কোটি পুরুষ চোখ বুজে এড়িয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে আনসাইটলি অনেক দৃশ্যাবলী। শুভময় একক দৃষ্টান্ত নয়। অনুরাধা–অতীন, এই নাটকের বিশেষ এবং চূড়ান্ত এক অধ্যায়।

 

আর দশজন মানুষের তুলনায় ওদের ঘর বড়ই নিকৃষ্ট মানের, কালার টি ভি নেই, উল্লেখযোগ্য কোনো ইলেকট্রনিক্স নেই, এসবই অনুরাধার অভিযোগ। শুভময় একদিন পুরো একলক্ষ টাকাই খরচ করে ঘর সাজিয়ে ফেললো। সেইসব ইলেকট্রনিক্স পাথর ছুড়ে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করতে এক ঘন্টার বেশি সময়ও লাগলো না অনুরাধার। শ্বশুর বাড়ির শাল সেই একলক্ষ টাকা অবশ্য অনুরাধার নিজের কাছে এবং তার বাবামার হিসেবের খাতায় শুভময়ের নামেই ধার হিসেবে অক্ষত রইলো।

 

তিন মাসের গর্ভ শুধু খেয়াল বশে নাশ করার হৃদয়-ওয়ালা অনুরাধার হঠাত আবার মা হবার ইচ্ছে যথেষ্ট সন্দেহজনক। সন্দেহ-বাতিক শুভময়ের নেই। প্রেক্ষাগৃহের নির্বাচিত একক দর্শক হিসেবেই সে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে। শুভময়ের তবু ভালো থাকা হয় না। ত্রিভুজ প্রেমের জটিলতম ট্রাজেডিই হলো একই টাইম এবং স্পেসে পুরুষ বাহু দুটির সাথে ভূমি নারী দেহটির নির্লজ্জ চূড়ান্ত সঙ্গম। জ্যামিতিক বহুভুজের জন্য ন্যূনতম তিনটি লাইনের প্রয়োজন হয়। দু লাইনের জ্যামিতিক আকার নেই, তিন লাইনের আছে। এ কারণেই গতানুগতিক দ্বিভূজ প্রেমের কোনো গল্প হয় না, গতানুগতিক দ্বিভূজ প্রেম সর্বদাই অদৃশ্য, সর্বদাই নিরাকার। জয় ত্রিভুজ, জয় ত্রিভুবন, জয় ত্রিকাল।

 

তিন মাস পার হয়ে গেলো,ন’ মাস দশ দিন হয়ে এলো। দুজন পুরুষের একনিষ্ঠ সেবা শুশ্রূষা, মায়া মমতায় ২২ শে জুন, ১৯৯৩, মধ্যরাতে অনুরাধা মা হলো। মাতৃসদন চত্বরে রহস্যময় আলো আঁধারির ভিতর দুরু দুরু বুকে দুজন পুরুষকে পায়চারি করতে দেখা গেলো। একজন আয়া এসে শুভময়ের জামার আস্তিন টেনে ধরে খুব হাসি মুখে বললোঃ তোমার চাঁদের মতো এক মেয়ে হয়েছে গো! দাঁড়িয়ে থাকলো কিছুক্ষণ আয়াটি পুরস্কারের আশায়। শুভময় কিছু টাকা দিয়ে আয়াটিকে বিদেয় দিলো।

 

শুভময় -অনুরাধার ঘরখানি ভরে উঠলো। একটি শিশু সত্যই বড় শক্তিমান। পৃথিবীর অন্ধকার মুখে হাসি ফুটানোর জন্যই শিশুদের এই আসা। ঘরের প্রতি এতদিনকার কেন্দ্রাতিগ শক্তিটি আজকাল আর বোধ করে না শুভময়। সে খুব খুশি, সে খুব সুখী, সে এখন খুব ঘরমুখো। শুধু অনুরাধাই আগের মত ঘর বিমুখী, শিশুর জন্ম তার জীবনে সেরকম লক্ষণীয় পরিবর্তন আনতে পারলো কই? সময়মতো মাতৃদুগ্ধও ঠিক মতো পেলো না শিশুটি। যে কোনো ছুতোয় অকারণ হৈচৈ বাঁধিয়ে অনুরাধা আজো সুখ পায়। শুধু রাগ দেখিয়ে ক্ষুধার্ত শিশুকে খেতে না দিতে বুঝি মায়েরাই পারে। শুভময়ের দুচোখ বাষ্পাকুল হয়ে ওঠে। শুভময়ের এই নিরুপায় মুখখানি দেখতেই বুঝি অনুরাধার বড় ভালো লাগে। শিশুটিকে বুকে নিয়ে বাইরে পার্কে শুভময় হাঁটে, গান গায় গুনগুনিয়ে। ক্ষুধার্ত শিশু একসময় ঘুমিয়ে পড়ে। শুভময় ভালোবেসে শিশুটির ডাকনাম রেখেছিলো Wren, গান গাওয়া ছোট্ট এক বুলবুলির নামে। ঐ ডাকনামটি আজ আর বেঁচে নেই। অনুরাধার বাবামার দেয়া পুরো নামটিই শুধু অনুরাধার অনুমোদন পেয়েছিলো শিশুটির বার্থ সার্টিফিকেটে দেয়ার। সেই নামটিও আজ আর অক্ষত নেই, জন্ম তারিখটিও বদলে গেছে।

 

অতীনের ভূমিকা বিশেষ ভাবেই দ্রষ্টব্য। তবু শুভময় যেন এক বৃদ্ধের ছানি পড়া চোখে তাকিয়ে দেখে ঠিকঠাক ঠাহর করতে পারে না। মানুষ নাকি মহামানুষ? নির্দ্বিধায় এক যুবক অন্যের শিশুর মলমূত্র, নোংরা কাপড় ধুয়ে দিচ্ছে, মানব ইতিহাসে এজাতীয় ঘটনা কি নজিরবিহীন নয়? শুভময়ের অভিধানে মহামানব শব্দটি কোনদিন ছিল না। কোনো মানুষকেই সে বিশ্বাস করে নি কোনদিন, আজো করে না। শ্রেষ্ঠ মানুষের নাম মনে করতে চাইলে শুভময়ের মনে লাইকা নাম্নী ভুল নামটি-ই কেন মনে পড়ে? এমন কি নিজেকেও খুব একটা ভালো মানুষ ভাবে না শুভময়। অতীনের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শেষ হয়ে গেলো। পেট্রোকেমিক্যাল এঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিগ্রী নিয়ে অতীন ফিরে গেলো কোলকাতায়।

 

অনুরাধার যেন সন্তানের জন্ম দিয়েই দায়িত্ব শেষ। শিশুটির দিকে তাকিয়ে চোখে শুধু জল চলে আসে। চোখের জলে দুনিয়ার খুব কম সমস্যারই সমাধান হয়। শুভময় পার্মানেন্ট বেবি-সিটার রাখলো বাড়িতে। পি এইচ ডি শেষ করে সে এখন এক আমেরিকান কম্পানিতে চাকরি করে। অনুরাধা অতীনের সাথে ফোনে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে। খানিকটা দূরত্ব আছে বলেই বোধ হয় প্রেম এত মধুর হয়, এত আসক্তির হয়। দূরের চাঁদ নৈকট্য পেলে রূপ হারাতো। কর্তব্যের দোষে দুনিয়ায় বরেরা বা বউয়েরা, প্রেমিক বা প্রেমিকাদের মতো নিখাদ হতে কখনই পারেনি সেই প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে। যুগে যুগে অনুরাধা-অতীনরা যেন সেই হ্যামেলিনের বংশীবাদকের সুরের টানে বাধ্য হয়েই ধাবমান নেশার মতো মৃত্যুর দিকে। শুভময়ের অনুরাধাও তাই কোনো ব্যতিক্রম নয়। অনুরাধা তাই অপরাধী নয় কোনো, এমন কি শুভময়ের কাছেও। শুভময়ের রাগ নেই, অভিযোগ নেই, অভিমান নেই, এমন কি বিস্ময়ও আর কোনো অবশিষ্ট নেই। অনুরাধা নির্দ্বিধায় শুভময়ের বুকে মাথা রেখে কেঁদে উঠতে পারে, কারণ অতীন নাকি মারাত্মক অসুস্থ। মাথা ঘুরে নাকি পড়ে গিয়েছিলো। কে জানে ব্রেন টিউমার কি না। অতীনের কিছু হয়ে গেলে অনুরাধা আর বাঁচবে না। প্রেমিকের জন্য স্ত্রীর এই আহাজারি দেখে শুভময় হাসবে না কাঁদবে বুঝতে না পেরে হাসি-কান্নার মাঝামাঝি একরকম মুখ নিয়ে তাকিয়ে থাকলো। ওঠে না কি বুকের ভিতর পেঁচিয়ে ব্যথা? মাঝে মধ্যে ওঠে।

 

শুভময়ের কাজের বড় চাপ, ঘরে ফিরতে রাত হয়। বেবী-সিটার তখন চলে যেতে পারে। আর অনুরাধা প্রায়ই রাতে ফেরে না। ফিরলেও অনেক রাতে যখন শুভময়ের নাক ডাকছে আর তার বুকের উপর ঘুমিয়ে আছে শিশুকন্যা রেন্। হস্টেলে আরো অনেক বাঙালি আছে, অনুরাধা সেখানেই আড্ডা দেয়। এইসব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে কথা তোলার স্টেজ অনেক আগেই পেরিয়ে এসছে শুভময়। অনুরাধার তবে তুচ্ছাতিতুচ্ছ গন্ডির সীমাবদ্ধতা ভালো লাগে না। সে এবার শুরু করলো ঘুমের বড়ি খাওয়া, নিজ শরীরে শিরার ভিতর সিরিঞ্জে বাতাস পুশ করা। অবস্থা চরমে পৌঁছুলে শুভময় সত্যি ভয় পেয়ে গেলো। এরকম মানসিক অবস্থায় চরম কোনো দুর্ঘটনা অনুরাধা ঘটাতে পারে বলেই শুভময়ের বিশ্বাস। আর্থিক দিক দিয়ে কষ্ট হলেও শুভময় টিকিট কিনে ওদেরকে তুলে দিলো কোলকাতার প্লেনে। প্লেনে ওঠার সময়ও অনুরাধা অস্বাভাবিক থাকলো। তার সাথে শিশু। বিমানবালাদেরকে বিশেষ অনুরোধ করতে হলো শিশুটির দিকে বিশেষ নজর রাখতে।

 

মাস চারেক থাকলো অনুরাধা বাবামার সাথে। ইতিমধ্যে শুভময় পার্সোনাল কম্পিউটার কিনেছে। ব্যবহারিক জীবনের কোনো ঘটনাই বুঝি শুভময়কে কোনো শিক্ষা দিতে পারলো না। অনেক যুক্তিই মেনে নিলো না মন। ইচ্ছে করলো শুভময়ের, অনুরাধাও কম্পিউটার শিখুক। তখন হয়তো তাকেও একটা চাকরি জুটিয়ে দেয়া যাবে। কোলকাতায় ফোন করলো শুভময়, কথা হলো বউয়ের সাথে, শাশুড়ির সাথেও। অনুরাধার বর্তমান মানসিক স্বাস্থ্যের কথায় শাশুড়ি জানালেন তিনি সেরকম কোনো সমস্যাই দেখেন নি। অনুরাধাও জিজ্ঞেস করলো সে কি করবে। শুভময় বললো চলে আসতে, এসে কম্পিউটার শিখতে এবং কাজ খুজতে। অনেক ঠাট্টাও হলো যা হয় বর-বউয়ের মধ্যে। অনুরাধা ফিরে এলো। ফিরে এলো রেন্। শুভময় খুব সুখে আছে। এরকম সুখে থাকা দিন সাতেক।

 

হাসিরাশির দিন ফুরোলো। শুরু হয়ে গেলো আবারও অনুরাধার। সে শুধু কাঁদে। কি হয়েছে জিগ্যেস করলে তার কোনো উত্তর দেয় না। মাঝে মধ্যে কাগজে কিসব লেখে ও। একদিন শুভময়ের চোখে পড়লো, অনুরাধা লিখেছেঃ আমি আর সহ্য করতে পারছি না, বাবা মা’র নতশির হয়ে থাকা ওই পশুটার সামনে। এরকম কিছু লেখা। শুভময় জিজ্ঞেস করলো কি ব্যাপার খুলে বলো, কিছু একটা নিশ্চয়ই করা যাবে।

 

-না যাবে না, তুমি পারবে না -কেন পারবো না? -তোমার শারিরীক, আর্থিক, সামাজিক কোন শক্তিই নেই তার সামনে।

 

এর বেশি কিছুই বললো না। এর বেশি কিছু আজো জানা হয় নি শুভময়ের। অনুরাধার মানসিক অবস্থা প্রতিদিন খারাপ হতে থাকলো। গলায় ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে, প্রচুর ঘুমের বড়ি খেয়েছে। সিরিঞ্জে বাতাস পুশ করেছে শিরায়। নিরুপায় হয়ে ইমারজেন্সি হেল্প চাইলো শুভময়। ডাক্তাররা দীর্ঘ সময় কথা বললেন অনুরাধার সাথে একাকীত্বে। পরে তারা শুভময়কে জানালেন তার মানসিক অবস্থা বিপজ্জনক। শুভময়কে সাবধানতা অবলম্বন করতে বলা হলো। তবে কি মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে? কিন্তু অনুরাধা যাবে না কিছুতেই। শুভময় নিরুপায়। শুধু আশা করে আছে, এরকম তো আগেও বহুবার হয়েছে, কেটেও গেছে।

 

দু’তিন দিন পর। এক বাঙালীর জন্মদিন। ওদের যাওয়ার কথা। অনুরাধা শাওয়ার নিল। খুব সাজলো। এবং কিছু না বলে বেরিয়ে গেল। এরকম সে আগেও করেছে। শুভময় তার শিশুকন্যা নিয়ে হস্টেলের সামনে অনেকক্ষণ হাঁটাহাটি করে অনুরাধা আসছে না দেখে ফিরে এলো চারতলায় ওদের ঘরে। শুভময় টিভি অন্ করেছে, কি যেন একটা ফিল্ম হচ্ছে টিভিতে । হঠাত কাঁদতে কাঁদতে ওদের দরজায় কড়া নাড়লো একটি ছেলে – সে জানালো অনুরাধা মারা গেছে। শুভময়ের মাথা ঘুরে উঠলো। সিঁড়ি দিয়ে নামতেই এক যুবক ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের কার্ড দেখিয়ে ওদের ঘরের চাবি চাইলো। শিশুটিকে কে যেন শুভময়ের বুক থেকে নিয়ে গেল। শুভময় প্রায় পাগলের মতো নীচে নেমে এসে দেখলো অনুরাধার মৃতদেহ পড়ে আছে রাস্তায়। কে একজন বললো, সাত তলা থেকে লাফ দিয়েছে।

 

পোস্ট মর্টেম হলো। টিকিট করা হলো। তিনবছরের শিশু কন্যা বুকে নিয়ে স্ত্রীর কফিনসহ শুভময় কোলকাতায় পৌঁছুলো। শুভময়ের শ্বশুর শোকের বদলে তার বিভিন্ন ক্ষমতার বিবরণ দিতে থাকলো। শুভময়ের জন্যই অনুরাধার মৃত্যু হয়েছে সেটাই বারবার প্রকাশ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। একদিন কথায় কথায় শুভময়কে শুনিয়ে তিনি বললেন, দুনিয়াটা বড় নোংরা হয়ে গেছে। শুভময়ের শিশুকন্যাটিকে ফেরত দেওয়া হলো না। এই বাচ্চাটিকে বাবার স্নেহ ভালবাসা থেকে বঞ্চিত করেও মানুষ কোন লজ্জা বোধ করেনা উচ্চারণ করতে, দুনিয়াটা বড় নোংরা হয়ে গেছে। শুভময় ফিরে এসেছে কর্মস্থলে। তাকে ডেকে ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের অফিসার কিছু কথা বলেছেন। সে ভীষণ লজ্জার কথা । শুভময় সেসব কথা কোথাও বলতে চায় না। তার কন্যা সন্তান বড় হচ্ছে। অনুরাধা সাত তলা থেকে লাফ দেয়ার সময়, রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া দুজন বাঙ্গালী এবং আরো অনেক পথচারীর সংগে কথা বলে লাফ দিয়েছে দিনের আলোয়।শুভময়কে খুনের দায়ে বাঁচানোর জন্যই কি অনুরাধার এই সাক্ষী রেখে যাওয়া?

 

শুভময় ভাল নেই। সারাক্ষণ মেয়ের কথা ভাবে। বিগত স্ত্রীর কথা ভাবে। কোন ব্যথাই আর অনুভব করতে পারে না। শুভময় ভাবে। মাকড়সার মতো এই জাল বুনে যাওয়া, ভাবনা জালে রহস্যের নদী থেকে কোনো মাছই ধরা পড়ে না। এমনকি কোনো ইঙ্গিতের ছিটেফোটা ডালপালাও উঠে আসে না শুভময়ের ভাবনা জালে। কেন এই আত্মহত্যা? কেইবা সেইজন যার অসীম শক্তি, যার সামনে অনুরাধার বাবামা নতশির থেকেছে? কিইবা ছিল তার সাথে অনুরাধার সম্পর্ক? সাইকোসিস-ই কি একমাত্র কারণ? রেন্-কে বাবার বুক থেকে ছিনিয়ে নেয়ার রহস্যটাই বা কি? প্রাণের বদলে প্রাণ? শুভময়ের প্রাণটাই যুক্তিযুক্ত হত বেশি। কি অপরাধে রেন্ অপরাধী? খুনই যদি হয়, তবে খুনের বদলে খুনই হত। হাজার হাজার ঘরের বউ প্রতিবছর ভারতে আত্মহত্যা করছে বা নিহত হচ্ছে, সেকারণে কোনো কোর্ট একটি শিশুকে দাদামশাই দিদিমার কাস্টডিতে দেয়ার রায় দিয়েছে শুভময়ের জানা নেই। শুভময়ের বাবামা এখনো জীবিত। খুনি প্রমানিত হলেও শিশুটির কাস্টডি তাঁরাই পেতেন। কোর্টের কথায় অনুরাধার বাবামা পাশ কাটিয়েছে। কেন এই পাশ কাটানো? অনুরাধার বাবামার এই নিজ হাতে আইন তুলে নেওয়া নিতান্তই সহজ সরল রেখার মতো কখনই মনে হয়নি শুভময়ের। তোমার কাছেই আমরা আমাদের সক্ষম সন্তান হারিয়েছি, সে কারণেই তুমিও মেয়ের উপর অধিকার হারাচ্ছ। মেয়েটি তোমার কাছে সেফ্ নয়। তবে ভরণ পোষণের দায়িত্বটা রাখো। এভাবেই তুমি অনুতাপের সুযোগ পাচ্ছ শুভময়। এই কথাগুলোই অনুরাধার বাবামা তাকে বারবার জানিয়েছে। অনুরাধার বাবামার এই সরল অঙ্কটি কতকাল দীর্ঘায়ু পাবে শুভময়ের জানা নেই। শুধু জানা আছে যা কিছুর শুরু আছে তার নিশ্চয়ই শেষও আছে। এ গল্পেরও শেষ হবে একদিন এই কথা মনে রেখে হেঁটে যায় শুভময়।

 

যেখানে চাকরি করতো শুভময় সেই কম্পানীটি বন্ধ হয়ে গেলো একদিন। ভাঙ্গনের পর প্রাক্তন সোভিয়েত দেশগুলোয় ব্যাঙের ছাতার মতো পশ্চিমী কম্পানী গজিয়েছে। ঐসব কম্পানীতে চাকরির আশায় রুশভাষী তরুণ তরুনীদের ভিতর ইংরেজি শেখার হিড়িক পড়েছে। শুভময় এখন ফুল-টাইম টিউটর। অস্ট্রেলিয়া এবং ক্যানাডায় ইমিগ্রেশনের জন্যও আবেদন করেছে। আবেদনপত্রে রেন্ অন্তর্ভুক্ত। এক নাছোড় স্বপ্ন তার অন্তর্গত রক্তের ভিতর খেলা করে। একদিন দুদেশই প্রায় একসাথে আবেদন মঞ্জুর করলো। অন্য আর একদিন অনেক বাক বিতন্ডা শেষে শুভময় ব্যর্থ হলো অনুরাধার বাবামার একটানা জেদের কাছে। রেন্ পড়ে রইলো তৃতীয় বিশ্বে। তাকে কিছুতেই আসতে দেয়া হলো না বাবার কাছে। শুভময়ের মনে এক অদৃশ্য মাকড়সা বুনে চলে ঘন থেকে ঘনতর জাল, সেই জালের ফুটো দিয়ে বরাবর পালিয়ে যায় রহস্যের ছানা-পোনা।

 

ক্যানাডাই বেছে নিলো শুভময়। টাকা পয়সাও খুব একটা নেই, আছে শুধু একগাদা ডিগ্রী। ফরাসিভাষী প্রদেশ কোবেক এই দরিদ্রদের জন্য দাতা হাতেমতাই। ফরাসী শিখতে রাজি থাকলে কোবেক সরকার ইমিগ্র্যান্টদেরকে কিছু টাকা পয়সাও দেয়, তাতে বেশ ভালই চলে যায়। বছর খানেক এই ফরাসী ভাষা শিখে বেশ কাটিয়ে দিলো শুভময়।

 

অল্প সময়েই শুভময় বুঝলো এদেশে শ্রমবাজারে বিরাজমান বিশাল এক আমলাতন্ত্র। শুধু যোগ্যতায় যোগ্য চাকরি সে কখনই পাবে না। রাশিয়ার ডিগ্রী নিয়ে নাক সিটকানোই যেন সত্যতা প্রতিপাদক এক কাজ, অর্ধ শিক্ষিত বা অশিক্ষিত লোকও খুব হেসে ফেলে। মানুষের এই ক্রমবর্ধমান সেন্স অব হিউমার দেখে শুভময়েরও খুব হাসি পায়। কিছু হাসিরাশি না থাকলে তার জীবনতো নির্ঘাত বৈচিত্র হারাতো। শুভময় নিশ্চিত এখানে তার সেরকম কিছু হওয়ার নেই। সেরকম কোনো ভবিষ্যত তার জন্য পড়ে নেই বিশাল আর ধনী এই দেশটিতে। তারপরও এই নির্ঝঞ্ঝাট প্রথম বিশ্বই তার ভালোলাগে। ভবিষ্যত না থাকুক এখানকার বর্তমানটা চমত্কার। তাছাড়া শুভময় মহাত্মা গান্ধীর মতো নির্ভিক এক সৈনিকও নয়। শ্বেতাঙ্গ মোমের আলোয় এই ধীরস্থির পথ চলা মন্দ লাগে না তার। এই ‘প্রথম-বিশ্বের’ লেখাপড়াটাই একবার খুঁচিয়ে দেখতে চাইলো শুভময়, তাছাড়া সময়টাও বেশ কেটে যাবে। রাশিয়া থেকে যারা আসে তারা সাধারণত বছর খানেক ব্যয়ে বড়জোর একটা মাস্টার্সই করে। তাতেই বেশ চাকরি টাকরি হয়ে যায়। এইসব চাকরিতে বাদামি বাঙালিরা এক নির্দিষ্ট সীমার উপরে একটুও খুব একটা উঠতে পারে না, ক্রীতদাসত্বও মেনে নেয়া আছে সেখানে। তা সে যাই হোক খানিকটা বাড়তি শ্বেতাঙ্গ সান্নিধ্য, ব্যাঙ্ক থেকে বিস্তর ধার কর্য করে একটা বাড়ি কেনা, একটা গাড়ি কেনা, আর আছে মাসান্তে একটা পার্টি দিয়ে যারা এতটা উচ্চতায় উঠতে পারে নি তাদের সামনে পশ্চিমী আনুনাসিক ইংরেজিতে আহ্লাদে বলে ওঠাঃ ইটস ওনলি ন্যাউ দ্যাট আ’এম এন্জয়িং লাইফ। মোটামুটি এরকমই হয় প্রবাস জীবন। শুভময় এসবের কিছুই চায় নি। সে দ্বিতীয় বারের মতো পি এইচ ডি তেই ভর্তি হলো। বিরাট কিছু হওয়ার জন্য নয়, শুধু একটু বাড়তি সময় ধরে ছাত্র থাকার জন্যই বুঝি। অনেকেই খুব নাঁকি সুরে বললো বটে, শেষ করতে পারবে না পি এইচ ডি। আর পারলেও চাকরি টাকরি পাবে না। শুভময়কে নিয়ে আর দশজনের দুশ্চিন্তা বুঝি কখনই যাওয়ার নয়।

 

মেয়ের কথা এখনো খুব ভাবে শুভময়। ফোনে কথাও হয় মাঝে মধ্যে। টাকা পয়সাও পাঠাতে হয়। বারবার ছবি চেয়ে মেয়ের একটাও ছবি পায় না শুভময়। সেই যখন তিন বছর বয়স ছিল তখনইতো শেষ দেখা। সাত বছর হয়ে গেলো মেয়েকে দেখেনি শুভময়। কে জানে এতদিনে মেয়েটা কেমন দেখতে হলো? ছবির কথায় অনুরাধার বাবামা পাশ কাটায়, টাকা পয়সা ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে কথা বলতে রাজিই নয় তারা। সাফ জানিয়ে দেয়, মেয়ের খোঁজখবর রাখা শুভময়ের একক দায়িত্ব। এসব শুভময়ের সমস্যা, তাদের নয়। শুভময়েরই যখন সমস্যা, তবে তাই হোক।

 

কোলকাতার টিকিট কিনলো শুভময়। সে কোলকাতায় ফোন করে।

 

৪ঠা জুন, ২০০৩। কথা হয় অনুরাধার মায়ের সাথে। পাকা এক ঘন্টা ফোনে কথা হলো। ঠিক কথা নয়, ঝগড়া-ঝাটিই হলো বলতে হয়। আর যদি কোনো চেষ্টা চলে মেয়ের সাথে দেখা করার, এবারের সংগ্রাম - অনুরাধার মা শুভময়কে ধূলিস্মাত করে তবেই ছাড়বে। গোটা ভারতবর্ষ ঝাঁপিয়ে পড়বে শুভময়ের উপর। যাহ্ তারা! টিকিট ফেরত দিয়ে পুরো টাকাটা ফেরত পাওয়া গেলো না বটে। কোলকাতা যাওয়া বন্ধ হলো।

 

পিতৃত্ব কি মাতৃত্বের চেয়েও আসক্তিজনক? হতে পারে নিশ্চয়ই। জটিলতা থেকে কিছুদিন দূরে থাকার চেষ্টা, তারপর বারবার ফিরে যাওয়া। সন্তানের মুখের মতো আর কোনো চুম্বক আছে? যাহোক এই মাঝে মাঝে ফোনে কথা বলা সন্তানের সাথে, এই বা মন্দ কি? একদিনের রেন্ নাম বদল করে এখন অহনা, জন্মের তারিখটাও বদল করা হয়েছে। অহনা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে। মাসে মাসে ভরণ-পোষণ এবং লেখা পড়ার খরচের বদলে শুভময়ের বড় ইচ্ছে ছিল স্কুল থেকে সে মেয়ের প্রোগ্রেস রিপোর্ট পাক। সে কথায় অনুরাধার বাবামা পাশ কাটিয়েছে। শুভময়ের কোনো কথার গুরুত্ব নেই তাদের কাছে। শুভময়ের পাঠানো টাকা পয়সা ছাড়া আর কোনো বিষয়ে তারা আগ্রহী নয়। অহনার জীবনে, স্কুলে, সমাজে আসল পিতৃপরিচয়টিই বা কি শুভময় নিশ্চিত জানে না।

 

এ কথায়, সে কথায় একদিন অহনা ফোনে তাকে বললোঃ পাপা, তুমি মায়ের একলক্ষ টাকার ধারটি শোধ করবে কবে? শুভময়ের মনটা বড় ব্যথিত হলো। ব্যথিত হলো এ জন্য নয় যে তাকে একলক্ষ টাকা দিতে হবে। ব্যথিত হলো এই ভেবে যে নিজেরই সন্তানকে দেয়া সামান্য টাকা, সেই সন্তানের মৃত্যুর পরও যারা ফেরত চাইতে পারে তারা কি মানুষ? টাকা পয়সার প্রাচুর্য শুভময়ের কোনদিনই ছিল না, তবু পরিচিত একজন ডাক্তার ভদ্রলোকের মাধ্যমে অবিলম্বে এক লক্ষ টাকা পাঠিয়ে দিলো। ডাক্তার ভদ্রলোকের সাথে এ কথায় সে কথায় অনুরাধার বাবার একটি নাতিদীর্ঘ শোডাউনও হয়ে গেলো।

 

শুভময়ের বাবার ক্যান্সার ধরা পড়লো ২০০৫ সালে। মনটা বড় খারাপ তার। সারাজীবন অন্যের জন্যই করে গেলো শুভময়, বাবামাকে কার্যত কিছুই দিতে পারেনি। একটু শান্তি, তাও নয়। ২২শে জুন, ২০০৫ কোলকাতার প্লেনে উড়াল দিলো সে, বাবা হাসপাতালে আছেন। চোদ্দ দিন হাসপাতাল ঘরেই বাবার পাশে কাটালো শুভময়। অহনাকে, তার দাদামশাই দিদিমাকে খবর দেয়া হলো, শুভময় এখন কোলকাতায়, তার বাবা হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে লড়ছেন। বাবা এবং মৃত্যুপথযাত্রী ঠাকুর্দার সাথে শেষ দেখা করার প্রয়োজন বোধ করলো না অহনা। অহনার দাদামশাই এবং দিদিমা তাকে নিয়ে দূরের কোনো শহরে চলে গেলো, পাছে শুভময় মেয়েকে নিয়ে টানাটানি করে এই ভয়ে। ৮ ই জুলাই ফেরত প্লেনে শুভময় কোলকাতা ত্যাগ করে।

 

 ২০০৬ সালে শুভময় তার দ্বিতীয় পি এইচ ডি অর্জন করলো সিভল এঞ্জিনিয়ারিংয়ে, বাবা মারা গেলেন এবং চাকরি নিয়ে সে আমেরিকা চলে গেলো। বছর চারেক ওখানেই থাকা, তারপর ফিরে আসে টরন্টো। অহনার সাথে ই-মেইলে যোগাযোগ হয়। ফেসবুকেও নিয়মিত কথাবার্তা হয়। বাবার প্রতি অভিযোগ অনুযোগ আর টাকা পয়সা চাওয়া ছাড়া অহনার সেরকম আর কিছু বলার নেই। আর দশজন ছেলে মেয়ের মতো ফেসবুকে অহনার কোনো ছবি নেই। বড় দেখতে ইচ্ছে করে সন্তানের মুখ। অনেক অনুনয় বিনয় শেষে যে দু’চারটে ছবি অহনা পোস্ট করলো তা তার শিশু বেলার।

 

একদিন শনিবার এলো, একদিন শনিবার গেলো। কে যেন বলেছিলো শনিবারের রং সবুজ। শনিবার শেষে রবিবার এলো। নিঃসঙ্গ বাসভূমে শুভময়ের এই এক আন্তর্জালে সুতোর পথ ধরে হেঁটে ফেরা, নির্বাসনের মতো আপনার মনে নিতান্ত একাকী। ফেসবুকের পাতাগুলো হাওয়ায় ওড়ে, কাপাস তুলোর মতো উড়ে যায়, উড়ে আসে। কে যেন ভুল করে অহনার বর্তমান ছবি অহনাকে ট্যাগ করেছে। প্রাণ ভরে শুভময় দেখে অহনার ছবি, এ যেন বিশ্বরূপ। মুখের উর্ধাংশ ঠিক মায়ের মতো, অনুরাধার চোখ, কপাল, ভ্রু, দৃষ্টি, ঠিক যেন ফটোকপি। নাক ঠোঁট হাসি আর থুতনি অতীনের। আজ রবিবার। শনিবারের রং সবুজ, রবিবারের রং কিগো? রংধনু.....রংধনু।

 

 

রংধনু কোনো আনন্দের প্রতীক নয় শুভময়ের কাছে। দুনিয়ায় সব সুখী মানুষই সাদামাটা একরঙ্গা। সম্ভাব্য সাতটি রঙের সহবাস শুধু অসুখেই, সম্ভাব্য সব ক’টি দৃশ্যমান তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোক বর্ণালী শুধু বিষাদেরই বিষ। রবিই ভূমন্ডলের একমাত্র আলোর উত্স – রবিবারের রং তাই রংধনু, প্রতিবারে তাই রবিবার এসে গেলে মনে বড় ব্যথা পায় শুভময়।

 

অহনার সাথে সর্বমোট ৫৪ বার ই-মেইল আদান-প্রদান হয়েছে। ডিসেম্বর ২০, ২০০৯, রবিবার - প্রথম চিঠি। প্রেরকঃ অহনা – প্রাপকঃ শুভময়। জানুয়ারি ৩০, ২০১১, রবিবার – শেষ চিঠি। প্রেরকঃ শুভময় – প্রাপকঃ অহনা। রবিবার থেকে রক্ষে নেই যেন।

 

শেষ চিঠিখানা শুভময়ের লেখা। চিঠি ঠিক নয়, নিরুত্তাপ একটিমাত্র শব্দে চিঠির প্রাপ্তি স্বীকার। তবে অহনা কিন্তু তার শেষ চিঠিখানায় দারুণ নাটকীয়তা দিতে পেরেছিলো।

 

অহনার শেষ চিঠিঃ বেশ, বাস্তবিক দ্রুতই হলো, খোলাখুলিও বটে। তুমি যদি আমাকে সাহায্য করতে না চাও, তাহলে পুরোপুরিই আমার জীবন থেকে বের হয়ে যেতে পারো। ভেবোনা আমাদের সম্পর্কটি স্থাপিত ছিল যে ভিত্তির উপর তা অর্থ। তা নয়। তবে সব ক’টি দিক থেকেই বাবা হিসেবে তুমি ব্যর্থ। তুমি নিঃস্ব ছাড়া আর কিছু নও যার সম্ভবত অনেক অর্থ আছে, যশ আছে, বন্ধু আছে ... তবে কন্যা নেই। এটা নিতান্তই একটা পরীক্ষা ছিল যে পরীক্ষায় তুমি ঠিক এই মুহূর্তে অকৃতকার্য হয়েছ। তুমি ব্যর্থ হয়েছ বাবা হিসেবে। আমি মরে যাবো না তোমার অর্থ ছাড়া। আমার অনেক মানুষ আছে এখানে যাদের সঙ্গে আমার রক্তের সম্বন্ধ নেই, তবু তারাই আমার কাছে ‘বাবা’। তুমি খুব ভালো করেই জানো আমি আইনত আমার অধিকারের দাবি করতে পারি। ডঃ শুভময়, আশা করি তুমি ভুলে যাওনি আমি আইনের ছাত্রী। তবে তুমি ইতিমধ্যেই এক নিঃস্ব, দুস্থ,যে বস্তুত নিজের অহমিকা পরাভূত করতে অক্ষম। আমি তোমার দীর্ঘায়ু কামনা করি, এতটাই দীর্ঘ যেন তুমি দেখে যেতে পারো অহনা তোমার চেয়ে অনেক অনেক ভালো এক অবস্থানে অবস্থিত। তুমি কখনই হতে পার নাই একজন পুত্র, একজন পতি, একজন ভ্রাতা, অথবা বস্তুত কোনো কিছুই ... কারণ তুমি একজন পুরুষ যার অহমিকা ছাড়া আর কিচ্ছুটি নেই।

 

চিঠিটিতে কোনো সম্বোধন নেই, মুখবন্ধ নেই, সমাপ্তিকরণ নেই, সত্ত্বপ্রদান নেই। এই অনুপস্থিতিগুলোও অর্থহীন হয় নি, এই অনুপস্থিতিগুলোও বেশ এক ধরনের নাটকীয় প্রতিমূর্তি তৈরী করতে পেরেছে বৈকি। কাঠামোগত দিকটা বাদ দিলেও অহনার চিঠিতে ইংরেজিটা নির্ভুল নয়, ভারতবর্ষে শিক্ষার এই অধঃপতনে শুভময়ের মনে বড় ব্যথা পায়। একটা সময় ছিল, বাঙালিরা মাতৃভাষার মর্যাদা বুঝতো, দ্বিতীয় কোনো ভাষা শিখতে হলে তাও খুব ভালো করে শিখতো। এই সময় আর সেই সময় নয়। লেখা পড়া শেখাটাই আজকাল এক নির্বুদ্ধিতা হিসেবে গণ্য হচ্ছে। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোতে বাঙালি সাহেবরাই, যাদের মাতৃভাষা ইংরেজি নয়, আজকাল দুর্দান্ত ইংরেজি শেখাচ্ছে। পরিণামে ছেলেমেয়েরা যা শিখছে তা ভয়ঙ্কর। যাহোক, অহনা কিন্তু দারুণ লিখেছে - য়্যু ক্যান্ গেট আউট অব মাই লাইফ ....শুভময় কি আদৌ অহনার জীবনের কোথাও সেরকম ভাবে আছে যে সেই স্থান পরিত্যাগের দুঃখে তার হৃদয় দ্বিখন্ডিত হবে? অহনার কথাগুলো সত্যি হলেই শুভময় খুশি হত বেশি, সম্পর্কটা অর্থ-প্রধান না হলেই ভালো হত। ভালো হত অহনার জন্যই। শুভময়ের অর্থ, যশ, বন্ধু, কন্যা, কিচ্ছুটি নেই – তা ঠিক। ‘হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহান /তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রীষ্টের সম্মান।’

 

ব্যর্থ বাবা খেতাবটিও মন্দ নয়, বিশেষণটি যাই হোক, ঐ বিশেষ্যটি শুভময়ের একদিন বড় কাঙ্খিত ছিলো। রক্তের সম্বন্ধ কথাটারও কোনো মানে হয় না, পৃথিবীজোড়া সব মানুষই হয়তবা একদিনের সেই এক রক্তের বন্ধনে পরস্পর আবদ্ধ। আবার কারো সাথেই হয়তো কারো আদৌ কোনো বন্ধন নেই। মানুষ মানেই রক্ত মাংস শরীর শুধু নয়, মানুষ মানে আত্মাও। সেই আত্মার সৃষ্টি, আদি, উত্স, বিভাজন মানুষ বড় জানে না। অহনার সাথে রক্তের বন্ধন শুভময়ও দাবি করে না, বন্ধনের উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি কোনটা আবিষ্কারের প্রতি তার নিজের সেরকম কোনো আগ্রহও নেই। তবে কৌতুহলী জনের জন্য বিশেষ দ্রষ্টব্য এই যে প্রাগ্রসর বিজ্ঞানের সুবাদে কমপ্লিট ডি এন্ এ প্যাটারনিটি টেস্ট এখন সহজলভ্য, সাধারণ কৌতুহল অথবা আইন সংক্রান্ত জটিলতা নিবারণের বাজার দর এখন $৭৯ মার্কিন ডলার। আধুনিক আইন আজ আর শুধুই কথা-বলা-কলা-কৌশল নির্ভর নয়, বিজ্ঞান-প্রযুক্তিই এখন এক অপরিহার্য বিচারক হয়ে উঠেছে।

 

অহনা ভালো একজন আইনজীবী হয়ে উঠতে পারলে শুভময়ই একদিন খুব খুশি হবে। অতটা আশা করার সাহস যদিও শুভময় করে না, কারণ অহনার মেধা নেই। অন্তত শুভময় তাই মনে করে। অপরাধী বাবাকে শাস্তি দেবার জন্য আইনজীবী হওয়া বেশ নাটকীয় দেখালেও বাস্তবানুগ নয় মোটেও। বরং একজন দক্ষ আইনজীবী ভাড়া করার কথাটা মাথায় আসলেই অহনাকে বুদ্ধিমতি বলা যেত। যুদ্ধ বাধলেই বুদ্ধি দিতে আসা মানুষের অভাব পৃথিবীতে নেই, সে কারণেই অহনার পিতৃসম মানুষের অভাব নেই। এই সব বাবারা যদিও প্রয়োজনে বিন্দুমাত্র কাজেও আসে না। কাজে আসলে পৃথিবীটা আরো একটু বেশি বাসযোগ্য হত। কাজে আসলে অহনার জীবনটা আজ নড়বড়ে বাশের সাঁকোর মতো না হয়ে শক্ত রেললাইনের ব্রীজের মতো দেখাতো। অহনার এই নাটকীয় ভাবে শুভময়ের দীর্ঘায়ু কামনা করাটা বেশ উপভোগ্য। আজ খুব মনে পড়ে অনুরাধার শবদেহ সামনে রেখেই অহনার দাদামশাই একটানা বিলাপ করেছিল, অনুরাধার মৃত্যুতে শুভময়েরও কেন মৃত্যু হলো না, বারবার এই বলে। জুলিয়েটের শবদেহ দেখে রোমিও কি নিজ হাতে তুলে নেয়নি বিষ? বাহ্, মানুষের চাওয়ার কোনো শেষ নেই বুঝি। অহনার সেই দাদামশাই আজ নব্বই পেরিয়েছে, সন্তানকে সে নিজের জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসতো। পৃথিবীর মায়া মমতা ছেড়ে তবু জীবনের সাঁকোখানি পেরিয়ে ওপারে যাবার কোনো লক্ষণই তার ভেতর আজো কেউ দেখেনি। আর দিদিমাও আছে বেশ ঠিকঠাক, আজো ঠিক আগের মতই টেনে টেনে সুর করে দারুণ বাংলা বলতে পারে। কথিত আছে, একদিন তার সেই সুরে কেঁপে উঠে যৌবন ফিরে পেতে দেখা গেছে কত বুড়ো মন্ত্রী-মিনিস্টার আর বুদ্ধিজীবীর হৃদয়। যা রটে তার কিছুটা বটে। অহনার দিদিমার চরিত্রহীনতার রটনা একদিন সত্যই ছিল, সেই সময়ের যে দু’একজন যারা এখনো বেঁচে আছেন, খুকখুক হাসি সামলে তারা সেরকম সাক্ষ্যই দেন।

 

একদিন অহনা খুব বড় অবস্থানে পৌঁছুতে পারুক এই আশীর্বাদই করে শুভময়, অহনার সাথে তার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই,শুভময়ের অবস্থান এমন কোনো গগনচুম্বী নয় যে সেই অবস্থান পেরুনো এক দুরাশার মতো শোনাবে। শতায়ু আর ধনে পুত্রে লক্ষীলাভ হোক, আন্তরিক এই আশীর্বাদই করে শুভময়।

 

পিতা নয়, পতি নয়, পুত্র নয়, ভ্রাতা নয়, কোনো কিচ্ছুই আর শুভময়ের হবার নয় এ পৃথিবীতে অহনার এই প্রজ্ঞাপন বেশ নাটকীয় তবে অবাস্তব। শুভময়ের বাবা মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত পুত্রগর্বে গর্বিত ছিলেন, মা এখনো বেঁচে আছেন, সমাজে দু দশজনকে আজো তাঁর পা ছুঁয়ে প্রণাম করে বলতে দেখা যায় ‘রত্নগর্ভা মা, আমাকে আশীর্বাদ করো।’ দাদা বা ভাই হিসেবে শুভময়ই ভাইবোনদের কাছে আজো প্রিয়তম। শুভময়ের পিতৃস্নেহবলেই এমনকি অহনার জীবনের প্রথম তিন বছর নিষ্কন্টক ছিল। শুভময়ের পিতৃস্নেহবলেই অহনার আজকের জীবন জটিলতর হয়ে ওঠেনি। শুভময় মুখ খুললে হতো, মুখ সে খোলেনি। অহমিকা নয়, সত্যবাদিতা। এই সত্যবাদিতার কারণেই শুভময়ের নিজের জীবন কন্টকাকীর্ণ, এই সত্যবাদিতার কারণেই তার জীবন পুষ্পের পেলবতা পেলো না।

 

অহনার এই শেষ চিঠির আগের চিঠিখানা ছিল শুভময়ের, সেটাও সংক্ষিপ্ত একটিমাত্র শব্দে রচিত। ‘না।’ শুভময় এমন নিস্প্রাণ চিঠিই বা লিখতে গেলো কিসের উত্তরে?

 

অহনার চিঠিঃ পাপা, নমস্কার। কেমন আছো? তুমি জানো, আমি সত্যিই ব্যস্ত আমার পরীক্ষা নিয়ে। না, দয়া করে অবাক হয়োনা। আমি তোমার কন্যা এবং আমি তোমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করবো না যতক্ষণ না তুমি আমার কাছে মোটামুটি সহনীয় থাকছো। মূল বিষয়ে ফিরে আসছি। আমি নির্দিষ্ট করে তোমার পূর্ববর্তী চিঠির উত্তর দিচ্ছি তা নয়, কারণ সেইসব বিষয়বস্তু ব্যাখ্যা করার জন্য আমাক আরো ভেবে বের করতে হবে সম্ভবত অতিপ্রাকৃত শব্দাবলী, খোলামেলাভাবে বলতে গেলে সেইসব বিষয়বস্তু মনে হয় না তুমি আদৌ বুঝতে পারো। ঠিক আছে, খুলে মেলেই বলছি, আমি চাই এখন থেকে তুমি আমাকে নিয়মিত মাসিক ভাতা দাও। এটা কি সম্ভব হবে? দয়া করে জরুরি ভিত্তিতে আমাকে জানাও। এখন চলি। অহনা।

 

জরুরি ভিত্তিতেই অহনাকে প্রশ্নটির উত্তর জানিয়েছিলো শুভময়। তাত্ক্ষণিক, নিশ্চিত, সহজ, সরল, সংক্ষিপ্ত ছিল সেই উত্তর। অহনার এই চিঠির পর শুভময় মাত্র দুবার উত্তর পাঠিয়েছে, দুবারই সংক্ষিপ্ত উত্তর। তারপর অহনা আর যোগাযোগ রাখেনি। তাহলে সামান্য এই এক ‘না’ শব্দটিই কি অহনার কাছে সহনাতীত হয়ে উঠলো? শেষ চিঠিতে অহনা লিখেছিলো বটে ‘ভেবোনা আমাদের সম্পর্কটি স্থাপিত ছিল যে ভিত্তির উপর তা অর্থ।’ অহনা ঠিক লেখেনি। অর্থের প্রশ্নে নিষ্পাপ এই ‘না’ শব্দটিই জগতের অধিকাংশ সম্পর্ককে ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়। এটাই সত্য, এটাই বাস্তব। পিতা-মাতা-সন্তান, ভাই-বোন, পতি-পত্নী -জগতের কোনো সম্পর্কই এই টাকা-পয়সার চৌম্বক ক্ষেত্রের বাইরে নয়। জগতে এই টাকা-পয়সা উপার্জন করা একই সাথে খুব কঠিন এবং খুব সহজ। টাকা-পয়সার এক ধরনের হৃদয় আছে, যা স্পর্শ করতে পারা এক শিল্পবিশেষ। কেউ কেউ জানে, কেউ কেউ জানে না সেই শিল্প, সেই কলা। অহনা জানলে শুভময়ের বড় ভালো লাগতো।

 

ডিসেম্বর ২৩, ২০১০, অহনাকে পাঠানো শুভময়ের উত্তর। শুভময় অহনার লেখা চিঠিটিকে পুনর্বিন্যাস করেছে - অক্ষরগুলো লালরঙ্গা, ছোট বড় বারো ভাগে বিভক্ত হয়েছে অহনার চিঠি, প্রতিটি খন্ড অংশের নীচে নীল অক্ষরে টাইপ করা শুভময়ের উত্তর।

 

-হাই পাপা,

 

-হাই মাই ডটার!

 

-ধন্যবাদ তোমার অবিলম্বে উত্তর দেবার জন্য। আমার প্রথম প্রশ্ন আমাকে বিদ্রোহী নামে ডেকেছ কেন। আবারও তুমি মানুষকে অভিযুক্ত করা চালিয়ে যাচ্ছো।ঠিক আছে, আমার এ ব্যাপারে কিছুই করার নেই।

 

-বিদ্রোহী নামে ডেকেছি এক পিতৃস্নেহ মাখা নিতান্তই ঠাট্টার ছলে, কোনো কিছুতে অভিযুক্ত করার উদ্দেশ্যে নয়।

 

-প্রথমেই আমি কিছু বিষয় তোমার কাছে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিতে চাই। আমার কাছেও ভালোবাসা বিক্রয়যোগ্য নয়। আর আমি ধারণা করি ম্যাটেরিয়াল বিষয়-আশয় দিয়ে ভালোবাসা অর্জন করা যায় না। আমি তোমার ব্যাপারে জানি না, তবে এটাই আমি ঠিক যেভাবে ভালোবাসাকে দেখি। আমি যদি তোমার কাছে কিছু চেয়ে থাকি, তবে তা তুমিই করতে বলেছো বলে করেছি।

 

-তুমি খুব ভালো মেয়ে।

 

- পরিবার বলতে আমি বুঝিয়েছি সেইসব মানুষকে আমার সাথে যাদের রক্তের সম্বন্ধ আছে, বাবা হিসেবে তুমি অন্তর্ভুক্ত। আমি আমার পিতার দিক দিয়ে সম্পর্কযুক্ত আত্মীয়দের নিয়ে কথা বলতে চাই না, কারণ তারা কখনই আমার খোঁজখবর নেবার প্রয়োজনটি বোধ করেনি। অতএব দয়া করে আমার কথাগুলোর অন্যথা-ব্যাখ্যা দিও না।

 

-সব মানুষই মূলত মানব প্রজাতির এক বিশাল পরিবার। আদৌ রক্ত নয়, পরস্পর সম্পর্কিত হওয়ার জন্য বরং অন্য কিছু জরুরি।সব সত্ত্বেও বাবা হিসেবে আমাকে বিবেচনা করার জন্য ধন্যবাদ, আমি সম্মানিত বোধ করছি, ...আর খুউব সুখী। তোমার পিতার দিক দিয়ে সম্পর্কযুক্ত আত্মীয়রা কখনই তোমার খোঁজখবর নেয়ার প্রয়োজন বোধ করে নি ... শাবাশ! তুমি সঠিক পথটিতেই আছো। আমি বুঝতে পারছি তোমার কথাগুলো, সম্পূর্ণভাবে, পরিপূর্ণভাবে, সম্ভাব্য সব অর্থ বিবেচনা করে। চালিয়ে যাও।

 

-তোমার মতানুযায়ী, তো কাস্টডি টাই সর্বশেষ কথা!! আমার যদি ভুল না হয়, আমার মা'র মৃত্যুর পরে তো তুমি আমাকে আভিভাবক স্বরূপ এই দাদু-দিদিমার হাতেই তুলে দিয়েছিলে। আমি কন্যা সন্তান। আমার মায়ের প্রয়োজনীয়তা ছিল। আমার দিদিমা সেই শুন্যস্থান পূরণ করেছেন। যাই হোক, তাতে তোমার পিতৃত্বের অধিকার তো আর বিলুপ্ত হয়নি। নাকি আমাকে হস্তান্তর করার সময়েই তুমি তোমার পিতৃত্ব বিসর্জন দিয়েছিলে। আমি আবারো বলছি, তোমার স্নেহ, ভালবাসার প্রতি সংশয় প্রকাশ করছিনা, কিন্তু তোমার আমার দায়িত্ব নেবার ক্ষমতা কে প্রশ্ন জানাই। আর্থিক দিক দিয়ে আমি আমার ভবিষ্যতকে বিপদমুক্ত রাখতে সক্ষম। বর্তমানে, আমি আমার দেশের এক অতি সুপ্রতিষ্ঠিত ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ে পড়ছি। অর্থের ভিক্ষা আমি চাইছি না । কোনোদিন চাইও নি। সমাজের নিরিখে, আমি আমার নিজস্ব দক্ষতায় ভাল মতই স্বাবলম্বী ও সম্মানিয়া।

 

-হ্যা, নিশ্চয় কাস্টডিই একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমি আদৌ একমত নই তুমি যা বলছো তার সাথে। আমি তর্কও করতে চাই না। কারণ আমি তোমার সাথে কোনো সংঘর্ষমূলক বিরুদ্ধতায় যেতে চাই না। তবে আমি এক প্রাচীনকালীন গল্প বলতে চাই, সেই গল্পের নাম ছিলো অন্ধকারে হাতি দেখা। এই গল্পে হিন্দুস্থান থেকে আসা একদল লোক অন্ধকার ঘরে হাতি প্রদর্শনের ব্যবস্থা করে। কিছু সংখ্যক মানুষ অন্ধকারে হাতি স্পর্শ করে হাতি দেখতে কেমন বোঝার চেষ্টা করেছিলো, ঠিক কোথায় স্পর্শ করেছিলো তার উপর নির্ভর করে তাদের মধ্যে কেউ মনে করলো হাতি এক প্রকার জল নির্গমনের নল বিশেষ (শুঁড়), আবার কেউ কেউ মনে করলো হাতি দেখতে পাখা (কান), থাম (পা)এবং সিংহাসনের (পিঠ) মতো। এটা পৃথক পৃথকভাবে প্রত্যক্ষকরণের সীমাবদ্ধতার একটি উদাহরণ। আবারো বলছি, কেউই কারো বা কিছুর জন্য দায়ী নয়। আমি খুউব সম্মানিত বোধ করছি নিজের অক্ষমতার জ্ঞান আমার কন্যার কাছেই অর্জন করতে পেরে। ধন্যবাদ! আর দয়া করে আমাদের এই চিঠিপত্রের আদানপ্রদান সংরক্ষণ করে রেখো ভবিষ্যতে পড়ার জন্য, ধরা যাক, এখন থেকে কুড়ি বছর পর যদি তোমার হঠাত অশ্রুপাত করার প্রয়োজন পড়ে। অন্যতম সর্বোত্তম ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ে পড়বার অভিজ্ঞতা নিশ্চয় আকর্ষনীয়, তাই নয় কি? আমি বড় হয়েছি প্রত্যন্ত একগ্রামে, প্রকৃতই জানিনা ইংরেজি-মাধ্যম বিদ্যালয়ে ড়ার অনুভূতিটা কেমন। তবে আমার কাছে খুউব বড় শোনাচ্ছে।আমি তোমার সুস্থিত আর্থিক অবস্থা এবং সামাজিক মর্যাদার জন্য প্রকৃতই সুখী। তোমার জন্যই ভালো, তাই নয় কি? -না, আমি নিশ্চয় আমার বিয়ের ব্যাপারে তোমাকে জানাবো। নিমন্ত্রণ পত্রের দরকার হবে না বোধ করি। এখানে তোমার কন্যার কথা হচ্ছে। তবে তুমি যদি অন্ধ হয়ে যাও ততদিনে? তুমিতো আমাকে তাহলে দেখতে পাবে না। আমার হাসব্যান্ডের ‘সত্য’ জানাই ভালো। তোমার প্রথম option টাই সমগ্রভাবে সত্যের কাছাকাছি। - খুউবই সম্ভব আমি অন্ধ হয়ে যেতে পারি ততদিনে। এগিয়ে যাও Honey, যে option টাই তোমার পরিস্থিতির জন্য বেশি স্যুট করে তা নিয়ে। আমি প্রভূত মূল্যের সাথেই গ্রহণ করেছি তোমার মতামত

 

- তুমি প্রকৃত আমার সম্পর্কে কি ভাবো তা বুঝতে সাহায্য করার জন্য ধন্যবাদ।

 

-বিগত ১৪ বৎসর , আমার কোন কম্পিউটার এর প্রয়োজন হয়নি। শুধুমাত্র তোমার কথা অনুযায়ী, তোমার সাথে যোগাযোগের কারণেই আমার কম্পিউটার এর প্রয়োজনয়ীতা। তোমার ভাই, যাও বা কম্পিউটার আমাকে দিয়েছিল, সবচেয়ে ভাল কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ কে দেখিয়েও আমাকে ওটা আবর্জনায় ফেলতে হয়েছে, বিক্রি টুকুও করা যায়নি। এখন যেহেতু আমি তোমার সাথে যোগযোগ রাখছি এবং বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আবেদন করছি, আমার এটি প্রয়োজন। দাদু-দিদিমা আমার কোন কিছু তেই আপত্তি প্রকাশ করেন না। তাদের তো আমার রক্ষণাবেক্ষণ বৈ আর কিছুই করার ছিলনা, যা কিনা তারা যথেষ্ট পরিমাণেই করেছেন। এটা তো তোমার কর্তব্য ছিল।

 

- বিগত ১৪ বছর , তোমার কোন কম্পিউটার এর প্রয়োজন হয়নি? হ্যা, তাইতো, তুমি যথার্থ তাই বলছ। আমি তাহলে ক্ষমা মার্জনা করছি আমার সাথে যোগাযোগ রাখতে বলায়, আমার দাদাকেও ক্ষমা করো, যে তোমাকে এক আবর্জনা কিনে দিয়েছিলো যা থেকে মুক্তি পেতে তোমাকে বেগ পেতে হয়েছে। আমি কারো জন্য, বা কোনো কিছুর জন্যই দায়ী নই। -আমি কখনো ভাবিও নি যে আমাকে এই ভাবে বলতে হতে পারে। আমার সক্ষম মা কিন্ত তাদের জিম্মায় থাকা কালীন মারা যাননি। আমি তাকে হারিয়েছি, যখন সে তোমার কাছে ছিল। যেহেতু, তুমি ভাবছ, আমি এক কঠিন জীবন অতিবাহিত করছি, তার কারণ শুধু এটাই, আমার মা নেই। অবশ্যই, আমার দাদু-দিদিমার কাছে এর উত্তর নেই। তুমিই আমায় বলো, যদি তুমি সত্যই এত কর্তব্যপরায়ন, এতই বিচক্ষণ, কি করে আমার মা কে মৃত্যুর পথে যেতে হল? সুতরাং, যদি আমি আজ এতই দুর্দশার স্বীকার,তোমারই কি নয়, সেই দায়? তোমার কি কোন উত্তর আছে? তাহলে, কিভাবে আমি আমার সুরক্ষা বলয় দেখব বল, ওখানে? আমার পক্ষে এটা বিবেচনা করা সম্ভব ছিলনা, কারণ আমি ছোট ছিলাম। আমি বিবেচনার কথা নয়, তথ্য বা বাস্তব ঘটনার কথা বললাম। আমি এভাবে তোমাকে প্রশ্ন করতে চাইনি, কিন্তু তোমারি কথা আমাকে এরূপ তর্কে অবতীর্ণ করেছে ।

 

-‘কাস্টডি’ প্রাসঙ্গিক শুধুমাত্র ১৮ বছর বা তার কম বয়সের সন্তানাদির জন্য। স্বচ্ছন্দেই তুমি তোমার হৃদয় খুলে মেলে বলো, হানি। তোমার যা খুশি তাই বলতে পারো। আমার এখন আর তাতে কিচ্ছু যায় আসে না। আমি আগেও বেশ শুনেছি এই একই নিন্দা তোমার পরিবারের অন্য সদস্যদের মুখ থেকে প্রবাহিত হতে। ছেলেমানুষী। তবে তোমাকে ধন্যবাদ, এ ব্যাপারে তোমার নিজস্ব উপলব্ধি আমাকে জানানোর জন্য। আর একটা সাধারণ উপদেশ দিচ্ছিঃ দয়া করে অন্ধকারে হাতি দেখা গল্পটির কথা মনে রেখো যখনই তোমাকে তথ্য বা প্রকৃত ঘটনা সম্পর্কে কিছু বলতে হয়। তোমার দাদু-দিদিমার কাছে জিজ্ঞাসা করতে থাকো ... তাদের কাছেই সব উত্তর আছে ... আমি নিশ্চিত ... তারা তোমাকে বলছে না তোমার নিরাপত্তার কথা ভেবেই ... নিশ্চয় গুরুতর কোনো কারণ আছে যে জন্য তারা তোমাকে সত্য বলছে না ... আমি নিশ্চিত তারা তোমাকে ভালোবাসে ... আমি নিশ্চিত তারাও মনে করে ‘সত্য’ তোমার জন্য কল্যাণকর নয়।

 

- আমি ফেস্ বুক এ আমার কিছু ছবি আপলোড করে দেবো। তুমি ওখানে আমাকে দেখতে পাবে।

 

-তোমার অশেষ কৃপা!!!

 

-আমি তোমার কাছে জিনিসপত্র চাই, কারণ আমি চাই তুমি আমার জন্য অন্তত কিছু করো, ভালোবাসা ব্যতিরেকে নিশ্চয়। তুমি যদি আমাকে ভালোবেসে থাকো, আমিও তোমাকে ঘৃণা করি নি।

 

-কে জানে, হয়তো আমি কিছুই করি নি তোমার জন্য। এটাই তবে ‘সত্যি’ হোক।

 

-দেখতেই পাচ্ছো পিতা-মাতা-সন্তানের ভালোবাসা বিশ্বজনীন।

 

-সাধারনভাবে বলতে গেলে ‘হ্যা’। তবে আমরা এক ব্যতিক্রম। তুমি কি করে আমার মতো একজন ঘৃণ্য মানুষকে ভালোবাসতে পারো?

 

-বাই! উত্তরের প্রতীক্ষায় থাকবো।

 

-বাই! তোমার উত্তর পেলে সুখকর বিস্ময়ে আমি নিশ্চয় অভিভূত না হয়ে থাকতে পারবো না।

 

আগের দুখানা চিঠির তুলনায় এই চিঠিতে বাবা-মেয়ের মধ্যে বেশ বাক্য বিনিময় হয়েছে। অহনার কথাগুলো পরস্পর বিরোধী, নির্দিষ্টভাবে ঠিক এই পরস্পর বিরোধী কথাগুলো শুভময়ের কাছে অতটা গুরুত্বপূর্ণ না হলেও, সাধারণভাবে অহনার ‘প্রকৃতি’ শুভময়কে ভাবিয়ে তুলেছে। এ বয়সেই যদি শক্ত-সমর্থ প্রকৃতিটি গঠন করে নিতে ব্যর্থ হয়, তবে কবেই বা আর অহনা পারবে? এই প্রকৃতিই মানুষের ভাগ্য বহুলাংশে নির্ধারণ করে থাকে। বক্তব্যে পরস্পর বিরোধিতা ভাবনার অস্থিরতা থেকেই আসে সম্ভবত। প্রযুক্তির এই যুগে অহনার একটা কম্প্যুটার না থাকাটা অপরাধসম, শুভময় তা জানিয়েছে বটে অহনাকে, তবে তা কিনে দেবার প্রতিশ্রুতি সে কখনই দেয়নি। একপা বাড়িয়ে এই একটু অতিরিক্ত বুঝতে যাওয়া শুভময় মনে করে অহনার চরিত্রের বড় এক দুর্বল দিক। একটু বেশি এবং একটু কম বুঝতে পারা-ই সম্ভবত জীবনে সব ব্যর্থতার প্রধান কারণ। চারিত্রিক গুণাবলীর ভেতর শুভময়ের বড় আশা ছিল কৃতজ্ঞতাবোধটুকু অন্তত অহনার থাকুক। যে কম্প্যুটারটি প্রথম অহনাকে কিনে দেওয়া হয়েছিল তা সেই সময়ে কোলকাতার বাজারে যা পাওয়া গেছে তাই, দামও ছিল তখন চড়া। অহনার দাদু-দিদিমা অবশ্য বায়না ধরেছিলো টাকাগুলো নগদ দিতে। শুভময় রাজি হয়নি, সে তার দাদাকে দিয়ে কিনিয়ে দিয়েছিলো কম্প্যুটারটি। ই-মেইলে বাবার সাথে মেয়ের যোগাযোগ রক্ষা অন্যতম উদ্দেশ্য হলেও, শুভময়ের প্রধান উদ্দেশ্যটি ছিল সমসাময়িক প্রযুক্তির সাথে মেয়ের একটি যোগসূত্র শিশুকাল থেকেই তৈরী করে দেয়া। নিজ জীবনে পাওয়া প্রথম কাগজের খাতাটি নিজ হাতে বানিয়ে দেবার জন্য শুভময় আজো তার লোকান্তরিত ঠাকুরদাকে কৃতজ্ঞতা জানায়, অহনা ঠিক উল্টোটি করাই শিখেছে। কৃতজ্ঞতার বদলে এই তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করাটা অনুরাধার পরিবারে শুভময় আগেও দেখেছে। কৃতজ্ঞতাবোধ বিবর্জিত মানুষকে শুভময় মনে করে মানব সৃষ্টির এক বর্জ্য পদার্থ, যথার্থ মানুষ নয়। ব্যক্তিগতভাবে শুভময়ের প্রতি অহনার কৃতজ্ঞতাবোধ থাকুক বা না থাকুক, তাতে শুভময়ের সেরকম কিছু যায় আসে না, তবে সাধারণভাবে অহনার চরিত্রের এই দিকটি এক বিশেষ দুশ্চিন্তার কারণ।

 

বিশেষ এক প্যাটার্ন চোখে পড়ে, এক নির্দিষ্ট পন্থায় যেন সব ঘটনা পরিবর্ধিত এবং বিন্যস্ত। ঐ যে অহনা লিখেছে, ‘পরিবার বলতে আমি বুঝিয়েছি সেইসব মানুষকে আমার সাথে যাদের রক্তের সম্বন্ধ আছে, বাবা হিসেবে তুমি অন্তর্ভুক্ত। আমি আমার পিতার দিক দিয়ে সম্পর্কযুক্ত আত্মীয়দের নিয়ে কথা বলতে চাই না, কারণ তারা কখনই আমার খোঁজখবর নেবার প্রয়োজনটি বোধ করেনি। অতএব দয়া করে আমার কথাগুলোর অন্যথা-ব্যাখ্যা দিও না।’ ঠিক এই কথাগুলোই কি শুভময় শোনেনি অনুরাধার সাথে বিয়ের পর, অহনার তখন জন্মই হয় নি।মনে পড়ে অনুরাধা, অনুরাধার বাবা, মা, দাদা, এমন কি কাজের ঝিও শুভময়কে জানিয়ে দিয়েছিলো শুধু শুভময় ছাড়া ও পরিবারের আর কারো সাথে মিশবার অভিপ্রায় এ পরিবারের কারোরই নাই। শুভময়, একমাত্র তুমিই ভালো, তুমিই ব্যতিক্রমী, তুমি ছাড়া তোমার অন্য কোনো স্বজন আমাদের সমাজের যোগ্য নয়। এটাই একদিন পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিলো অনুরাধার পরিবার। প্রায় দেড়যুগ পর অহনার চিঠি কি সেই ধ্বনিরই প্রতিধ্বনি নয়? শুভময়ের বাবা যতদিন বেঁচে ছিলেন অহনাকে দেখতে গিয়েছেন শত লাঞ্ছনা, অপমান সহ্য করেও। শুভময়ের ভাইবেনেরাও চেষ্টা করেছে যতটুকু সম্ভব। এই যে বিশেষভাবে শুভময়ের আত্মীয়দেরকে অপমান করা, এ বাড়ির ত্রিসীমানায় আসতে না দেয়া, এই সবের পিছেই কি লুকিয়েছিলো না একদিন বড় হয়ে অহনার মনে পিতৃকূলের বিরুদ্ধে এক তীব্র বিরাগ তৈরী করার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র? এ জাতীয় ষড়যন্ত্রে ক্ষতি ছাড়া কি লাভ হয় কে জানে, তবু এই এক বিকৃতি থেকে কিছু মানুষ মুক্তি পায় না কিছুতেই।

 

অহনা কন্যা সন্তান, তার মায়ের প্রয়োজনীয়তা ছিল বলেই শুভময় তাকে স্বেচ্ছায় দাদু-দিদিমার হাতে তুলে দিয়েছিলো? আত্মপক্ষ সমর্থন মানুষকে হয়তো খানিকটা অন্ধ বানিয়ে দেয়, আত্মপক্ষ সমর্থন দোষের নয়, তবে মানুষের যুক্তিবোধের বিনষ্টি শুভময়কে পীড়িত করে। শুভময়ের পুনর্বিবাহই যুক্তিযুক্ত হতো অহনার মায়ের শুন্যস্থানটি পূর্ণ করার মতো ব্যাপারটা সহজ হলে। শুভময় নিজে, তার বাবা মা, আত্মীয়স্বজন অনেক চেষ্টা করেছিলো অহনাকে নিজের কাছে রাখতে। অহনার দাদু-দিদিমা সাঙ্গপাঙ্গ ডেকে, নানাবিধ হুমকির মুখে শুভময়কে বাধ্য করেছিলো সাময়িক ভাবে তাদের কাছেই শিশুটিকে রেখে আসতে। অহনা যে তার দিদিমাকে মা বলে ডাকে, সেটাও খুব শ্রুতিমধুর বলে মনে করে না শুভময়। এই সাময়িক তত্ত্বাবধানের সময়সীমা অহনার স্বেচ্ছাচারী দাদু-দিদিমা নিজেরাই ফলত নির্ধারণ করেছিলো। তাদের গোয়ার্তুমির কারণেই শুভময় শত চেষ্টা করেও মেয়েকে নিজের সাথে বিদেশে নিয়ে আসতে পারেনি, পারলে শুভময়ের নয় অহনারই লাভ হতো আজ।

 

 

দীর্ঘ আঠারো বছর পর, শুধু এক অপ্রত্যাশিত ক্ষণেই, জীবন কি শুভময়ের হাতে তুলে দিলো দ্বন্দ্বযুদ্ধের এক ডাকচিঠি? দীর্ঘ আঠারো বছর ধরে যাকে জেনে আসছো তোমার নিজের সন্তান বলে, সে আর তোমার নয় l জীবন কি আর কোনো দ্বিতীয় সময় পেলো না এই নিষ্ঠুর চ্যালেঞ্জের? নাকি শুধু শুভময়কেই পরীক্ষা? কিসের এই পরীক্ষা? শুভময়ের বীরত্বের? শুভময়ের জীবনে পরিবর্তনের আকাঙ্খা কতটা গভীর, সেটাই পরখ করে দেখছে কেউ ? কোন ছুতোয় এখন শুভময় ভান করে থাকবে যেন কিছুই ঘটেনি ? কাকে গিয়ে বলবে সে এখনো তৈরী নয়? দ্বন্দ্বযুদ্ধের ডাক এসে গেলে প্রত্যুত্তর দিতে হয় তাত্ক্ষণিকভাবে l জীবন তাকায় না পিছনে ফিরে l অহনা ঠিক বুঝেছে l অহনাও তাকায়নি পিছনে ফিরে l তার শেষ কথা কটি : “সো হিয়ার, ড. শুভময়, ডু আই এন্ড অল মাই টার্মস আন্ড রিলেশন উইথ য়্যু ”

 

অহনার চিঠিগুলো সময় পেলেই শুভময় পড়তে বসে l শেষের চিঠিগুলো দিয়েই শুরু করে সে, খানিকটা স্মৃতিচারণের মতো, হয়তবা শুভময়ের একারই এমনধারা বামাবর্তী চলন l মাঝ বয়সটিই কি নয় ঘড়িরকাটার উল্টো দিকে চলার সেই সময়? চট করে শিশুকালের স্মৃতি মনে করতে পারে না শুভময়, একটু করে পিছোতে হয় তাকে, একটু করে এগুতে হয় তাকে l বাইশে ডিসেম্বর ২০১০ এ লেখা অহনার চিঠির উত্তর দিয়েছিলো শুভময় তেইশে ডিসেম্বর ২০১০ l অহনার চরিত্রের যে দিকটা তার ছিঠিগুলোতে ফুটে উঠছে তা দেখে শুভময় মেয়েকে নিয়ে বেশ শঙ্কিত l বাবা-মেয়ের মধ্যে একটা হাসি-ঠাট্টার ব্যাপার থাকলেই ভালো বলে শুভময় মনে করে l খানিকটা রঙের ছোয়া তরুণী কন্যার ভালো লাগবে মনে করে সে লাল ফন্টে ফরম্যাট করে অহনার কথা, নীল ফন্টে নিজের উত্তর l হাসি-ঠাট্টার উপকরণ হিসেবে বিদ্রোহী এবং মারমুখো বিশেষণ দুটি জুড়ে দেয় যথাক্রমে অহনা ও বাবা শব্দ দুটির সাথে l অহনার আদৌ ভালো লাগেনি বাবার এই রং-বেরঙ্গের ঢং l

 

বিদ্রোহী অহনা : হাই পাপা

 

মারমুখো বাবা : হাই মাই চাইল্ড !

 

বিদ্রোহী অহনা : মনে পড়ে আমি বলেছিলাম তোমাকে চিঠি পাঠাবো? দিস ইজ ইট l

 

মারমুখো বাবা : অনেক ধন্যবাদ !

 

বিদ্রোহী অহনা : আমি আসলে আমার মনের একটি কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা/ সন্দেহ দূর করতে চাই l

 

মারমুখো বাবা : কারোরই উচিত নয় তার মনকে কিংকর্তব্যবিমূঢ়তা বা সন্দেহের বিষে দূষিত করা l

 

বিদ্রোহী অহনা : আমি প্রকারান্তরে যাবো না, বরং মূল পয়েন্টেই সরাসরি আসবো l

 

মারমুখো বাবা : ব্রাভো !

 

বিদ্রোহী অহনা : এ বছর মে মাসে আমি তোমার কাছে কিছু চেয়েছিলাম কারণ তুমিই চাইতে বলেছিলে l

 

মারমুখো বাবা : ইয়েস হানি, আমার মনে আছে l

 

বিদ্রোহী অহনা : তোমার উত্তর ছিল স্পষ্টতই “না” l

 

মারমুখো বাবা : হ্যা হানি, ঠিক যতটা সরাসরি উত্তরের দাবী তুমি করেছিলে ততটাই সরাসরি উত্তর হিসেবে “না” ছাড়া অন্য কোনো শব্দ আমার মাথায় আসে নি l

 

বিদ্রোহী অহনা : এ আমার কাছে খুব অপমানজনক ছিল পাপা l

 

মারমুখো বাবা : তুমি আহত হয়েছ জেনে খুব দুঃখিত l অনুগ্রহ করে আমাকে ক্ষমা করো l আমি তোমাকে অপমান করতে মোটেও চাই নি l “অপমান” আসলে এক বিস্ময়কর আলোচ্য বিষয় যার উপর সাহিত্য কর্ম রচিত হতে পারে ..... “ক্রাইম অ্যান্ড পানিশ্‌মেন্ট”, “ওয়ার অ্যান্ড পিস্” নামে বই আছে বটে, আমি “অপমান” এবং এজাতীয় মানবিক অনুভুতির উপর ভালো কোনো লেখার কথা শুনিনি lপারলে আমি নিজেই একটি উপন্যাস না হলেও অন্তত একটি ছোট গল্প লিখে ফেলতাম ‘অপমানিত বোধ করা’র উপর l মূল প্রসঙ্গ থেকে বিচ্যুতির জন্য দুঃখিত l বুড়ো বয়েস, বুঝতেই পারছ l

 

বিদ্রোহী অহনা : আমি জানি আমি কখনই এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন করি নি, তবে ব্যাপারটা আমার কাছে এক রহস্য রয়ে গেছে l

 

মারমুখো বাবা : জীবন নিজেই এক রহস্য, হানি lসে কারণেই অধিকাংশ মানুষ তাকে ভালোবাসে l

 

বিদ্রোহী অহনা : সেদিন কি হয়েছিল পাপা?

 

মারমুখো বাবা : সেদিন কিছুই হয় নি l তোমার হতাশা লাঘবের জন্য আমি তোমাকে মধুর মিথ্যে বলতে পারবো না ... আমি তোমার ভরণপোষণের দায়িত্ব বহন করতে পারছি না কারণ আমার প্রবল আপত্তি স্বত্ত্বেও অন্য কেউ একদিন তোমার রক্ষণাবেক্ষণের সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিয়েছিলো l আমি এখনো মনে করি মূলত এ ছিল অত্যন্ত অবৈধ এবং অন্যায়, তোমার জীবনের সাপেক্ষে, সেই সব সমস্যার সাপেক্ষে যার মখোমুখি হতে হচ্ছে তোমাকে আজ, যার মুখোমুখি তোমাকে হতে হবে সম্ভবত আগামীতে, সামাজিক এবং আর্থিক উভয় ক্ষেত্রেই l তবে হ্যা, আমি সব সময়েই তৈরী রয়েছি তোমাকে সাহায্য করতে – যতটা পারি l

 

বিদ্রোহী অহনা : সেদিন কেন এভাবে তোমার কন্যাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলে?

 

মারমুখো বাবা : আবারও দুঃখিত তোমাকে আহত করে থাকলে, ডিয়ার lকোনো সম্পর্কই শুধুমাত্র অর্থের উপর ভিত্তি করে নির্মিত হওয়া উচিত নয় l তোমার ‘বাবার প্রতি ভালোবাসা’ টাকা দিয়ে কেনার কোনো প্ল্যান নেই আমার lঅবশ্যই এই বুড়ো মানুষটির খুব ভালো লাগতো হয়তো ভালোবাসার প্রতিদানে খানিকটা ভালোবাসা পেলে, তবে এ এক দুরূহ বিষয় , হয়তো আমাদের ভাগ্য-গ্রন্থে এ লেখা নেই l

 

বিদ্রোহী অহনা : সব কিছুরই নিশ্চয় কোনো কারণ থাকে l

 

মারমুখো বাবা : হ্যা ডিয়ার, কিছুই কখনো সংঘটিত হয় না যা হওয়া উচিত নয় lযে হয়তো এইসব কারনগুলো জানে সে আমি নই l

 

বিদ্রোহী অহনা : তুমি তোমার কারণ আমাকে বলো l

 

মারমুখো বাবা : কারণ আমার নেই তোমার রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষমতা lকি কারণে আমি হারালাম তোমার কাস্টডি? হয়তো খুবই সন্তোষজনক কারণ কোথাও লুকিয়ে আছে...আমি সেসব খুঁজে দেখি নি lকারনগুলো খুঁজে পাওয়া হয়তোবা তোমার জন্য অপরিহরণীয় ভাবেই মঙ্গলকর হবে তা নয় lযাই ঘটুক না কেন, তুমি আমার “কন্যা” l

 

বিদ্রোহী অহনা : আমার এখন ১৭ বছর, তোমার কারণ যাই থাকুক না কেন তা বুঝবার জন্য যথেষ্ট বয়স l

 

মারমুখো বাবা : তোমার এখন ১৭ এবং বয়স যদি সত্যি পর্যাপ্ত হয়ে থাকে নিজেকেই প্রশ্ন করো, তুমি উত্তরগুলো খুঁজে পাবে l

 

বিদ্রোহী অহনা : দেখো, আমি তোমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উত্থাপন করছি না l

 

মারমুখো বাবা : ‘বিচার ক্ষমতা এবং বিচক্ষণতা’ তোমাকে নিজেকেই অর্জন করতে হবে ...’অভিযোগ’ শব্দটি আপত্তিকর ... আমি অনেক সময়ই অনেক সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছি বটে , আজও কোনো অভিযোগে অভিযুক্ত হই নি l

 

বিদ্রোহী অহনা : আমার পরিবার এখনো আমার কাছে আমার জীবন l

 

মারমুখো বাবা : আমি খুব সুখী তোমার জন্য, মাই চাইল্ড lযখন কেউ খুব সুখী থাকে, তখন অন্য কোনো কিছুতেই কিছু যায়-আসে না l

 

বিদ্রোহী অহনা : একটা সময় আসবে যখন এই সবের কোনো অর্থ থাকবে না আমার কাছে l

 

মারমুখো বাবা : ‘সময়’ বড় চতুর; সব সময়ই কিছু একটা এসে পড়বে যা তোমাকে এবং আমাকে উভয়কেই বিপাকে ফেলবে এক নির্দিষ্ট ভাবে lআশা করি এমনটা না ঘটুক l

 

বিদ্রোহী অহনা : একদিন আমার নিজের ফ্যামিলি এবং ক্যারিয়ার হবে l

 

মারমুখো বাবা : আমি খুব সুখী, তোমার জন্য আমার কি যে আনন্দ হচ্ছে !

 

বিদ্রোহী অহনা : তবে সেই জীবনমুখো যাবার আগে আমি আমার অতীত এবং বর্তমানকে পরিষ্কার দেখে যেতে চাই l

 

মারমুখো বাবা : আমি তোমাকে ভালবাসছি তোমার জন্মের দিন থেকেই, আমি তোমাকে ভালবাসি এখন, আমি তোমাকে ভালোবাসবো আমার দূর জীবনাবসানের দিন পর্যন্ত lপৃথিবীতে আর কোনো মানুষেরই অস্তিত্ব নেই যে তোমাকে আমার চেয়ে বেশি ভালোবাসে – এই সত্যই তোমার সন্নিকৃষ্ট অতীত ও বর্তমান lতোমার অতীত সম্পর্কে আমি যা জানি তা হলো একসময় আমিই ছিলাম তোমার গোটা পৃথিবী lতোমার বর্তমান সম্পর্কে আমি যা জানি তা হলো তোমার মনে হয় তোমার এবং আমার মধ্যেকার বন্ধনটি এখন পুরোপুরিই বিচ্ছিন্ন l তুমি আমাকে ঘৃণাও করো না l ঘৃণাও এক ধরনের অনুভুতির সঙ্গে জড়িত থাকে lআমার খুব মনে হয় আমাদের দুজনকেই বড় অসহায় ভাবে টেনে বা আছড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ক্ষতিকর এক ইঁদুর ধরার ফাঁদের দিকে l

 

বিদ্রোহী অহনা : এ আসলেই ঘোলাটে lআমি জানতে চাই কি তোমাকে এমন বাধ্য করলো তোমার লম্বা দাবি-দাওয়া-প্রতিশ্রুতিকে হঠাত পৃষ্ঠ প্রদর্শন করতে l

 

মারমুখো বাবা : কাস্টডি l

 

বিদ্রোহী অহনা : দেখো, আমি তোমার শত্রু নই l

 

মারমুখো বাবা : তুমি শুধুমাত্র আমার বিদ্রোহী কন্যা l অনেক মানুষ আছে যারা আমাকে ঘৃণা করে, যারা আমাকে ভালো বাসে না, তবে আমি নিশ্চিত আমার শত্রু নেই l

 

বিদ্রোহী অহনা : তোমার আর আমার মধ্যে যুদ্ধ নেই l

 

মারমুখো বাবা : তোমার আর আমার মধ্যে কখনই যুদ্ধ ছিল না l

 

বিদ্রোহী অহনা : তোমার সাথে আমার যখনই কথা হয় আমার কেন মনে হয় তুমি আমাকে কথা দিয়ে হারাতে চাচ্ছো, আমি তোমার সাথে আর যুদ্ধ করতে চাই না, আফটার অল এ তো আর ফিরিয়ে দেবে না আমার ১৭ বছর l

 

মারমুখো বাবা : আমার কথাগুলোর বিভ্রান্তিকর ইন্টারপ্রিটেশন সম্ভবত তোমাকে ভাবতে বাধ্য করছে যে আমি তোমাকে হারাতে চেষ্টা করি, চিত্কার করে তোমাকে থামিয়ে দিই...আমরা দুজন (তুমি এবং আমি) একই পাতাটি পড়ছি; দুজনেরই একই প্রশ্ন –তা আজ পর্যন্ত ১৭ টি বছর কে ঘিরে l

 

বিদ্রোহী অহনা : আমি চাই না বারবার তোমাকে সব কিছুর ব্যাখ্যা দিয়ে ক্লান্ত হতে l

 

মারমুখো বাবা : নিশ্চয় হানি, ব্যাখ্যার অতীত কোনো কিছুকে ব্যাখ্যা দিতে যেও না; এ বড্ডো ক্লান্তিকর l

 

বিদ্রোহী অহনা : আমি কি তোমাকে পরিষ্কার বুঝাতে পারলাম ?

 

মারমুখো বাবা : আমি যে তোমাকে যথারীতিই বুঝছি এ ব্যাপারে তুমি নিশ্চিন্ত থেকো lতুমি এবং আমি – এ দুজনই সাফার করেছে lঅন্য কেউ কখনই বিশেষ কেয়ার করে নি l

 

বিদ্রোহী অহনা : আমি জোর করছি তুমি যাতে এবার কোলকাতায় আসো কারণ এটাই হয়তো আমাদের দেখা হওয়ার শেষ সুযোগ l

 

মারমুখো বাবা : এ যদি তোমার বিয়ের ব্যাপার হয়ে থাকে তবে আমাকে জানিও lআমি তোমার বিবাহ উত্সবে উপস্থিত থাকতে চাই, অবশ্য যদি তুমিও তা চাও l

 

বিদ্রোহী অহনা : তুমি বুড়ো হয়ে যাচ্ছ (তোমার কথা অনুযায়ী) আর আমারও সম্ভাবনা কম তোমার দেশে যাবার কারণ আমার অন্য প্রেফারেন্সেস রয়েছে l

 

মারমুখো বাবা : আমি সত্যি বুড়ো হচ্ছি, চোখের অবস্থা ভালো নয় – অন্ধও হয়তো হতে হবে একদিন, তবে শিগগিরই মারা যাবার আমার কোনো প্ল্যান নেই lঅবশ্যই পছন্দ অনুসারে বেছে নেবার অধিকার তোমার আছে lঅতীতে আমি বারবার পিড়াপিড়ি করেছি ক্যানাডায় তোমার মাইগ্রেশনের ব্যাপারে কারণ এ আমার সন্তান হওয়া সুত্রে প্রাপ্য তোমার এক অধিকার lআমি বারবার এ সুযোগ সম্পর্কে তোমাকে নোটিফাই করেছি l তবে আমি মেনে নিচ্ছি তুমি যদি অন্য কিছু পছন্দ করে বেছে নাও l আবারও বলি ‘বিচার ক্ষমতা এবং বিচক্ষণতা’ তোমাকে নিজেকেই অর্জন করতে হবে l

 

বিদ্রোহী অহনা : আমার সাথে তোমার একবারও দেখা হয় নি বিগত ১৪ বছরে l

 

মারমুখো বাবা : আমি এমন কি তোমার ছবি ও দেখি নি lআর সামান্য একটু সময় পেরুলে আমি হয়তো চোখের কারণে দেখতেই পাবো না, তুমি তোমার কিছু ছবি পাঠালেও l তবে এ ঠিক আছে lতোমার বিচার ক্ষমতা, বিচক্ষণতা - তোমার নিজের ব্যক্তিগত l

 

বিদ্রোহী অহনা : একদিন এক সময় হয়তো আসবে যেদিন আমরা ব্যাকুল হয়ে উঠবো এক অপরকে দেখার জন্য, তবে পরিস্থিতি হয়তো অনুকূলে থাকবে না l

 

মারমুখো বাবা : আমার তা মনে হয় না lআমার এখন ও ইচ্ছে করে নানা হতে; আমি এখনো নাতি-নাতনি দেখে যেতে চাই l

 

বিদ্রোহী অহনা : আমি এখানে তোমার দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি তা নয় l

 

মারমুখো বাবা : আমি কারো জন্য বা কোনো কিছুর জন্য দায়বদ্ধ নই lআশা করি তুমি বুঝবে l

 

বিদ্রোহী অহনা : তোমার কর্তব্য পালনের অভাবে আমার কোনো দুর্ভোগ হয় নি l আমি চাই না আমার প্রয়োজনেই শুধু তুমি আমার ভরণ পোষণ এর ভার বহন করো l

 

মারমুখো বাবা : তোমার জন্য তো ভালই, তাই নয় কি? তোমাকে লেগে থাকতে হবে এবং পূর্বাপর সঙ্গতি অব্যাহত রেখে চলতে হবে lতোমার বিশিষ্ট বুদ্ধিবৃত্তি, কেতাদুরস্ততা এবং দূরদর্শিতার উপর ভিত্তি করে আমি নিশ্চিত যে তুমি তোমার নিজের এই কথাগুলো এখন থেকে চিরকালের জন্য মনে রাখবে l

 

বিদ্রোহী অহনা : আমি বরং আশা করেছিলাম আমাকে সাহায্য করার অনুভূতিটুকু তোমার নিজের ভিতর থেকে আসুক l

 

মারমুখো বাবা : আমি তোমাকে যতটা সাহায্য করেছি এবং করবো, পৃথিবীর অন্য কোনো মানুষই ততটা করবে না lআশা করি তুমি বুঝবে একদিন l

 

বিদ্রোহী অহনা : আমি জানি তুমি আমাকে ভালোবাসো lকিন্তু এ আমার নিছক এক জ্ঞান ছাড়া আর কোন অনুভূতি তো নয় lআমি তোমার ভালোবাসা অনুভব করতে চাই l

 

মারমুখো বাবা : ইচ্ছা থাকলে উপায় হয় lউপায়টি খুঁজে পেতে হবে শুধুই তোমাকে l

 

বিদ্রোহী অহনা : তোমার কি মনে হয় আমাকে আমার বরের কাছে বলা উচিত্ যখন সে আমাকে জিজ্ঞেস করবে আমার বাবা সম্পর্কে???

 

মারমুখো বাবা : তাকে বলো, “ আমি যতদুর জানি আমার বাবা এক জ্বলন্ত অঙ্গার – উত্তাপে পরিপূর্ণ, তবু বিপজ্জনক নয় মোটেও :)” l বরকে বলার মতো খুব কম কিছুই আছে সে যদি তোমাকে জিজ্ঞেস করে তোমার বাবা সম্পর্কে এ বুঝবার তোমার ক্ষমতাকে আমি প্রভূত মূল্য দিই lদুঃখজনক ! সভ্য দুনিয়ায় গ্রহনযোগ্য নয় l যেসব মানুষকে তুমি আজ তোমার পরিবার বলছো তাদেরকে ছোট করা আমার অভিপ্রায় নয়; তারাই তোমার পরিবার – আমি এ বুঝতে পারি; সত্যিই তো তাঁরাই তোমার প্রিয়জন, তাঁরাই তোমাকে কোলে পিঠে বড় করেছে lআমি মনে করি তাঁদেরই ১৪ বছর আগে ভাবা উচিত ছিল তুমি কি বলবে তোমার বর তোমার বাবা সম্পর্কে কিছু জানতে চাইলে, ১৪ বছর আগে যেদিন তাঁরা তোমাকে কেড়ে নিয়েছিলো আমার থেকে তাঁরা তা ভেবে দেখেন নি? তোমার কল্যাণের কথা ভেবেই আমি সহ্য করেছি সব lপরামর্শ চাইতে তুমি এখন তাঁদের কাছেই যাও lযদিও উভয়ই মিথ্যে, তোমার মাত্র দুটো অপশন আছে :

 

১. তোমার ভবিষ্যত বরকে বলো তোমার বাবা একজন ঘৃণ্য মানুষ, তোমার মায়ের মৃত্যুর পর যে তোমাকে পরিত্যাগ করেছে; তুমি যদি তাই বলো তবে একটা সম্ভাবনা থেকে যায় তোমার বর এই পরিস্থিতির সুযোগ নেবে যখনই তোমাদের মধ্যে কোনো দাম্পত্য কলহ বাঁধবে l

 

২. তাকে বলো তোমার বাবা তোমাকে ভারতীয় সংস্কৃতিতেই বড় করতে চেয়েছিলো; এক্ষেত্রে তোমাকে আমার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলতে হবে l

 

বিদ্রোহী অহনা : আমি চাই/ আমার দরকার একটি কম্প্যুটার এবং আমি চাই তুমিই তা কিনে দাও আমার জন্য lআমি আশা করি তোমার জন্য এ এমন কিছু কঠিন হবে না l

 

মারমুখো বাবা : তোমার প্রয়োজনে বাজারের সেরা কম্পিউটারটি কিনে দেবার সামর্থ্য আমার আছে এবং কিনে হয়তো দিতামও l তবে এ তোমার কাছে আদৌ আমার ভালোবাসা অনুভব করার কাজে আসবে না lতোমার তো ব্যতিক্রমী পরিণামদর্শী এক পরিবার (তোমার জীবন-প্রায়) আছে, সেই পরিবার এক ১৭ বছরের তরুণীকে একটি কম্পিউটার কিনে দিতে পারে নি l তাছাড়া আমার কর্তব্য পালনের অভাব তোমাকে কোনো অসুবিধার সৃষ্টি যখন করে নি, তবে কেন এখন তুমি চাও যে আমি তোমাকে কম্পিউটার কিনে দিই? ইয়েস হানি, এ বেশ কঠিন কারণ এই নয় যে আমার অর্থকড়ি নেই, কারণ এই নয় যে আমি কিনে দিতে চাই না, কারণ এই যে আমার “কাস্টডি” নেই l

 

বিদ্রোহী অহনা : ওকেই দেন্ , গুড বাই l আমি তোমার উত্তরের প্রতীক্ষায় রইলাম l

 

মারমুখো বাবা : এখনকার জন্য চলি lযোগাযোগ রেখো আর তোমার ছবি পাঠিও আমি পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যাবার আগে l তোমাকে ভালবাসি অহনা l

 

 

দূর যাত্রার ভ্রমণের বেলায় কার-পুলিং বা রাইড-শেয়ারিং ই শুভময়ের পছন্দ; একজন অপরিচিত মানুষের সাথে দীর্ঘ সহযাত্রায় এক ধরনের আনন্দ আছে, সময়টাও ভালো কাটে, একটানা নিজেকে ড্রাইভও করতে হয় না, কিছু টাকাও বাঁচে। এগলিন্টন আর ডন মিলস এর চৌরাস্তায় বাস স্টপে শুভময়ের ধাতব-ধূসর হন্ডা-সিভিক গাড়িটি থামতেই শুভ্র-দাড়ি-মুখো বুড়ো ভদ্রলোকটি ডান পাশের আসনে উঠে বসলেন । -নাইস টু মিট য়্যু, শুভ। -ভেরি নাইস টু মিট য়্যু, মার্টিন । টরন্টো থেকে ন্যুয়র্ক সিটি –প্রায় সাড়ে আট ঘন্টার পথ, তবে এবার লাগবে প্রায় দশ ঘন্টা, একটু ঘুরে অলবাণী শহরে সহযাত্রীকে ড্রপ করে যেতে হবে। বুড়ো ভদ্রলোককে শুভময়ের বেশ পছন্দ হয়েছে, ওঁর নাম মার্টিন, পেশায় আইনজীবী, কথা বলতে ভালোবাসেন, দারুন রসিকতা বোধ আছে । টরন্টো শহরের অট্টালিকাময়তা পিছনে ফেলে গার্ডনার এক্সপ্রেসওয়েতে ঢুকেই শুভময় তৃপ্তির হাসি হাসলো। মার্টিনও বেশ ফুর্তির মেজাজে আছে, জমিয়ে গল্প শুরু হলো । গল্প বলতে প্রধানত পালা করে হাসি-ঠাট্টার গল্প। ঘন্টায় একশো পনেরো কিলোমিটার বেগে চালাচ্ছে শুভময়, এর বেশি স্পিড তুলতে সাহস হয় না, এখানে সর্বোচ্চ বিধিসম্মত গতি ঘন্টায় একশো কিলোমিটার, তবে অধিকাংশ গাড়িই চলছে কম পক্ষে ঘন্টায় একশো পঁচিশ কিলোমিটার বেগে। টরন্টো থেকে ন্যুয়র্ক কুইন্ স্টন ল্যুয়িস্টন বর্ডারে যেতে দু’ঘন্টার কম সময় লাগে। এ দু’ঘন্টায় সামান্য আলাপ পরিচয় আর হালকা রসিকতা ছাড়া বড় কোনো গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয় নি। বর্ডার পেরুলে আসন বদল হলো । ডিজিটাল ড্যাশে গতিমাত্রা এখন মাইলে দেখাচ্ছে । ইন্টার-স্টেট নাইনটি তে পোস্টেড মাক্সিমাম স্পিড ঘন্টায় ৬৫ মাইল, মার্টিন চালাচ্ছে পচাত্তরে । আমেরিকান বার অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য মতে এখানে প্রায় ১,১৪৩,৩৫৮ জন আইনজীবী। আমেরিকার জনসংখ্যা ৩১২, ৭১৯, ০০০ । অর্থ হয় ২৭৩ জন প্রতি একজন উকিল, পৃথিবীর আর কোনো দেশে এত উকিল আছে বলে জানা নেই । সারা দেশটাই সর্বক্ষণ মেতে আছে কোনো না কোনো মামলা মোকদ্দমায় । সেই কবে অহনা তার চিঠিতে হুমকির সুরে লিখেছিলো সে আইন পড়ছে, প্রত্যুত্তরে সেই কবে শুভময় একবার প্যাটার্নিটি টেস্টের কথা জানিয়েছিলো তাদেরকে, তারপর আর কোনো সাড়া শব্দ নেই, কত সময় পেরিয়ে গেলো তারপর, কত সময় মিথ্যে অপেক্ষায় পেরিয়ে গেলো শুভময়ের। এত বড় অপমানের, এত বড় চ্যালেঞ্জের কোনো প্রত্যুত্তর করলো না অহনারা। কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে পড়ার ভয়েই অহনারা কিছু করতে চায় না। এ-তো গেলো আহনাদের কথা, শুভময়ের কি কথা? কি চায় শুভময়? লোকান্তরিত অনুরাধার কুত্সা রটানোর কোনো অভিপ্রায় নেই শুভময়ের, কন্যা-প্রতিম অহনার অমঙ্গলে কোমর বেঁধেছে সে, তাও নয় মোটেও। শুভময় যা চায় তা হলো, তার জীবদ্দশায় অহনা ফিরে পাক তার জন্মদাতা জনককে । অহনা জানুক শুভময় নয় সেই জনক জন্মদাতা। ঘৃণা-বিদ্বেষের অন্ধকার পৃথিবীতে শান্তির আলো দেখে যেতে পারলেই শুভময়ের শান্তি । নিজে শুভময় উঠে গেছে পার্থিবের উর্ধ্বে। সেই উচ্চতায় আজ আর কোনো মাধ্যাকর্ষণ শক্তি অবশিষ্ট নেই। সেখানে মোহ মমতা নেই । হাসি রাশি নেই, প্রেম পিরিতি নেই।

 

দু’পাশের বিশাল দুই ট্রেইলার পেরিয়ে গাড়িটা একটু ফাঁকা রাস্তায় এসে পড়তেই শুভময় মার্টিনকে জানালো ওকালতি পেশাটাকে তার খুউব ইন্টারেস্টিং মনে হয়। এই যেমন প্যাটার্নিটি ল স্যুট – প্রাগ্রসর বিজ্ঞানের ভুমিকা এখানে অসাধারণ, আধুনিক প্যাটার্নিটি ডি এন এ টেস্ট ৯৯.৯ % এর বেশি ইনক্লুঝন আর ১০০% ইক্সক্লুঝন গ্যারান্টি দিচ্ছে । শুভময়ের এ কথায় মার্টিন হো হো করে হেসে উঠলো। আধুনিক বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা নিশ্চয় আছে, তবে আইনের দৃষ্টি আর বিজ্ঞানের দৃষ্টি এক নয়, ১০০% বিজ্ঞান সম্মত এভিডেন্স আইনের জগতে আদৌ স্বীকৃত নাও হতে পারে । তোমাকে একটা গল্প শোনাই, ১৯৮৭ সালের কথা, ডেবরা ওভারবি নামের এক মহিলার এক পুত্র সন্তান জন্ম গ্রহণ করে। ডেবরা ওভারবি যেহেতু সন্তানের জন্য সরকারী ভাতার উপর নির্ভরশীল ছিলেন, তাকে ডিভিশন অব চাইল্ড সাপোর্ট এনফোর্সমেন্ট (ডি সি এস ই) কে বাবার কাছ থেকে সন্তানের ভরণ পোষণের টাকা আদায়ের অধিকার দিতে হয়। ১৯৯২ সালে ডি সি এস ই ডেবরাকে সন্তানের বাবার নাম শনাক্ত করতে বলে; ডেবরা, সন্তানের বায়োলজিকাল ফাদার হিসেবে উইলার্ড এডওয়ার্ড স্টাম্পের নাম বলেন । স্টাম্প স্বেচ্ছায় প্যাটার্নিটি টেস্টিংএ রাজি হয়, তবে টেস্টের ফলাফল চূড়ান্ত ভাবেই তাকে সন্তানের বায়োলজিকাল ফাদার হিসেবে বাতিল করে । স্টাম্পকে সম্ভাব্য বাবা হিসেবে বাদ দেবার পর, ডি সি এস ই ডেবরাকে আবারও সন্তানের বাবার নাম শনাক্ত করতে বলে। এবার ডেবরা, জেমস ফ্লেনেয়ারির নাম শনাক্ত করেন সন্তানের বাবা হিসেবে । ডি সি এস ই এবার ফ্লেনেয়ারির বিরুদ্ধে পিতৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং সন্তানের ভরণ পোষণের দাবি জানিয়ে দরখাস্ত দায়ের করে। কোর্ট চারজনের ডি এন এ রক্ত পরীক্ষার অর্ডার দেয় । সেই চারজন - মা ডেবরা ওভারবি, শিশু জেরাল্ড লি ওভারবি, ফ্লেনেয়ারি এবং ফ্লেনেয়ারির ভাই। ডি এন এ পরীক্ষার ফলাফল ফ্লেনেয়ারির ভাইকে সম্ভাব্য বাবা হিসেবে বাতিল করে । ফ্লেনেয়ারিকে পরীক্ষার বেলায় ল্যাবরেটরিটি তুলনামূলক পরীক্ষার জন্য জনক এবং সন্তানের রক্ত থেকে ছ’জোড়া জেনেটিক সিস্টেম সংগ্রহ করে । ফ্লেনেয়ারির ছ’য়ের ভেতর পাঁচটি প্রোবই জেরাল্ড লি ওভারবির প্রোবের সাথে মিলে যায়, ল্যাবরেটরির হিসেব অনুযায়ী, এই ফেনোটাইপ তুলনাসমূহই ফ্লেনেয়ারির পিতৃত্বের ৯৯.৯২ % সম্ভাবনাকে প্রতিষ্ঠা করে । ল্যাবরেটরির রিপোর্ট অনুযায়ী, এই ক্যালকুলেশনের ভিত্তি ছিল আমেরিকান এসোসিয়েশন অব ব্লাড ব্যাঙ্কস এর গাইডলাইন । এভিডেনশিয়ারী হিয়ারিংয়ের সময় ডেবরা ওভারবি স্বীকার করেন যে, তিনি পূর্বে এক এফিডেভিটে স্বাক্ষর করে উইলার্ড এডওয়ার্ড স্টাম্পের নাম উল্লেখ করেছেন সন্তানের জনক হিসেবে এবং তিনি ডি সি এস ই প্রতিনিধিদেরকে বলেছেন যে, ফ্লেনেয়ারি, জেরাল্ড এর বাবা নয়। ওভারবি এই মর্মে স্বাক্ষ্য দেন যে, তিনি পূর্বে স্টাম্পের নাম উল্লেখ করেছেন সন্তানের জনক হিসেবে কারণ গর্ভধারণের সময়টিতে স্টাম্প এবং ফ্লেনেয়ারিই ছিলেন সেই দূ’জন পুরুষ যাদের সঙ্গে তার সেক্শুয়াল রিলেশনস ছিল, তাছাড়া ফ্লেনেয়ারি তাকে বলেছিলেন তিনি সন্তানের বাবা হতে সক্ষম নন । ওভারবি আরও স্বাক্ষ্য দেন যে, তিনি ফ্লেনেয়ারির সাথে প্রথম যৌন সঙ্গমে মিলিত হন ১৯৮৬ সালে জুলাইয়ের ৬ তারিখে। ফ্লেনেয়ারি স্বাক্ষ্য দেন যে, প্রথমবারের মতো যৌন সঙ্গমে মিলিত হবার সময় ওভারবি তাকে বলেছিলেন যে তিনি অলরেডি গর্ভবতী । সন্তানের জনক হিসেবে তিনি নিজেকে অস্বীকার করেন, অধিকন্তু তিনি ওভারবিকে দেওয়া ধাত্রীবিদ্যাবিশারদের মেডিক্যাল রেকর্ড দাখিল করেন যেখানে উল্লেখ আছে যে, গর্ভধারণ সম্ভবত শুরু হয়েছিল ১৯৮৬ সালের জুন মাসের প্রথম দিকে। অথচ ওভারবি স্বাক্ষ্য দিয়েছেন যে, তিনি ফ্লেনেয়ারির সাথে প্রথম যৌন সঙ্গমে মিলিত হন ১৯৮৬ সালে জুলাইয়ের ৬ তারিখে। ওভারবি এবং ডি সি এস ই’র পিতৃত্ব-প্রমানের ব্যর্থতার কারণে ট্রায়াল কোর্টে ওভারবির স্বাক্ষ্য বিভ্রান্তিকর হিসেবে বিবেচিত হলো, এবং যেহেতু ফ্লেনেয়ারি সন্তানের জনক হিসেবে নিজেকে অস্বীকার করেছেন, এবং ডি এন এ টেস্টিংয়ে অন্তত একটি জোকার আছে, ট্রায়াল কোর্ট রায় দিলো যে ফ্লেনেয়ারি জেরাল্ড এর বাবা নন, ডি সি এস ই’র পিটিশন খারিজ করা হলো। পরবর্তিতে আপিল কোর্টে অবশ্য প্রমানিত হয় ফ্লেনেয়ারিই জেরাল্ড এর বাবা। ফ্লেনেয়ারিকেই শেষমেষ সন্তানের ভরণ পোষণের দায়িত্ব নিতে হয় ।

 

দূর যাত্রায় সময় কাটানোর জন্য মার্টিনের এই সত্য একটি ঘটনার বর্ণনা যে শুভময়ের ব্যক্তিগত জীবনের সাথে এতটা অবিশ্বাস্যভাবে মিলে যাবে মার্টিন কি ভাবতে পেরেছিলো? নিশ্চয় পারে নি, শুভময় তা বুঝতে দেয় নি । মার্টিনকে অলবানি শহরে নামিয়ে দিয়ে বাস স্টেশনে গাড়িটি পার্ক করে শুভময় ওয়াশরুমের খোঁজে স্টেশনের ভেতরে ঢুকে পড়লো । স্টেশন থেকে মার্টিন যখন বেরুচ্ছে, তার অট্টহাসিতে চারদিকে আকাশ বাতাস কেঁপে উঠছে । হাসি থামানোই বিরাট এক সমস্যার মতো মনে হচ্ছে । অলবানি, ন্যুয়র্ক স্টেটের রাজধানী হলেও ‘ট্রেইলওয়েজ অলবানি’র বাথরুমের মতো এত নোংরা বাথরুম পৃথিবীর কোথাও হয়তো সত্যিই নেই, ওখানে আয়নায় কোনো ভিনদেশী, মার্কারে লিখে রেখেছে, “ ইফ দিস ইজ দ্য ক্যাপিটাল অব ন্যুয়র্ক , আই উড লাইক টু সি ন্যুয়র্ক সিটি ।” এই লেখাটির নীচে অন্য কেউ লিখে রেখেছে “ইউ’ড বেটার লার্ন সাম মোর ইংলিশ।”

 

 

 একশো তিন ডিগ্রী জ্বর এর রাজ্যে পৃথিবী এমন কি গদ্যময়ও নয় l কি লিখি – কি লিখি? যা লিখে যেতে চেয়েছে শুভময় তা এখন মাথায় আসছে না, সেখানে এখন শুধুই অগ্নির হল্কা l একলা ঘরে স্মৃতির আকাশ থেকে উড়ে আসছে না পথহারা দু’একটি কোকিল অথবা বুলবুলি, নিজের গোঙ্গানি কর্কশ কাকের মতো এ দেয়াল থেকে ও দেয়ালে মাথা ঠুকে মরছে l কাকে এই লিখে যাওয়া – কাকে আমি লিখি ধূসর এই জীবনের হাত চিঠি? অহনা – সেও আর নয় কিছু অমীমাংসিত l অসুখ বিসুখের সময়ে দাদুর বিদেহী আত্মা বুঝি ভর করে শুভময়ের উপর। কাছে এসে বসেন, মাথায় হাত রাখেন, সিগ্রেটের নীল ধোঁয়া ছেড়ে বলেন, এসবের অর্থ কি শুভ? এই সব লিখে তোর কি লাভ হচ্ছে বল তো আমাকে। হৃদয়ের রক্ত দিয়ে এসব লিখছিস –কেউতো ঠিকমতো পড়েও দেখছে না, কেউ কখনো পড়বেও না। তোর এই লেখার একটি বর্ণ, দাড়ি, কমা, সেমিকোলনও কেউ বিশ্বাস করবে না। যদিও এ লেখার পুরোটাই খাঁটি সত্যি কথা। কল্পকাহিনী লিখলেই পারতিস, মানুষ বিশ্বাস করতো, চোখের জল ফেলতো, মান্যগণ্য করতো তোকে। কাশতে কাশতে দাদু থামেন। উনি তো ঠিকই বলেছেন, মার্ক টোয়েন একবার লিখেছিলেন, It’s no wonder that truth is stranger than fiction. Fiction has to make sense.

 

কল্পকাহিনী নভেল, নাটক লেখক যখন লেখেন তিনি পাঠকের মনস্তত্ত্ব বিবেচনা করেই লেখেন। সাহিত্যের লেখায় জ্যামিতিক একটি আকার থাকতে হয় – বৃত্ত বা ত্রিভুজ বা বর্গক্ষেত্র। সাহিত্যের লেখায় একটি রেফারেন্স পয়েন্ট থাকতে হয়, যার সাপেক্ষে অন্য যে কোন ঘটনার অবস্থান নির্ণীত হতে পারে। জীবনের গল্পে, সত্য গল্পে, আত্মজীবনীতে সেরকম কোন রেফারেন্স পয়েন্ট থাকে না। আদি থাকে না, অন্ত থাকেনা। কল্পনার জো থাকেনা। আত্মজীবনীতে নিজের জন্মের স্মৃতি লেখা সম্ভব নয়, নিজের মৃত্যুর স্মৃতি লেখা সম্ভব নয়। এইসব অসম্ভবের ফলেই আত্মজীবনী জ্যামিতিক নয়, নিরাকার, ধোঁয়াশা। সেজন্যই আমাদের জীবন, প্রতিটি মানুষের জীবনই ঘোলা –ঘোলা জলের মতই ঘোলা।

 

লতায় পাতায় জড়ানো শুভর এক মামা আছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টিমোরে থাকেন। বাংলা বানানের উপর দুএকটি প্রবন্ধ লিখে তিনি এক বিপ্লবী পরিবর্তন আনতে চান। শুভই তার লেখাগুলো ই-বুক আকারে প্রকাশ করেছে। একদিন কথায় কথায় ঐ মামা বলেই ফেললেন, এই যে তুমি জোর করে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে একে ওকে দিয়ে তোমার গল্প পড়াতে চাও, তা কে পড়বে বাপু? কার এমন সময় আছে তোমার ব্যর্থ জীবনের দাদ –চুলকুনি খুঁটিয়ে দেখার। এবার ওসব ছাড়ান দাও। ঐ মামা আজকাল শুভকে এড়িয়ে চলেন –গোপনে বানানের বিপ্লব এতদিনে কতটা জয়লাভ করেছে শুভর জানা হয়নি।

 

শুভর এক কাকু আছেন। উচ্চ শিক্ষিত, উচ্চ পদস্থ। আপন কাকু নয় তবে দূরেরও নয়। অনুরাধার শবদেহ নিয়ে কলকাতায় যখন হৈ চৈ , অনুরাধার বাবা মা এই কাকুর নাম করেই শুভময়কে অনেক শাসিয়েছে, হুমকি দিয়েছে হেন করেঙ্গা তেন করেঙ্গা। উত্তরে শুভময় সেদিন বলেছিল ঠিক কতটা ভয় পাওয়া উচিত তা এক্ষুণি ঠিক ঠাহর করতে পারছিনা, তবে আমি ভেবে দেখব। ভেবে দেখেছে শুভময় – যে প্রতিষ্ঠানে কাকু চাকরি করেন সে প্রতিষ্ঠান কোন থানা পুলিশ নয় , ব্যক্তিগত পর্যায়ের ন্যায় অন্যায়ের বিচারালয় নয়, সে প্রতিষ্ঠানের পরিধি তুলনামূলক ভাবে অনেক বড়। বড় বড় প্রতিষ্ঠানের বড় একটা সমস্যা হলো ছোট বা মিড সাইজের কোন কাজে নাক গলানো সেখানে আনএথিকাল । শুভ তার বুদ্ধি দিয়ে বুঝে বিমল কাকুকে দিয়ে যে ভয়টা দেখান হচ্ছে তা ভিত্তিহীন। বিমল কাকু নিশ্চয়ই এসবের কিছুই জানেন না। আর যদি জেনে শুনে শুভর বিরুদ্ধে কোন অ্যাকশান নেনও তা হবে তার জীবনের সবথেকে বড় প্রফেশনাল মিসকন্ডাক্ট। বিমল কাকুকে শুভর কাছে অহংকারী মনে হলেও বোকা মনে হয়না, পরোপকারী ও মনে হয় না । এসব যুক্তিতেই শুভময় নিশ্চিত থাকে যে বিমল কাকুর দিক থেকে বিপদের কোন সম্ভাবনা নেই। তবে বুকের ভিতরটা খুব হাহাকার করে ওঠে। এই হাহাকার অনুরাধার বাবা মা’র জন্য নয়, অনুরাধার জন্য নয়, অহনার জন্য নয়, এই হাহাকার মানবজীবনের বুদ্ধিজড়তার জন্য।

 

সে যাই হোক এ গল্প আন্তর্জালে প্রকাশের সূচনাকালে, ২০১১ সালের ১৪ই জুন, বিমল কাকুর এক পত্র এলো। তার পত্রখানি নাতিদীর্ঘ হলেও বস্তুনিষ্ঠ, কূটনীতির একটা নরম প্রলেপ আছে লেখায়। তাতো হবেই । কূটনীতিই তো বিমল কাকুর পেশা। খুব ভাল লাগলো শুভময়ের বিমল কাকুর চিঠি পেয়ে। চিঠিখানা ইংরেজী ভাষায় লেখা। বড় লোভ হয় তার বঙ্গানুবাদ শুভময় এই গল্পের শরীরে শোভা বর্ধনের জন্য সংযোগ করে।

 

প্রিয় শুভ, তুমি যা লিখেছ তা গল্প নয়, এটা আত্মজীবনী। তোমার অনুভূতির প্রকাশ তুমি খুব ভালভাবেই করেছ। তোমার লেখনী দক্ষতার সঠিক মূল্যায়ন আমি করছি। অনুগ্রহ করে লেগে থাক। দুঃখজনক হলেও সত্য, অহনাকে যারা খুব কাছে থেকে চেনে তাদের কেউই গল্পের তোমার এই ভাষ্যের সাথে পরিচিত নয়। আমি তাকে দেখেছি যখন তার বয়স ছিল তিন বছর এবং আমি তাকে আরো কয়েকবার দেখেছি যখন সে বড় হয়েছে। সে একজন অসাধারণ শিশু এবং সে অনুরাধার নিখুঁত নকল। আমি যখনই বাকু শহরে যাই মমতার সাথে অনুরাধার স্মৃতিচারণ করি। সে আমার খুব কাছের মানুষ ছিল। আমরা তাকে আর ফেরৎ পাবোনা ঠিকই, তবে সত্যিকারভাবে আশাকরি একদিন তোমার কন্যা তোমার মাঝে সুখ খুঁজে পাক এবং একই রকমটা তোমার জীবনেও ঘটুক। শুভেচ্ছা সহ বিমল কাকু।

 

পত্রের কূটনৈতিক দিকটা শুভময় উপভোগ করে। শুধু ঐ কূটনৈতিক দিকটাই অসাধারণ। পত্রের সারমর্ম কিন্তু শুভময়কে দোষারোপ করা। স্রোতসফেন সুন্দর ভাষায়। সেই ভাষার অন্তরালে লুক্কায়িত তীব্র বিরোধিতা বুঝতে বুদ্ধির প্রয়োজন পড়ে। শুভময় বুঝতে পেরেছে, অন্য অনেকেই চট করে তা বুঝতে পারতো না। বিমল কাকু অহনাকে যুক্তরাষ্ট্রের উড়োজাহাজে চড়ে বছরে একবার দুবার দু এক ঘণ্টার জন্য কোলকাতার বৈঠকখানায় নিশ্চয়ই দেখেছেন , দেখেছেন অহনার যখন তিন বছর বয়স তখন থেকেই, তার আগে নয়, দেখেছেন তাণ্ডব থেমে যাবার পর , দেখেছেন যেমন দেখতে হয় বিমানের জানালা থেকে বন্যা-পীড়িত মানুষকে। একদিন অহনার যখন বয়স মোটে তিন ছিল, একদিন শুভময় এর কাছে অহনা যখন সত্যি কন্যা ছিল, একদিন শুভময় যখন অহনার কাছে সত্যিকার বাবা ছিল, একদিন যেদিন সত্যিকার বন্ধন ছিল, একদিন যেদিন তার বুক থেকে জোর করে সন্তানকে কেঁড়ে নেওয়ার জন্য শুভময়ের এবং অহনার দুজনের বুকেই প্রচণ্ড যে ঝঞ্ঝাবাত উঠেছিল , বিমানের জানালা থেকে তা দেখার নয়, আর এখন তো আর সেই সময়ও নয় । এখন বন্ধন ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে । এখন অহনা আর শুভময়ের কন্যা নয় । মানুষের মধ্যে শুধুমাত্র দু ধরনের বন্ধন সম্ভব । প্রথমত রক্তের বন্ধন, দ্বিতীয়ত মায়ার বন্ধন । শুভময় বলছে না মায়ার বন্ধনের অস্তিত্ব নেই । নিশ্চয়ই আছে , হাজার হাজার মানুষের দত্তক সন্তান আছে , তাদের ভেতর মায়ার বন্ধন আছে । এই মায়ার বন্ধনের একমাত্র এবং প্রধান শর্ত একসাথে থাকা , একদিন শুভময় সেটাও চেয়েছিল , একদিন কিছুতেই তা হতে দেওয়া হয় নি । জীবনের এইসব খুঁটিনাটি বিমানের জানালা থেকে দেখা যায় না , কাছে এসে দেখতে হয়, হৃদয় দিয়ে দেখতে হয় । দশ বছর আগে হলে বিমল কাকুর চিঠির উত্তর লিখতে শুভর হয়ত ভয় হতো, কিন্তু তখন ২০১১ সালে অর্থহীন জীবনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে, সৈয়দ শামসুল হকের এক বইয়ে পড়া সুকুমার রায়ের সেই নব্বুই বছর বয়সী নাজিরের মতো শুভও ভাবলো - একদিন তো মরবই, অতএব মন্ত্রীর জামা শুঁকে দেখতে ভয় কিসের?

 

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই শুভময় প্রত্যুত্তর লিখে পাঠায়। খুব বেশী ভাবনা চিন্তা করে নয়, সহসাই লেখা, খাঁটি প্রতিক্রিয়া। কথা বলা কলা কৌশল শুভময়ের জানা নেই, তবু সেই প্রত্যুত্তরের পত্রখানি খুব একটা কদাকারও হলোনা। মোটের ওপর চলনসইই মনে হলো। বঙ্গানুবাদ নিম্নরূপ।

 

প্রিয়তম বিমল কাকু, কি দারুণ লাগছে আপনার পত্র পেয়ে। যত যৎসামান্যই হোক, আমার ‘লেখা’ পড়ে আপনার কালক্ষেপণের জন্য অনেক ধন্যবাদ। কল্পকাহিনীর বদলে আত্মজীবনী, আপনার এই দুটোর মধ্যে একটাকে বেছে নেয়া আমি বুঝতে পেরেছি। একই গল্পের সর্বদাই বহু ভাষ্য আমাকে সত্যিকার ভাবে আজ আর বিস্মিত করে না। মানবজাতি অনেকটা অসহায়ের মতো কল্পনার প্রতি আকৃষ্ট, তাই নয় কি? ব্যক্তিগত ভাবে আমি কখনই কোন পক্ষপাতের অস্তিত্বকে কাটছাট করে দেখিনা, যা কিনা কোন সমস্যা বা পরিস্থিতির বস্তুনিষ্ঠ বিবেচনাকে ব্যহত করতে পারে, যখনই আমি নিজে কোন কিছু বিবেচনা করতে যাই, বিচার করতে যাই, এমনকি যখন খুব সরল কোন সিদ্ধান্ত গ্রহন করতে যাই। অনেক শিক্ষা পাওয়ার পর, অনেক বাঁক ব্যাবর্তনের পর আমি জীবনকে অন্যভাবে দেখি। দয়া করে আমাকে ভুল বুঝবেন না, কাউকে আঘাত করার ইচ্ছে আমার নেই । পনের বছর ধরে আমি একটি নীতি মেনে চলছি যা আমি কখনই ভঙ্গ করি নি । আমি আর কখনই মানুষকে, দুনিয়া কিভাবে দেখতে হবে, তা শেখাতে যাই না । আমি আর কখনই কারো পিতার আসনে নিজেকে বসাই না । এটা আমাকে অশান্তি এড়াতে সাহায্য করে। আমি মানুষকে দেখতে দিই, তারা যা দেখতে চায়। বলতেই হয়, আপনি আমার থেকে সৌভাগ্যবান । শিশুটিকে তার তিন বছর বয়সের পর আমি আর দেখি নি । সে যে একজন অসাধারন শিশু সে ব্যাপারে আমার কোনও সন্দেহ নেই । কোন শিশুই খারাপ শিশু নয় । শিশু মানেই শিশু, তাই নয় কি? এবং এ ব্যাপারেও কোন সন্দেহ নেই, সে যথার্থই একটি প্রকৃত Response (result) যা কিনা Genetics এর ভাষায় সাধারনত replication ই বলা হয় । আপনিই ঠিক। এই পর্যবেক্ষণটাও যথেষ্ট নিখুঁত । সে সত্যই অনুরাধার নিখুঁত replica । এটাই তো তার জন্য ভাল, তাই নয় কি ? আমি বাকু শহর ছেড়ে এসেছি ১৯৯৮ সালে । আমার এখনো বেশ কিছু বন্ধু আছে বাকু শহরে যাদের সাথে এখনও যোগাযোগ আছে । বাকু খুব সুন্দর শহর, তাই না? আবারো আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। অনুরাধার স্মৃতিচারণ আপনার সুন্দর মনের পরিচায়ক। আপনাকে ধন্যবাদ, সত্যই মানুষের বহুবিধ সীমাবদ্ধতার ভেতর মৃতকে পুনর্জীবিত করা আরও এক সীমাবদ্ধতা । কেউ কেউ ট্রান্সমাইগ্রেশনে বিশ্বাস করে, আবার কেউ কেউ করে না । মৃত্যু এবং শুল্ক ছাড়া কিচ্ছুটি নিশ্চিত নয় । আমি অবশ্যই আপনাকে আবারো ধন্যবাদ জানাই আপনার সুখ-কামনার জন্য – তাদের জন্যই যাদের খানিকটা সুখ দরকার । ব্যক্তিগত ভাবে এসব ব্যাপারে আমার যে মত তা হল, সুখ হয়ত চমৎকার , তবে দুঃখ আরও বেশি মনোরম। কেননা দুঃখই মানুষকে বিচক্ষণ হতে শেখায় । আপনার বিবিধ মন্তব্য উপভোগ করেছি । আপনার চিরকুটের প্রতিটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ আমি সর্বতোভাবে উপভোগ করেছি । আমি আশা করছি আবারও কথা হবার । অনুগ্রহ করে কাকিমাকে শুভেচ্ছা বলবেন । উষ্ণতম শ্রদ্ধা । একান্ত আপনার, শুভময় ।

 

শুভময়ের অহনার জন্য মমতা নিশ্চয়ই আছে,লেখায় সেরকমটিই প্রতীয়মান। এই মমতা আর দশ টি মানব সন্তানের প্রতি যেমন থাকে ঠিক সেরকমই, তার থেকে বেশি নয়। ভুলে গেলে চলবে না এটা আত্মজীবনী - ফিকশন নয়,শুভময় দেবতা টেবতা কিছু নয়,নাটকের হিরো নয়,মহামানব নয়,মাদার তেরেসাও নয় । শুভময়ের ভালবাসা নেই অহনার জন্য। অহনারও একজন কাগজের বাবার প্রতি ভালবাসা তো নেইই,বরং ক্রোধ আছে,ঘৃণা আছে। এই বাস্তবতায়, শুভময় – অহনা -reunion হবার জো নেই । তবে অহনা - অতীনের দেখা হোক ,মিলন হোক ।

 

চলবে...