টরন্টো, ২৬শে অক্টোবর, ২০২৩, নভো সংখ্যা ৪০
              
হোমপেজ সম্পাদকীয় পাঠক পরিষদের কথা কবিতা ছোট গল্প ধারাবাহিক সাহিত্য সংবাদ ভ্রমণ কাহিনি নিবন্ধ প্রেমপত্র বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রকৌশল আবৃত্তি / কণ্ঠসঙ্গীত পাঠাগার আর্কাইভ লেখক পরিচিতি যোগাযোগ

কার্তিকের কুয়াশা

সুখের লাগিয়া

 

-ফিরোজা হারুন

 

এদিকে মামা –মামী অনেক বিয়ের প্রস্তাব পরীক্ষা করে দেখলেন। পছন্দ করার মতো দু’একটা পেলেন, কিন্তু মামার কলিগের পাশের বাড়ির ভদ্রলোক নাছোড়বান্দা। তার খুব ইচ্ছে তার পরিচিত ছেলেটির সঙ্গে আমার বিয়ে হোক। ছেলে স্বপ্রতিষ্ঠিত। ভাল প্র্যাকটিস করেন। ভবিষ্যত আরও ভাল। ব্যবহার ভাল, দেখতে খারাপ নয়। কিন্তু আমার মনের দিক থেকে কোন সায় পেলাম না। ভাবলাম, আমি সেরকম কাউকে নির্বাচন করিনি জীবনসংগী হিসেবে গ্রহন করার জন্য। অচেনা লোকের সঙ্গেই আমার বিয়ে হবে। সুতরাং সে যেই হোক তাকে ঠিক করে নিতে হবে। তা আমি পারব।
সকলেই বলতে লাগলো ‘ওকালতি পেশা খারাপ কি? মানুষ তার প্রফেশনের জন্য খারাপ হতে পারে না। যে ব্যক্তি মন্দ, সে উকিল না হয়ে অন্য পেশায় নিয়োজিত থাকলেও মন্দলোক হবে। খারাপ যে, তাকে কোন পেশাই ভাল করতে পারবে না। ভাল যে, সে যে কোন অবস্থানে তার চরিত্রের দৃঢ়তায় অটল থাকবে।’ এসব বক্তৃতা শুনে আমার মন যুক্তির সন্ধান পেল। আমি সম্মতি জানালাম।
ছেলে দেখার আয়োজন হলো ঢাকা বিমানবন্দরে। রেবা ভাবীর ভাইয়ের বিলাত গমন উপলক্ষে আমরা এয়ারপোর্টে গেলাম। তখনকার দিনে কেউ বিলেত গেলে অনেকেই তাকে বিদায় দেয়ার জন্য এয়ারপোর্ট যেত। সেই সুযোগে বিমানবন্দর দেখা, উড়জাহাজ দেখা এসব কাজও হতো। মামার কলিগের বন্ধুও সেই সুপাত্রকে নিয়ে এলেন সেখানে। পরিচয় করিয়ে দিলেন। দৃষ্টিটা একটু ক্রূর মনে হলো। কথাবার্তা হয়নি তার সাথে আমার। মামারা দু’চার কথা আলাপ করলেন। তাতে নাকি ভালই মনে হয়েছে তাদের। সে ঘটক ভদ্রলোক তার গুণের অনেক ফিরিস্তি দিলেন। বিদ্যা, পেশা, নির্ঝঞ্ঝাট কোন কিছু ভাবতে হবে না, একেবারে তৈরী সংসার! কেবল একজন ঘরণী দরকার, আর কিছুই নয়। সোনায় সোহাগা হবে নাকি আমার বিয়ে। আমার কেমন যেন মন উঠলো না বিয়েতে। তবুও রাজী হয়ে গেলাম। সকলের যখন পছন্দ তখন আমার হয়তো ভালই হবে। যে বসন্তে আমার ভাইয়ের বিয়ে, তার পরের বসন্তেই আমারও জীবনের পট পরিবর্তনের ক্ষণ নির্ধারিত হলো। আমি তৈরী হলাম। তবে মনের আড়ষ্টতা রয়ে গেল। যথারীতি মা ও মামী ঝাঁপিয়ে পড়লেন আয়োজনে। মামাতো বোনটিও একটু বড় হয়েছে। সেও যথেষ্ট সাহায্য করতে পারছে। আমার মা মনের মাধুরী মিশিয়ে অনুষ্ঠান রচনায় মন দিলেন। আয়োজন খুব সুন্দর হলো। তারপর পঞ্জিকা দেখে দিনক্ষণ ধার্য হলো।
বরযাত্রী এলেন মাত্র কয়রকজন! বলল, আত্মীয় –পরিজন এদিকে বিশেষ কেউ নেই। বন্ধু বান্ধবও সংখ্যায় কম। কেননা এখানে তার বেশী দিনের বসবাস নয়। অতিথি ছিলেন সেই ঘটক সপরিবারে। মামার কলিগ, তার বাড়ির সকলকে নিয়ে। পাত্রের পিতামাতা সেই সুদূর সাতক্ষীরা থেকে এসেছেন তাদের ছেলেসহ। আর কোন আপনজন এসেছে বলে শুনতে পাইনি। কিছু কাপড় –চোপড় একটা স্যুটকেসে ভরে ভদ্রলোক বিয়ে করতে এসেছেন। গহনাপত্র অর্ডার দিয়েছেন, সেগুলো দু’চারদিনের মধ্যে পেয়ে যাবেন। তাড়াহুড়ো করে সেগুলো তৈরীর কাজ সম্পন্ন হয়নি। আমরা ভদ্রলোক। মানুষের মুখের কথা বিশ্বাস করি। হতেও পারে এরকম। কারণ ছেলে একা। বিয়ের আয়োজন কিভাবে করতে হয় তা তার জানার কথা নয়।
আমার মা, তার যত অলংকার ছিল তার অনেকগুলো আমাকে দিয়ে দিলেন। আমাদের পোশাক –অলংকার দিয়ে আমাকে সাজানো হলো। সেই সময়ে বিউটি পার্লার ছিল না। বাড়ির বাইরে দোকানে গিয়ে কনে সাজানো, মেহেদী লাগানো, খোঁপা বাঁধানো –এ ছিল অশ্রুতপূর্ব ঘটনা। বাড়ির মেয়েরা তখন কনে সাজানো , কবরী রচনায় খুবই পারদর্শী ছিল। বন্ধুরা পরম উৎসাহের সঙ্গে আমাকে অপরূপ সাজে সজ্জিত করলো। সঙ্গে ছিল আমার মায়ের শিল্পী মনের নির্দেশনা। সর্বাঙ্গ সুন্দর রূপে বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হলো, বাড়িতেই। আমাদের দিক থেকে কোন ত্রুটি ছিল না।
চলে এলাম ঘোড়ার গাড়ি চড়ে শ্বশুরবাড়ি। শ্বশুর বাড়ি ঠিক নয়, বরের বাড়ি। সেখানে সেই বন্ধুর স্ত্রী আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন। হাত ধরে গাড়ি থেকে নামালেন। সঙ্গে করে গৃহ প্রবেশ করালেন। অল্প কিছুক্ষণ থাকার পর তারা চলে গেলেন। রয়ে গেলেন আমার শ্বশুর, শাশুড়ি আর একটি দেবর। কম বয়েসী কাজের ছেলে একটি আছে। খুব ছোট নয়। তরুণ। কিছুক্ষণ পর সে শয্যা গ্রহন করল।
এমন কোলাহলবিহীন নীরব পরিবেশে কতক্ষণ জেগে থাকা যায়? আমার স্বামীও বিছানায় ঘুমিয়ে পড়লেন। অগত্যা আমি একা জেগে রইলাম। রাত গভীর হলো। ধীরে ধীরে সাজ পোশাক পাল্টে নিলাম। শোবার ব্যবস্থাটি আমার পছন্দ হয়নি। সেজন্য একটি কাঠের চেয়ারে বসেই বিশ্রাম নেয়ার চেষ্টা করি। ঘুম এলো না চোখের পাতায়। এমনকি তন্দ্রাও নয়।

জীবনে এই প্রথম রাত, যে রাত আমার বিনিদ্র কেটে গেল। পাখির কূজনে সরব হলো চরাচর। চেয়ার ছেড়ে উঠে হাতমুখ ধুয়ে তৈরী হয়ে নিলাম। ঘুরে ঘুরে দেখলাম ঘরদোর। দুই কামরার বাড়ি। শ্রীহীন। লক্ষীছাড়া। ব্যাচেলার মানুষের সংসার এর চাইতে ভাল আর কি হবে! এই ছন্নছাড়াটাকে এবার মানুষ করতে হবে আমাকে।
সেই কাজের ছেলেটি সবার জন্য নাস্তার ব্যবস্থা করলো। দোকান থেকে সব কিনে নিয়ে এলো। আমার বর রহমতুল্লাহ নাস্তায় শরীক হলেন। খাওয়ার সময় শ্বশুর সাহেব তাদের চলে যাওয়ার কথা বললেন। বাড়িতে তাদের অনেক কাজ। না গেলে অনেক অসুবিধা। তাদেরকে আজই যেতে হবে। পরে সময় মতো আবার আসবেন। আমার সঙ্গে তাদে তেমন কোন কথা হয়নি। বিকেলের দিকে তারা খুলনার উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন। তারা নিজেরাই রিকশা ডেকে স্টেশনের দিকে চলে গেলেন। তাদের পুত্রকে তাদের সঙ্গে যেতে দেখলাম না! একটু অবাক লাগলো বটে। তবে আবার ভুলেও গেলাম সেই কথা।
পরের দিন রাতে দেখি আমার বর অন্য কাময়ায় শুতে গেলেন। আসলে সেটিই তার বেডরুম যেখানে গতরাতে তার মাতা পিতা ও ভ্রাতা অবস্থান করছিলেন। ইতিমধ্যে সারাদিন এই লোক আমার সঙ্গে একটি কথাও বলেন নি। মনে মনে ভাবলাম লোকটি বোধহয় লাজুক।কি কথা বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না। আমার কেমন একা একা লাগছে। কোনদিন কথা না বলে কাটাই নি। কৌতূহল বাড়তে লাগলো। এ কেমন লোক? বিয়ের পর বৌয়ের সঙ্গে কথাই বলে না। লোকে তো নব বিবাহিত স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার জন্য উন্মুখ থাকে বলেই আমার ধারনা। এ বিয়ে তো তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে নয়। ঘটকের প্রচন্ড চাপের মুখে আমার মামারা এই বিয়েতে রাজী হয়েছেন। নয়তো এই বিয়ে তো কোনক্রমেই হওয়ার নয়। এত ভাল ছেলে, তুলনারোহিত। কিন্তু এত ভাল ছেলেরা নতুন বউয়ের সঙ্গে কথা বলে না?
পরের দিন সকালে নাস্তার টেবিলে দেখা। আমি দু’একটি কথা বললাম। তাও নৈর্ব্যক্তিক। সংক্ষেপে উত্তর দিলেন। মনে হল চেম্বারে যাবেন। জিজ্ঞেস করলাম। উত্তর এলো হাঁ সূচক। বিয়ে উপলক্ষে ছুটি নেয়নি লোকটা? অবাক লাগলো। কৌতুহলবশতঃ প্রশ্ন করেই ফেললাম – ছুটি নেননি?
বললেন - না।
কেন?
তার কোন জবাব পাওয়া গেল না। তিনি চলে গেলেন। বলাবাহুল্য তার কক্ষের তালাটি বন্ধ করতে ভুল হলোনা। বিস্ময়ে বিমূঢ় আমি! একি সর্বনাশ! এতো নাটকের পূর্ব সূচনা! তা প্রথম পদক্ষেপেই? মনে মনে প্রমাদ গুনতে শুরু করলাম। সতর্ক হলাম। অপেক্ষা করতে লাগলাম পরবর্তী ঘটনা পর্যবেক্ষণের জন্য। কাজের ছেলেটি তার বাইরে যাওয়ার তৈয়ারী করে দিল প্রতিদিনকার অভ্যাস মতো। সন্ধ্যায় তিনি বাড়ি ফিরলেন আগের মতোই সম্ভবত। চা তৈরী করলাম আমি নিজে। দিলাম তাকে। কোন কথাবার্তা নেই। নিজেই উদ্যোগী হয়ে দু’চার কথা জিজ্ঞেস করলাম। জবাব দিলেন এই যা। তার বেশী কিছু নয়। সেদিনও তিনি যথারীতি ঢুকে গেলেন তার রুমে। আমিও সেদিন রাতে আমার রুমের দরজা বন্ধ করে বিশ্রাম নিতে গেলাম। দেখলাম দরজা যথেষ্ট মজবুত নয়। তবে একটি বার আছে শক্ত কাঠের। সেটি দরজার উপর আড়াআড়ি যথাস্থানে তুলে দিলাম। এঘরে প্রবেশের আর কোন পথ আছে কিনা তাও পরীক্ষা করে দেখলাম। অন্তর কেমন যেন কেঁপে উঠলো। মায়ের মুখখানি চোখের সামনে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। আমার নিজের দুঃখ কোন দুঃখই নয়। দুঃখ আমার মা – আমার মায়ের কি হবে যিনি আশায় বুক বেঁধে আছেন আমার সুখ দেখবেন বলে।
পরের দিন পুনরায় নাস্তার টেবিলে দেখা। দুই কামরার সামনে একটি বারান্দা। বারান্দার একপাশে রান্না ঘর। অন্যপ্রান্তে বাথরুম। মাঝখানে পাতা ছোট একটি সাধারণ টেবিল, দুটি অতি পুরাতন চেয়ারকে সঙ্গী করে দাঁড়িয়ে আছে। বলার কিছুই ছিল না। লক্ষ্য করলাম তিনি আমার চেহারা দেখছেন।আগেও দেখেছি। যতক্ষণ আমি অন্য দিকে তাকাই তিনি আমার চেহারাই দেখেন। ব্যাপারটি অত্যন্ত স্থূল মনে হলো। স্থির করলাম আমি আর তাকে আর চান্স দেব না। আমি তার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। আমার চোখে চোখ রাখতে পারলেন না। মনে মনে ঠিক করলাম চেহারা দেখার পালা এখন আমার। কোথায়, কার কাছে এসে পড়েছি, তা আমার জানা দরকার। তারপর থেকে আমিই তাকে লক্ষ্য করতে লাগলাম। দেখলাম তার চোখ বড় হিংস্র। দিনে দিনে আমার ধারণা সত্য হলো। তার চোখে নিষ্ঠুরতা খেলা করছে। আমার সঙ্গে তার বিয়ে হওয়ার পিছনে কোন নিগূঢ় কারণ আছে। গল্পের বইয়ে পড়েছি নায়ক প্রেম করে বিয়ে করে। তারপর বিয়ের রাতেই সে খুন করে সেই মেয়েকে। কেউ তার কোন হদিস পায় না কোনদিন। এটা সেই লোকের এক বিকৃত মানসিক ব্যাধি। তার অন্য সব কার্যকলাপ ঠিক আছে। সুন্দর মেয়ে বিয়ে করে তাকে একটি বিশেষ উপায়ে হত্যা করাই তার উদ্দেশ্য। এতে তার পৈশাচিক প্রবৃত্তি আনন্দ পায়।
আমি শিউরে উঠলাম। আমার নিরাপত্তার জন্য বিশেষ ভাবে চিন্তিত হয়ে পড়লাম। কয়েকদিনপর আমি মামার বাসায় যাবার কথা বললাম। তাকে আমার সঙ্গে যাওয়ার কথা আমি বলিনি। তিনিও যাননি। বাসার সকলে অবাক হল আমাকে একা দেখে। সকলে জানতে চাইলো কেন তাদের প্রিয় অতিথি আসেননি। বললাম, কোর্টে কাজে খুব ব্যস্ত তাই আজ আসতে পারেননি। মামা মামী অনেক আদর যত্ন করলেন আমাকে। আবার বিকেলে ফিরে গেলাম সেই নির্জন পুরীতে। ভয় করতে লাগলো। তবুও দেখতে হবে ব্যাপারটা কি। কয়েকদিন এভাবে কেটে গেল। আমার ছুটি শেষ। কলেজে গিয়ে মন ভাল হয়ে গেল। মনে হলো কোন স্বর্গপুরীর দ্বার আমার জন্য খোলা হলো। আমার ভাগ্য মোটেও খারাপ নয়। এই তো কত লোকজন। কত ভাল ব্যবহার করছে সবাই আমার সঙ্গে। অন্তরে অনেক জোর পেলাম। সাহস সঞ্চয় করে আমাকে বাঁচতে হবে। হেরে গেলে চলবে না। মরে গেলেও চলবে না। সেই ঘটক –যিনি কনের মাসী বরের পিসি তিনি আর কখনো আসেননি। বরের বন্ধু –বান্ধব বা অন্য কোন প্রাণীও এ বাড়িতে পদার্পণ করেনা। সম্পূর্ণ অচেনা পরিবেশ, তবে কাজের ছেলেটি যে ঐ নিষ্ঠুর লোকটির বিশ্বস্ত সহচর, তা আমার দৃষ্টি এড়ায় নি। আমি ছেলেটিকে দিয়ে ফুট ফরমায়েশ করিয়ে থাকি। খুশী হয়ে করে, তবে তাকে আমি ভয় পাই।
তড়িঘড়ি বদলি হয়ে আআর পর আমার অফিসিয়াল কাগজপত্র ঠিক করে নেয়ার প্রয়োজনে শিক্ষা মন্ত্রাণালয়ে গেলাম। সেখানে অনেক সময় ধরে নানা কাগজ সই করে বাড়ি ফিরে এলাম। সেদিন কেন জানি না বড়ই উৎকন্ঠা বোধ হতে লাগলো। আমার স্বামী রহমতুল্লাহ এবং কাজের ছেলে আবদুল আজ খুব খুশী খুশী।
আমার স্বামী মোটামুটি ফর্সা চামড়ায় মোড়া মাঝারি সাইজের লোক। চুলের সংখ্যা কম। তাও খাড়া খাড়া। দাড়ির সংখ্যাও স্বল্প মনে হয়। শরীরে চামড়া টানটান। শরীরে কাঠামো হাড় হাড্ডিসার, চাপা ভাঙ্গা, নাক সূচালো। একজন যুবক সুন্দর চেহারার অধিকারী না যদি হয়, তবুও তার চেহারায় যে প্রাণ চাঞ্চল্য ও পৌরুষত্ব জেগে ওঠে –এ লোকের তা ছিটেফোঁটাও নেই। দেখলে কারোর ভাল লাগার কথা নয়। তবুও হিতাকাংখীরা হয়তো ভাবতে পারেন যে ঠিকমতো খাবার, যত্ন পেলেও এই অবস্থার পরিবর্তন হবে। চেহারার জৌলুস বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু তারা জানেন না যে, এ ব্যাক্তি মোটেও স্বল্পাহারী নন। প্রচুর খাদ্যগ্রহন করেন। আরামে নিদ্রা যান। আয়েশে অফিস করেন।
ছয়
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাজে আমাকে আরেকদিন সেখানে যেতে হলো। গিয়ে দেখি রাজশাহীর সেই ভদ্রলোক শিহাব আহমেদ। তিনি আমাকে দেখে চমকে উঠলেন। বললেন, আপনি? এখানে?
বললাম, কেন থাকতে নেই?
-না কল্পনা করিনি আবার এভাবে দেখা হবে।
-কল্পনা করার চেষ্টা করতে হয়। কারণ পৃথিবীটা তো গোল। ঘুরতে ঘুরতে কোন না কোন সময়ে কারো না কারো সংগে দেখা হবে। যাকে পছন্দ করেন তাকেও, যাকে না করেন তাকেও দেখতে পাবেন।
-ও কথা বলবেন না। যাকে পছন্দ করি না, তাকে জীবনে আর কখনো দেখতে চাই না। বিধাতার কাছে আমার এই একটি মাত্র প্রার্থনা।
–বিধাতা অকৃপণ। তাঁর কাছে একটি কেন অনেক কিছু প্রার্থণা করতে পারেন। মঞ্জুর যে হবে না, তা তো হলপ করে বলা যায় না। তা আপাতত ঢাকায় কিসের জন্য এসেছেন? তাও মন্ত্রণালয়ে?
শিহাব আহমেদ বদলি হয়ে আসতে চান ঢাকায়। সেই পোস্টিং এর তদবীর করতে এসেছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে এসেছেন তার কলিগের সঙ্গে। ভাগ্যে আছে দেখা, তাই এ সাক্ষাৎ আমার সঙ্গে। আমার কলেজের ঠিকানা দিলাম। বললাম, কখনো সম্ভব হলে যোগাযোগ করবেন –যদি অপছন্দের লোকের তালিকায় না পড়ি। আমি এখানে কলেজে নতুন।
বাসায় গিয়ে দেখি কাজের ছেলে আবদুল খুব খুশি খুশি। বাসনপত্র গোছাচ্ছে। জিজ্ঞেস করলাম কেউ এসেছিল নাকি? বললো, হ্যা। পর মুহূর্তে ত্বরিত গতিতে মুখ ফিরিয়ে বললো, না না। কে আবার আসবে?এখানে ভাই সাহেবের কেউ নেই।
-কেউ নেই কি রে? এই তো তুই আছিস, আমি আছি।
সে হাসতে লাগলো নীরবে দাঁত বের করে।
আমার ঘরে যেহেতু কোন মূল্যবান জিনিসপত্র নেই, সেইজন্য আমি আমার ঘর তালা বন্ধ করিনা। এছাড়া এটা আমার ঘর নাকি? এতো এক রহস্য পুরী। আমি দেখে এখানে বাস করছি। আমার আত্মীয়দের আসতে দিইনা। তারা এ অবস্থা দেখলে মন খারাপ করবে।
ঘরের ভেতরে প্রবেশ করলাম। মনে হলো একটু আগেও কেউ এখানে ছিল। আমার বিছানায় তার চিহ্ন। চিরুণী তে একগাদা চুল, যা আমার নয়। একটি ছোট পড়ার টেবিলের ওপর একটি গোল আয়না আছে আমার। তার পাশে একটি চিরুণী থাকে। পাশেই আমার বইপত্র, কাগজ, কলম, কালি ইত্যাদি। সেই চিরুণীটি দেখি আমার ধারণা বদ্ধমূল হলো যে, এঘরে একটি মেয়ে এসেছিল। আমার দুর্ভাগ্যের সাথে সে বিশেষ ভাবে জড়িত। মনের ভিতর ঝড় উঠলো। কিন্তু করার কিছুই খুঁজে পেলাম না। এই লোক কে? কি কারণে আমাকে বিয়ে করেছে? কোন খবরই জোগাড় করতে পারলাম না।
তিনি বাসায় এলেন।বিকেলে চায়ের টেবিলে তাকে শুধালাম,
-আপনার সেই বন্ধু ও তার স্ত্রী কোথায়? আর আসেন না কেন তারা?
উত্তরে জানালেন, ওরা এখানে নেই।
-কোথায় গেছেন?
-যশোরে।
-কেন?
-কেন আবার? সরকারি চাকরী করেন খালেক সাহেব। বদলি হয়েছেন তাই চলে গেছেন।
-তা আমাদের সঙ্গে দেখা করে যেতে পারতেন। এত দূর চলে যাচ্ছেন, বলে যাবেন তো!
এবার আর জবাব এলো না।
আমার খুব খটকা লাগলো। যে লোক এতো জোর দিয়ে একটি বিয়ে ঘটিয়ে দিয়ে, তিনি একবার দেখা না করে চলে গেলেন! এ রহস্য উদঘাটন করা দরকার। কিন্তু কোন উপায় খুঁজে পাচ্ছি না।
আব্দুল তার মনিবকে কি যেন বলতে চায়। সে একবার সেই ঘরে ঢুকে কি যেন বলে এলো। বেশ সময় নিল আমিই তাকে সুযোগ দিলাম। চলে গেলাম আমার কামরায়। বোধহয় সেই মেয়েটির আগমন সংবাদ দেওয়া হলো। মনে মনে ভাবলাম মামাকে বলি। তিনিও তার কলিগের বন্ধুর খোঁজ করুন। তাতেও ভয়ের কারণ আছে। কারণ এখানে আমি সম্পূর্ণ একা। আমি যমের বাড়িতে যমের সঙ্গে বসবাস করছি।
মনটা খুবই অস্থির। বুকের ভেতর প্রবল উদ্বেগ, শংকা আমাকে তটস্থ করে রাখলো। এক অশুভ সংকেত যেন অনুভব করতে পারছি। পরদিন আমি কলেজে যাইনি। শরীর ভাল ছিল না। ঠান্ডা লেগেছে মনে হয়। সকাল দশটার দিকে এক ভদ্রলোক এসে হাজির ততার বাড়ি সাতক্ষীরায়। সম্পর্কে তিনি আমার চাচা শ্বশুর হন।
এত দিন পর একজন আত্মীয়ের দেখা পেয়ে খুব উৎফুল্ল হলাম। আব্দুলকে পাঠালাম দোকানে মিষ্টি আনার জন্য। ভদ্রলোককে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালাম। কুশল বিনিময়ের পর জানতে চাইলাম আমার শ্বশুর–শাশুড়ি, দেবর-ননদ কেন এলেন না? সেই যে গিয়েছেন আর একবারও কেউ আসেন নি। একটি চিঠি দিয়েও খোঁজ খবর নেন নি।আমার সঙ্গে তাদের পরিচয় হওয়া দরকার। আমি তাদের ঘরের বৌ। পরিবারের সদস্য।’
ভদ্রলোক কেমন অবাক হয়ে তাকালেন, শুদজালেন, ‘তুমি এখানে কেমন আছো?’
- খুব ভাল আছি।
- রহমতুল্লাহ কেমন ব্যবহার করে?
- ভাল ব্যবহার করেন। তিনি খুব ভাল লোক। আমি প্রায়ই তাকে বলি তার বাবা–মা , ভাই–বোনদের এখানে নিয়ে আসতে। তিনি খব ব্যস্ত। সেজন্য বাড়ি যেতে পারেন না মনে হয়।
- চাচা শ্বশুর সাহেব বললেন, ‘তাহলে মতি গতি পাল্টেছে তার। খুব ভাল কথা। সে তার বাবা মাকে যে কষ্ট দিয়েছে তাতে ওদের মন ভেঙে গেছে। ভবিষ্যতে হয়তো তুমিই ঠিক করে নিতে পারবে।
- জিজ্ঞেস করলাম, কি কষ্ট দিয়েছেন? কেন দিয়েছেন?
- তিনি বললেন, সে অনেক কথা। সে এক করুণ কাহিনী, দুঃখের ঘটনা।
- -আমাকে বলেন। সব কথা খুলে বলেন। নাহলে সম্পর্ক ভাল করব কি করে? পারিবারিক শান্তি প্রতিষ্ঠা করাই তো আমার প্রধান কর্তব্য। সব কথা জানা থাকলে আমার জন্যে সুবিধা হবে।
- তিনি বলতে লাগলেন, ‘রহমতুল্লাহ আমাদের জয়েন উদ্দিন মাস্টারের পুত্র নয়।’
একথা শুনে আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেল। হৃৎপিন্ডে রক্ত সঞ্চালন দ্রুততর হলো। আমার চেতনা লোপ পাওয়ার জোগাড় হলো। নিজেকে সেখান থেকে টেনে উদ্ধার করে, স্থির হয়ে তার বক্তব্য শোনার জন্য বসে রইলাম। এ সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না। আর কোনদিন জানতে পারবো না এই লোকের ইতিকথা। এ লোক কে? এ রহস্য আমাকে জানতেই হবে।
তিনি বলতে লাগলেন, জয়েন উদ্দিন মাস্টারের প্রথম সংসার–জীবনে কয়েকটি সন্তান, জন্মের পর পরই মারা যায়। তারা অনেক ডাক্তার, কবিরাজ, পীর ফকিরের শরণাপন্ন হন। এক সন্ন্যাসী তাদেরকে এক অচেনা, অনাথ নবজাতককে দত্তক গ্রহন করার নির্দেশ দেন।চারিদিকে সেরকম একটি শিশু সংগ্রহের চেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু কোথাও কোন সন্ধান পাওয়া গেল না। এমন সময় একদিন তাদের বাড়ির অদূরে নবগঙ্গা নদীতে এক বেদের নৌবহর এসে হাজির। সেখানে একটি নবজাতকের কান্না শোনা যায়। থেকে থেকেই সেই ক্রন্দনধ্বনি গ্রামবাসীদের সচকিত করে তোলে। কৌতূহলী জনতা তাকে আবিষ্কার করে। এক মাতৃহীন শিশু। বড়ই অসহায়। কে দেখবে তাকে?
জয়েন উদ্দিন মাস্টারকে সকলে সেই শিশুর সন্ধান দিল। এ তো আল্লহ্র দান। কারণ সন্ন্যাসী বাবা তাদেরকে এরকম একটি নবজাতক দত্তক গ্রহন করার কথা পরামর্শ দিয়েছিলেন।একটি দত্তক গ্রহন করলেই পরবর্তীতে তাদের সন্তান জীবিত থাকবে। তাদের সন্তান আর জন্মের পর পরই মারা যাবে না।
আল্ল্র ইচ্ছা মনে করেই তারা এই বাচ্চাটিকে বুকে তুলে নেন। তখনকার প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী জয়েন উদ্দিন মাস্টার একটি টাকার পরিবর্তে শিশুটিকে খরিদ করেন। তাতে করে বেদেদের সেই বাচ্চার ওপর আর কোন অধিকার থাকবে না। কোনদিন ফিরিয়ে নিতে পারবে না।
শিশুটির গায়ের রঙ পরিষ্কার ছিল। যত্নে আদর দিনে দিনে ফুটফুটে হলো।দেখলে সকলেই আদর করতো।প[অরম করুণাময়ের ইচ্ছায় এই ছেলেকে তারা পেয়েছেন। সেজন্য তার নাম রাখা হলো ‘রহমতুল্লাহ – আল্লাহ্র দয়া।’
সন্ন্যাসীর কথাই ঠিক হলো। জয়েন উদ্দিন মাস্টারের দুটি পুত্র ও একটি কন্যা সন্তান জন্মগ্রহন করে পরবর্তীকালে এবং তারা সকলেই জীবিত তজাকে। কিন্তু এই ছেলেটিকে তারা পরম যত্নে মানুষ করেছিল। এখনো তারা একে খুবই স্নেহ করেন। কিন্তু ভাগ্যের কি পরিহাস! পর কখনো আপন হয়না। এই ছেলে বাল্যকাল থেকেই অপরাধ প্রবণ। কয়েকদিন পর পর একটি অঘটনা না ঘটালে তার চলতো না। সেগুলি সে ঘটাতো তার মাতা পিতাকে কষ্ট দেবার জন্য। তার হাতে সবসময় একটি লাঠি বা কাঠি অথবা বাঁশের কঞ্চি থাকতো। ঐটিই ছিল তার চব্বিশ ঘন্টার খেলার সাথী। আর সেটি দিয়েই সে ঘটাতো অঘটন।
হঠাৎ প্রশ্ন করে ফেললাম, বেদের ছেলের তো গায়ের কৃষ্ণবর্ণ হওয়ার কথা। তার গায়ের রঙ বেশ ফর্সা। এর কারণ কি?তার জন্মের পর তার মায়ের কি হয়েছিল?
- এত কথা তো জানা যায় নি। তবে তার জন্মদাত্রী নাকি কি এক অজ্ঞাত কারণে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে মৃত্যুবরণ করে। পরবরর্তীতে বেদেরা একে বিক্রি করে দিয়ে দ্রুত নোঙ্গর তুলে অন্য কোথাও চলে যায়। আর কোনদিন আসেনি ছেলের খোঁজে।
স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হলো রহমতুল্লাহ্কে। লেখাপড়ায় ভালো ছিল সে। স্কুলের যত দুর্ঘটনা, সে-ই ঘটাতো। চেয়ার টেবিল ভেঙ্গে ফেলা, খেলার মাঠে অন্য ছেলেদেরকে আঘাত করা, ছেলেদের পকেটের পয়সা সরিয়ে ফেলা –এসবই তার একারই কাজ।তার মাথায় নিত্য নতুন বুদ্ধির খেলা।তবে সবই ছিল কুবুদ্ধি। তাকে সৎ পথে রাখার জন্য বাবা মা তাকে তিরস্কার করতেন। একটু বড় হয়ে মুখে মুখে তর্ক করা তার রুটিন হয়ে দাঁড়ালো। সে বলতে আরম্ভ করলো আপনারা নিজের স্বার্থে আমাকে লালন পালন করেছেন। আমার জন্য আপনাদের এইসব ছেলেমেয়েরা বেঁচে আছে। নাহলে সব মারা যেত। আপনাদের স্নেহ মপমতা সব লোক দেখানো। আমার জন্য নয়।
এতকিছু সত্ত্বেও জয়েন উদ্দিন মাস্টার সাহেব পুত্র স্নেহ থেকে তাকে বঞ্চিত করেন নি। বরং তার লেখাপড়ার খরচ এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধা, অন্য সন্তানদের তুলনায় একটু বেশিই দিয়েছেন। তা সত্বেও তার মন পাননি।
রহমতুল্লাহ্র লেখাপড়া একদিন শেষ হয়। নিজের পায়ে দাঁড়ায়। ওকালতি শুরু করে জেলা শহরে। তারপর আর পিতা মাতার সঙ্গে সম্পর্ক রাখেনি। এভাবেই যোগাযোগ ছিন্ন হয়। স্নেহময় পিতামাতা তাকে কাছে টানার অনেক চেষ্টা করেছেন। বিফল হয়েছেন বারবার। এভাবেই কাটে দীর্ঘকাল। পরে সে ঢাকায় চলে আসে। জয়েন উদ্দিন মাস্টার তার খোঁজ জানতেন না।
তারপর এই বিয়ে উপলক্ষ্যে অন্যলোক মারফৎ তাদেরকে ডেকে এনেছে। অন্যকোন উপায় ছিলনা বলে। তাও শুনেছি তাদের সঙ্গে কোন আন্তরিক ব্যবহার করেনি। তবুও বাবা মা হিসাবে তাদের আশীর্বাদ তার জন্য নিরন্তর বয়ে চলবে। এখন তুমি যদি তাকে ফিরাতে পার, তবে তো খুবই ভাল হয়। মাস্টার সাহেবের পরিবারে আনন্দের জোয়ার আসবে। টাকা পয়সার সুখের চাইতে স্নেহ মমতার সুখই বড়। সেটিই প্রকৃত সুখ। এ ছেলেটিকে সে কথাট বুঝাবার চেষ্টা কর।
এতক্ষণে আমি সম্বিত ফিরে পেলাম। বললাম, চিন্তা করবেন না, আমার চেষ্টা আমি করব।
আব্দুল ফিরে এলো নানাপ্রকার খাদ্যদ্রব্য নিয়ে। চাচাশ্বশুরকে অনেক আদর যত্ন করে বিদায় দিলাম। জোর করে তাকে দীর্ঘ সময় ধরে রাখা ঠিক হবে না মনে হলো। কারণ রহমতুল্লাহ্ সন্দেহ করতে পারে অনেক কিছুই । সে একজন ডেলিংকুয়েন্ট পারসন। তার মন সন্দেহ প্রবণ। অদৃষ্টের কি নির্মম পরিহাস! একজন আইন অমান্যকারী অপরাধপ্রবণ লোক কিনা আইনের ব্যবসা করে। যোগ্য লোকই বটে! এরাই যুগে যুগে কত নিরাপরাধ ব্যাক্তিকেলালা দালানের ভাত খাওয়াচ্ছে, ফাঁসির মঞ্চে দাঁড় করাচ্ছে –কে তার হিসাব রাখে? আমার আরো সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। আমি এক ভয়ংকর বিপদের বিবরে অবস্থান করছি। আর দুঃখ নয়।মুক্তির উপায় খুঁজে বের করতে হবে।মনস্থির করে ফেললাম। মাথার উপর থেকে বিরট বোঝা নেমে গেল।আমার মনের ভাব গোপন রেখে নিত্য দিনের মতই চলতে লাগলাম।
পরের দিন কলেজে ক্লাস ছিল না। কোন এক বিশিষ্ট ব্যাক্তির মৃত্যুতে ক্লাস সাসপেন্ড হলো। বাসায় ফিরে আসার কোন তাড়া ছিল না। ভাবছি মামার বাসায় যাই। গেটের বাইরে পা রাখবো এমন সময় দেখি শিহাব আহমেদ। আনন্দের আলোর শিখার মতো অন্তরকে স্পর্শ করলো। কুশল বিনিময়ের পরেই প্রস্তাব দিলেন কোন এক রেস্টুরেন্টে যাবার জন্য। আমার অন্যকোন অসুবিধা না থাকায় রাজি হয়ে গেলাম। নিউমার্কেটে তখন বেশ কিছু খাবারের দোকান ছিল। মেয়েদের জন্য ছিল পর্দা ঘেরা আলাদা ব্যবস্থা। আমরা ছাত্রী জীবনে প্রায় সবসময়ই সেসব দোকানে যেতাম স্ন্যাক্স খেতে। আজো সেখানকার কথাই মনে পড়লো। গেলাম, খাবারের অর্ডার দিলাম। তারপর শুরু হলো আমাদের গল্প। গল্পে তারও উৎসাহ যেমন, আমারো কম নয়।

 

এতদিনে শিহাবের সাথে আমি বিনা দ্বিধায় কথা বলতে পারছি। শিহাব বললেন, দু’চারদিন ঢাকায় আছেন। যে কাজের জন্য এসেছেন, সে কাজটি এবার সম্পন্ন করেই যাবেন। তা না হলে দেরি হয়ে যাবে এদিকে পোস্টিং পেতে।
কথায় কথায় বললেন, রাজশাহীতে তার ভাল লাগছে না। কোথাও অচেনা জায়গায়, অচেনা শহরে তার চাকরী চাই।রাজশাহী ডিভিশানের বাইরে অন্য কোথাও, অন্য কোনখানে।
- কেন?
- কারণ রাজশাহী অঞ্চলে আমাকে সকলেই চেনে। ওখানে তাই থাকতে পারছি না। আমার জীবনে এক চরম ঘটনা ঘটে গেছে। যার জন্য আমি নিজে দায়ী নই। তবুও তার দায়ভার আমাকেই বহন করতে হচ্ছে।
- আপনার চরম ঘটনাটি কি জানতে পারি? নিশ্চয়ই প্রেম ঘটিত। নাকি তার চাইতেও অধিক কিছু?
তিনি বললেন, আপনার মন খারাপ হয়ে যাবে। যদিও আপনি আমাকে চেনেন না, তবুও খারাপ লাগবে।অজ্ঞাতকুলশীল কোন মানুষের মর্মান্তিক বেদনা আপনার মনকে স্পর্শ করবে।আপনি বিষন্ন বোধ করবেন। কয়েকদিন হয়তো লেগে যাবে সে ব্যথা উপশম করতে। আপনার শান্ত সুশীল মনোলোকে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি করা ঠিক হবে কি?
- না। বলতি হবে আপনাকে। আমার অন্তর মোটেও কোমল নয়। যথেষ্ট শক্তি রাখে বাস্তব অবস্থা মোকাবিলা করার।
- সে আপনার ধারণার ও বাইরে। গল্পেও এরকম ঘটনা নেই, বাস্তবে আমরা যা
- আপনি বলুন , আমি শুনবই।
- শিহাবের জীবনের গল্প, যে কোন মানুষের জন্য সে এক অশ্রুতপূর্ব ঘটনা। আশ্চর্য হলেও সত্যি –আমার জন্য তা নয়। ভাগ্যের কি পরিহাস! বড়ই নিষ্ঠুর, বড়ই বিবেচনাহীন।
- শিহাব আহমেদের গল্প শুনে আমি আর আমার তথাকথিত স্বামীর বাড়ি যেতে পারলাম না। মানসিক বিপর্যয় দেখা দিল। শিহাব তো জানে না আমার বাস্তব অবস্থা কি! তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মামার বাসায় এলাম। বাসায় কেউ নেই। মা একা আছেন। কোন কথাই বলতে পারলাম না। মা কিছু একটা বুঝে নিলেন।
আমাকে কোন প্রশ্ন করতে সাহস করলেন না। তিনি যে আমাকে ভয় পান –তা নয়।ভয় পান তিনি সেই দুঃসংবাদকে যা তিনি অনেক দিনধরেই আশংকা করছেন। ছোটখাটো খাবার দিলেন। কয়েকদিন তার সংগে থাকার জন্য অনুরোধ করলেন। একবারও জানতে চাইলেন না তাদের পরম আত্মীয় জামাতা কেমন আছেন?
সর্দি–জ্বর, শরীর ভাল নেই বলে চলে এলাম সেই বাঘের খাঁচায়। কিন্তু এক চরম অস্থিরতা আমাকে ঘিরে ধরলো। সিদ্ধান্ত নিলাম।
সিদ্ধান্ত মানে কি? সিদ্ধান্ত মানে আমার কর্মপন্থা নিরূপণ করা। আর সেই পথ ধরে কাজ করা।তা আমি কি করছি? আমি বসে আছি শেষ দেখার জন্য। পরে পস্তাতে হবে। আর হয়তো বের হওয়ার পথ পাব না। ওই লোক যে উদ্দেশ্যে বিয়ে করেছে তা হাসিল করার দিন সমাগত । আমার বারবার সে কথাই মনে হচ্ছে।রহমতুল্লাহ অপরাধী। একজন পরিচয়হীন ব্যাক্তি। তার পরিবার নেই, পরিজন নেই, নাম নেই, ঠিকানা নেই। আমার ভীষণ ভয় করতে লাগলো।
বাসায় ফিরে দেখি রহমতুল্লাহ বাসায়। আমার শিরদাঁড়া বেয়ে লাব্রাডার শীতল স্রোত প্রবাহিত হলো। মাথা ঘুরে উঠলো। তাড়াতাড়ি বসে পড়লাম। হেসে জিজ্ঞেস করলেন কোথায় ছিলাম এতক্ষণ। বললাম, মামার বাড়ি গিয়েছিলাম।
- কলেজে ক্লাস ছিল না?
যথাসম্ভব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছি। লোকটি নিজে থেকে আমার সঙ্গে কথা বলছেন। তাও হেসে কথা বলছেন! এ সময়ে সে কোনদিন বাসায় ফেরেন না।আমার এবার রীতিমতো ভপয় করতে লাগলো। মনে হলো অদ্যই শেষ রজনী।আর হয়তো ভোরের আলো দেখার সৌভাগ্য হবে না আমার।
রহমতুল্লাহ আবার প্রশ্ন করলেন, তোমার কি হয়েছে?প্রশ্ন শুনে আবারো ধাক্কা খেলাম। বললাম , ঠান্ডা লেগেছে, একটু ফ্লুর মতো হয়েছে। তেমন কিছু নয়। বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাবে।
ধরা পড়ে যাবার ভয়ে শয্যায় আশ্রয় নিলাম। বিকালে উঠে দেখি সে লোক বাড়িতে নেই। আবদুল কে এক কাপ গরম চা দিতে বললাম। সেও খুব খুশী আজ। তার খুশী দেখে আরো ঘাবড়ে গেলাম। হয়তো এদের সব প্ল্যান ঠিক হয়ে গেছে। চা খেতে খেতে আবদুল কে কিছু টাকা দিয়ে দোকানে পাঠালাম মিষ্টি আনার জন্য। আগামীকাল রবিবার। ছুটির দিন। হালকা খাবার বাসায় থাকা দরকার।
এ বাড়ীতে আমার একটি স্যুটকেস ছাড়া আর কোন মালপত্র ছিল না। আমার তথাকথিত স্বামী বিয়ের সময়ে যে সমস্ত গহনার অর্ডার দিয়েছিলেন বলে জানিয়েছিলেন, সেগুলোর আর কোন হদিস পাইনি। প্রকৃতপক্ষে কোন গহনার অর্ডার তিনি দেননি। দু’তিন খানা কাপড় চোপড় যা নিতান্তই সাধারণ। সেগলো আমি কখনোই স্পর্শই করিনি। আমার গহনার বেশীর ভাগই আমার মায়ের কাছে রেখে এসেছিলাম। কারণ এ বাড়ি কোন নিরাপদ জায়গা নয়।তারপর দ্রুত একটি চিঠি লিখলাম। কোন সম্বোধন ব্যতিরেকেই।
“আমি চলে যাচ্ছি মামার কাছে। আর আসবো না কোনদিন। আমাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা বৃথা হবে। আপনি একজন প্রতারক। অপরাধী। সেখবর আমার অনেক আগেই জানা হয়ে গেছে। আপনার নামে কোতোয়ালী থানায় বেশ কিছুদিন আগেই এফ আই আর করে রেখেছি। যদি কোনরকম বাড়াবাড়ি করেন তবে তার ফল ভোগ করতে হবে।দেশের আইন কানুনের ওপর আমার পড়াশুনা ভাল আছে।”
চিঠির উপর লোকটির নাম লিখে আমার পড়ার টেবিলের মাঝখানে একটি গ্লাস চাপা দিয়ে রেখে আমার স্যুটকেসটি হাতে করে রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম। যেদিক থেকে আবদুল আসবে তার উলটো দিকে একটি রিকশা নিয়ে রওনা হলাম।
বাসায় পৌঁছাতে প্রায় সন্ধ্যা হয়।মামারা বৈকালিক চা পান শেষ করে সবে নামাজে দাঁড়িয়েছেন। ভাই বোনেরা আমাকে দেখে খুব খুশী। আনন্দে ওরা হৈ চৈ শুরু করে দিল। মা আমাকে দেখে স্তব্ধ হলেন। মামা আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। হিমালয়ের বরফগলা জলে মামার বুক ভিজে গেল।এতদিন কাঁদিনি মায়ের কষ্ট হবে বলে।আজ সকল বাধা বন্যার স্রোতের মত ভেসে গেল। মামা বললেন কাঁদো, আরো কাঁদো। না কাঁদলে তো তুমি মরে যাবে। এতদিন কাঁদতে পারনি বলে তো অসুস্থ হয়ে পড়েছ।মামী বললেন আর যেতে হবে না তোমাকে।আমরা বাসায় সিদ্ধান্ত নিয়েছি তোমাকে ওখান হতে নিয়ে আসবো। তোমার সঙ্গে আলোচনা করাটাই কেবল বাকি ছিল। আমরাও ছেলে সম্বন্ধে খোঁজ নিয়েছি। যে লোক ঘটক তাকে আমরা ধরেছিলাম। সে বললো, ছেলেটি একটি মেয়ের পাল্লায় পড়েছে। তাকে এড়াবার জন্য এ বিয়ে।
যদিও এসব তথ্য সত্য নয়। মামার সেই কলিগ আরো সংবাদ সংগ্রহ করেছেন। সেগুলো হচ্ছে –এ ছেলে একটি মেয়েকে বিয়ে করতে চায়। তাদের পরিচয় দীর্ঘদিনের। কিন্তু মেয়ের বাবা মা নাম ঠিকানা বিহীন এক আগন্তুকের সঙ্গে তাদের মেয়ের বিয়ে কিছুতেই দেবেন না। তারা মেয়েকে অন্যত্র পাত্রস্থ করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন। মেয়ের বাড়ির বাইরে যাওয়া বন্ধ। তখন তারা প্ল্যান করে যে, যদি ছেলে বিয়ে করে ফেলে অন্যত্র, তবেই মেয়ের উপর থেকে এসব বিধি নিষেধ তুলে নেয়া হবে। তবেই মেয়ে বি.এ পরীক্ষা দিতে পারবে। নতুবা মেয়ের লেখাপড়া এখানেই শেষ।
এই পরিস্থিতি রহমতুল্লাহকে নতুন বুদ্ধি আবিষ্কার করতে বাধ্য করে। সে তার প্রণয়িনীর সংঙ্গে পরামর্শ করে কি করে এ অবস্থা থেকে নিজের উদ্দেশ্য হাসিল করা যায়। রহমতুল্লাহ খুলনার মনোয়ার সাহেব ও তার স্ত্রীর দ্বারস্থ হন। কারণ তারা ঘটকালী করেন। ঘটকের কাজ হলো একশো একটা মিথ্যে কথা বলা। সুতরাং যা হবার তাই হয়েছে। আমরা সেই ঘটকের চক্রান্তের ফাঁদে পা দিলাম। কপাল মন্দ। তাই কোন কিছুই আমার পছন্দ না হওয়া সত্ত্বেও কি করে যেন বিয়ে হয়ে গেল। সেসব ভাবলে আজও বিস্ময়ের অবধি থাকে না। সেই মেয়ের গতিবিধি পুনরায় আগের মতো হলো। সে রহমতুল্লাহর সঙ্গে দেখা সাক্ষাত এবং আমাকে কিভাবে ধ্বংস করতে হবে তার পরিকল্পনা করে। তার পরীক্ষা শেষ। সুতরাং এবার আমাকে উৎখাত করার জন্য তারা সক্রিয় হয়।
বাসার পরিস্থিতি খুবই স্বাভাবিক। পরের দিন ছুটির দিন। রবিবার। আমার ভাই ভাবীরা এলেন সারাদিন থাকবেন বলে। তারাও খুব খুশী হলেন আমাকে দেখে। কোন আলোচনায় কেউ গেলেন না। আমার মনটা তাতে হালকা হলো। মনে হলো দীর্ঘদিন পর আমি মানুষের মাঝে এসেছি। আমার আর কোন ভয় নেই। আমার মামা আর ভাই মিলে সেই লোকের বিরুদ্ধে কি কি অ্যাকশান নেয়া দরকার এবং আইনগত দিক থেকে কি কি পদক্ষেপ নিতে হবে –সেসব ঠিক করে ফেললেন।আমি শরীর অসুস্থ থাকার অজুহাতে কয়েকদিনের ছুটির জন্য আবেদনপত্র পাঠালাম কলেজে। অনেকদিন পর মায়ের কোলের কাছে আশ্রয় নিলাম। নিশ্চিন্ত,শান্তির নিদ্রার পরশ পেলাম।
।।সাত।।
কার ভাগ্যে কি লেখা আছে তা কেউ কল্পনা করতে পারে না। মোটামুটি শিক্ষিত ভদ্র পরিবারে শিহাবের জন্ম। তখনকার দিনে শিক্ষিত পরিবারের সংখ্যা নিতান্তি কম ছিল সাব রেজিস্ট্রার পিতার সাত সন্তানের মধ্যে শিহাব জ্যেষ্ঠ। মেধাবী ছাত্র। বি.এ., পাশ করে চাকরীতে যোগদান করেন সিভিল সার্ভিসে। ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরী। ভবিষ্যত ভালো। অভিভাবকের ইচ্ছে তিনি সংসারী হন। বিয়ে ক্রেন এক ফর্সা গ্র্যাজুয়েট মেয়েকে। তার নাম লতিফা বানু। সে কলেজ ইউনিয়নের সদস্য ছিল। সেই সুবাদে নাম ডাক। শিহাবের চেয়ে বছর চারেকের জুনিয়র। বিয়েটা সেই মেয়ের ইচ্ছেতেই হয়েছে।শিহাব খুব খুশী হন। একটি শিক্ষিত মেয়ে স্বেচ্ছায় তাকে বরণ করেছে। এর চাইতে ভাল আর কি হতে পারে! বিয়ে তো সাধারণত ছেলেদের ইচ্ছে আর পছন্দমতো হয়ে থাকে। যথাসাধ্য আয়োজন করে বিয়ের অনুষ্ঠান সমাপ্ত হয়।বিয়ের রাত্রেই সেই স্বয়ম্বরা শিহাবের উপর কিছু শর্ত আরোপ করে। সে জানায় তার জীবনে কিছু প্রতিজ্ঞা আছে। তা হলো সে উচ্চ শিক্ষা অর্জন করবে। নিজের পায়ে দাঁড়াবে।তারপর সংসার করবে। আপাতত স্বামীর সঙ্গে তার কোনরকম মেলামেশা থাকবে না। শিহাব আহমেদ চমকে উঠলেন এই যুক্তিহীন প্রস্তাব শুনে।
-আগে বলোনি কেন তোমার এমন ইচ্ছের কথা?
-আগে সুযোগ ছিল না। আপনি শিক্ষিত, আমাকে শিক্ষার সুযোগ দেবেন, এ বিশ্বাস নিয়ে আমি আপনার কাছে এসেছি।
-শিক্ষার সুযোগ গ্রহন করাতে স্বামী স্ত্রীর বিবাহিত জীবনে যাপনে বিরোধ কোথায়?
-বিরোধ আছে। আপাতত আমার সিদ্ধান্ত মেনে চলেতে হবে।
সেই মেয়ে দৃঢ়চেতা। তার সিদ্ধান্ত অটল, অনড়। এই স্বয়ম্বরা রমণীর জন্ম রাজশাহী জেলার এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে। লেখাপড়ায় ভাল ছিল। শহরের হস্টেলে থেকে বি.এ., পাশ করেছে। তাদের পরিবারে এই প্রথম বি.এ., পাশ মেয়ে। মেয়েদের জন্য তখন খুবই কৃতিত্বে বিষয় ছিল এট। তাদের পাশের গ্রামের ছেলে ছিল বশির উদ্দিন।পড়াশুনার চাইতে তার অন্যদিকে মন থাকায় সে গ্র্যাজুয়েট হতে পারছিল না। এর সঙ্গে ছিল লতিফার গভীর প্রণয়।একই এলাকার ছেলে বলেই সে শহরে লতিফাকে দেখাশুনা করতো। সুতরাং পরিণতি যা হওয়ার তাই হয়েছে।
অবশেষে বশির উদ্দিন বি.এ.,পরীক্ষায় কোনক্রমে উতরে যায়। এখন তার ব্যারিস্টারি পড়ার শখ জাগে। লেখাপড়ায় তুখোড় না হলেও বশির উদ্দিন খুব চৌকষ। সে বিলেতে যেতে চায়। কিন্তু বিলেত যেতে অনেক টাকার দরকার। এত টাকা কি করে জোগাড় হবে। বশির উদ্দিনের পিতা পুত্রের পড়ার খরচ বাবদ টাকার সন্ধান করে। লতিফা বানুর দুর্বলতার কথাও তারা জানতেন। লতিফার পিতার জমিজমা ভালই আছে। তবে সেখান থেকে বিলেতের খরচ বের করা যথেষ্ট কঠিন কাজ। তিনি ভেবে চিন্তে প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন। লতিফা প্রতিবাদ জানায়। তাতে কোন ফল হয়না। পিতা বলেন, বিয়ের সঙ্গে টাকার সম্পর্ক কি? ছেলের বিয়ে করার ইচ্ছা থাকলে বিয়েটাকে প্রাধান্য দিত – টাকাকে নয়। আমার সংসারে আরো ছেলেমেয়ে আছে। তাদের লেখাপড়া আছে। অন্যান্য খরচ। জমিতে ফসল ফলানো ব্যয় সাপেক্ষ। বিলেতের খরচ জোগাতে হলে যথেষ্ট অনটন সহ্য করতে হবে। মেয়ে আমার বি.এ. পাশ। আল্লাহর মর্জি ভালপাত্র পাওয়া যাবে।
লতিফাকে তিনি গৃহবন্দি করলেন। আর লেখাপড়ার দরকার নেই। যথেষ্ট হয়েছে। কিন্তু লতিফা জেদী মেয়ে।তার সিদ্ধেন্তে সে মনে মনে অটল রইলো। কি করে শহরে যাওয়া যায়, সেই পথ খুঁজতে লাগলো। লতিফা শিহাবকে চিনতো। শিহাবকে অনেকেই চিনতো। গুটিকয়েক মেয়েদের সকলেই চিনতো তাকে, ভালো ছেলে বলে। ভদ্র, লাজুক প্রকৃতির ছেলে। ভাল চাকরী হয়েছে। শহরের মেয়েদের সঙ্গে লতিফার পত্রালাপ ছিল সেই সূত্র ধরে সে শিহাবের ঠিকানা জোগড় করে। শিহাবকে পত্র লেখে।ধীরে ধীরে আন্তরিক হয়। তারপর তার মায়ের মারফৎ তার বাবার কাছে শিহাবের কথা বলে। ওর বাবা খোঁজ খবর নিয়ে শিহাবের কথা জানতে পারেন।জানতে পারেন যে শিহাব যথার্থই ভাল ছেলে। পাত্র হিসেবে অসাধারণ। তিনি এ বিয়ের আয়োজন করেন। একদিন এক অশুভ মুহূর্তে লতিফা–শিহাব পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হয়। শিহাব নির্মম ভাগ্যের শিকার হয়। যদিও তার এমনটি হওয়ার কোন কারণ ছিল না। লতিফা শিহাব নামক একটি সুশীল ছেলের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে শহরে চলে আসে। এখান থেকে চালাবে তার নব অভিযান। তার দয়িতকে সে খুঁজে বের করবে এখান থেকেই ।সে একটি গার্লস স্কুলে চাকরী নেয়। এতে তার বাইরে আসার সুযোগ হয়। বশিরুদ্দীনের ঠিকানা সে জোগড় করে ফেলে সে অচিরেই। তারপর অন্য একটি মেয়ের ঠিকানা দিয়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে। সে তাকে আর্থিক সাহায্য দাএর আশ্বাস দেয়। কারণ তার কাছে শিহাবের দেওয়া অনেক গহনা ছিল। শিহাব দিনের পর দিন স্ত্রীর মনোরঞ্জনের চেষ্টা চালান। তার কোনো প্রকার অসুবিধা হোক তা তিনি চাননি।শিহাবের বাড়ির লোকজনেরা বৌকে খুব ভালবাসে। লতিফা তাদের সঙ্গে মিশে, কথা বলে। কিন্তু শিহাবের ধারে কাছেও সে আসে না। এ অদ্ভুত আচরণের হেতু কি? শিহাব সেই চিন্তায় মগ্ন থাকেন।
মাস ছয়েক পর স্কুল গ্রীষ্মের জন্য ছুটি হয়ে যায়। একমাসের ছুটি। এই দীর্ঘ ছুটি লতিফা তার গ্রামের বাড়িতে কাটাবে বলে জানায়। সেরকম কথা বলে সে গ্রামে চলে যায় তার ভাইয়ের সঙ্গে। শিহাবের তো ওখানে যাওয়ার প্রশ্নই উঠে না। এ ঘটনার দশ বারোদিন পর এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা শিহাবের । সে শিহাবকে জিজ্ঞাসা করে লতিফার কথা। লতিফা লন্ডনে গিয়েছে কিনা। তাকে সে কয়েকদিন আগে এয়ারপোর্টে দেখেছে বশিরুদ্দীনের সঙ্গে। সেই বখাটে ছেলেটা যে সকলের পকেট হাতড়ে বেড়াতো। অন্যের ওপর খেয়ে যেত রেস্টুরেন্টে।
শিহাব মনে করতে পারলেন তাকে। শিহাব ভেতরে ভেতরে শিউরে উঠলেন। বন্ধু বললো, সে তার ভাবীকে তুলে দিতে গিয়েছিল। তিনি লন্ডন যাচ্ছেন স্বামীর কাছে। সেখানে দেখা লতিফার সঙ্গে। বশীরুদ্দীনের হাত ধরে প্লেনে আরোহণ করছে।
- এখানে কেন?
প্রশ্ন করায় সে বললো, বশীরকে বিদায় জানাতে এসেছে। প্লেন উড়ে যাওয়ার পর তোমার স্ত্রীকে আর বিমান বন্দরে দেখতে পাইনি।
শিহাব কোন কথাই বলতে পারলেন না। তিনি বন্ধুর সঙ্গে দু’চার কথা বলে বাসায় চলে আসেন।বাসায় এসে শিহাব তার ছোট ভাইকে লতিফার গ্রামের বাড়িতে পাঠান। সে সেখানে গিয়ে দেখে লতিফা নেই। তারা বললেন,লতিফা তো কয়েকদিন আগে শহরে চলে গেছে। বাসায় অনেক কাজ সেজন্য সে আর বাড়িতে থাকতে চাইলো না। - সে বাসায় যায় নি?
লতিফার বাড়ির লোকজন সদলবলে রাজশাহীতে চলে এলনে।সব কথা শুনে তারা বিচলিত হলেন। বিব্রত বোধ করলেন। শিহাব থানায় ডায়েরি করলেন ঘটনার বিবরণ সহ। শিহাব লতিফার পিতাকে সে পথে দেখা বন্ধুর বাসায় নিয়ে গেলেন। তার কাছে সব শুনে তারা বুঝতে পারলেন, তাদের মেয়ের কুকীর্তির কথা। লতিফার অতীতের ঘটনার সঙ্গে এ ঘটনা মিলে গেছে। সুতরাং অবিশ্বাস করার কোন কারণ নেই। তারা মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়ে অনেক গর্ববোধ করতেন। আর সেই মেয়ে কিনা এত বড় প্রতারক, যে পিতা এবং পরিবারের মুখে চুনকালি মেখে এভাবে পরপুরুষের হাত ধরে স্বামী গৃহ হতে পালিয়েছে।ওর বাবা মর্মান্তিক আঘাত পেলেন এবং সকলের সম্মুক্ষে কন্যাকে ত্যাগ করলেন।

 

শিহাবের আত্মীয়রা কনে পক্ষকে অপমান করলেন। বিয়ের পর সে এ বাড়িতে কিভাবে ছিল তা সকলেই অবগত হলেন। সকলেই ক্রুদ্ধ হলেন। তারা কনের পিতার বিরুদ্ধে প্রতারণা ও মানহানির মামলা ঠুকে দিলেন। শেষ পর্যন্ত সে বিবাদ আপোষে মীমাংসা হয়।
রাজশাহী শহরেই শিহাবের জন্ম, বেড়ে উঠা। সকলেই চেনে তাদেরকে। সেখানেই পড়াশুনা চাকরি। ঘটনা জানাজানি হয়ে গেল। এসব মুখরোচক গল্প খুব দ্রুত প্রচার লাভ করে। শিহাবের মত একটি অতি উত্তম ছেলে একজন মেয়ের প্রতারণার শিকার হল? এর চাইতে লজ্জা আর কই হতে পারে? এই গল্প এখন শহরে ঘরে ঘরে। যারা শিহাবকে চিনত না, এবার তারাও চিনে ফেললো। শিহাবের পরিবারের লোকেরা শিহাবকে দুর্বল বলে লজ্জা দিল। সে জন্যই কোন অচেনা পরিবেশে বদলি হয়ে আসতে চান তিনি।
।। আট।।
নুরু মিয়ার কপাল ভাল। ছয়টি পুত্র, ছয়টি কন্যা । সমান সমান। গ্রামে মেয়েদের তো কোথাও যাওয়ার জায়গা নাই। তাই তারা বছরে দু'একবার নাইয়র আসে পিত্রালয়ে। বাড়িতে তাদের ঠাই রন্ধনশালায় অথবা ঢেঁকিশালায়। বাড়ির বাইরে বাপের বাড়ি অথবা শ্বশুরের বাড়ি, যতদিন মা -বাবা জীবিত থাকেন ততদিন তাদের আদর কদর। বাপের বাড়িতে তারা ছেলেমেয়ে সহ আমন্ত্রিত হয়। পরান খুলে কথা বলে। আনন্দ করে, এ বাড়ির ও বাড়ির সকলের সঙ্গে দেখা করে। তাদের বিচরণ ক্ষেত্র গন্ডীবদ্ধ। কিন্তু এ আনন্দ যেন সীমাহীন । বেড়ান শেষে চোখের জল কপোল ভিজিয়ে স্বামীগৃহে প্রত্যাবর্তন করে। মেয়েদের দু:খ আসে তখন , যখন তাদের পিতামাতার অন্তর্ধান ঘটে । ভাইয়েরা বোনদের আগমন পছন্দ করে না। বিশেষ করে ভাতৃবধূরা তাদেরকে আপ্যায়নে উৎসাহ দেখায় না। সেজন্য একেক ভাই একে বোনের দায়িত্ব নেয়। নুরু মিয়ার সেই সুবিধা হয়েছে আল্লাহর ফজলে। ছয় ভাই ছয় বোনের ভার নেবে ।
মামাদের গ্রামে মেয়েরা পিতৃসম্পত্তির অংশ পায় না। আইন আছে তবে রেওয়াজ নেই। সম্পত্তি ভাইদের ভোগে লাগে। সে কারণে ভাইয়েরা বোনদের বছরে একবার আপ্যায়ন করে নাইয়র আনে। তাদের কাপড় চোপড় দান করে। যার যেমন সামর্থ্য, সে সেভাবেই উপহার সামগ্রী কেনে।
নুরু মিয়ার একান্নবর্তী পরিবার। সংসার ছেলেদের মধ্যে ভাগ করে দেয়াকে জুদা করে দেয়া বলে। নুরু মিয়ার বর্ব ছেলে জনাব আলী ঘোরতর সংসারী। খাটেও সারাদিন। ছেলেমেয়ে তারও কম নয়। কয়েকজন মরে গিয়ে আটজন বেঁচে আছে। তারাও কেউ কেউ খেত -খামারের কাজে লাগছে। গরু ছাগল চরাতে পারছে ছোটরা। জোনাব আলি এখোন জুদা হয়ে যেতে চায়। কারণ এত বিরাট 'গিরস্তির' মূল দায়িত্ব তার ওপর। অন্য ভাইরা তার মতো নয়। তার জিজের সংসার যথেষ্ট বড় । তার নিজের আয় -উন্নতির দিকে মনোযোগ দেয়া বিশেষ প্রয়োজন। সে তার পিতার নকট প্রস্তাব দেয় বিনাদ্বিধায় । নুরু মিয়া অবুঝ নয়। সে বোঝে তার পুত্রের মনের কথা। বলে, 'এখুনি আলাদা হোয়ে গেলে সংসার ভেঙ্গে যাবে। টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। তোকে একা জুদা করা যাবে না।তার দেখাদেখি সকলেই নিজের করে নিতে চাইবে। একসঙ্গে শত শত মণ ধান দেখছিস। ভাগাভাগি হয়ে গেলে আর বরকত থাকবে না। আর কিছুদিন তোরা একসঙ্গে থাক। ছোট ছেলেটা আরেকটু মনোযোগী হোক হালচাষে। তারপরে দেখা যাবে।'
নুরু মিয়ার বুকের ভিতর ডঙ্কা বেজে ওঠে। সে কার জমি ভাগ করবে? তার তো নিজের জমি নেই। জমির মালিক তো মাহতাব, আফতাব সাহেব ও তাদের বোন জান্নাতুল ফেরদৌস! বড় মিয়া তাকে তাদের জমি দেখাশোনা করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন -মালিকানা দেননি ।তারা দয়ালু । বহু বছর ধরে তারা এ জমির ফসল নেননি। এ জমির আয় তো তাদের পাওনা -তাদের হক।
নুরু মিয়ার দুচোখের পাতা এক হয় না। গভীর রাত পর্যন্ত সে জেগে থাকে। সে সিদ্ধান্ত নেয় শহরে গিয়ে বড় মিয়ার সঙ্গে এ ব্যাপারে আলোচনা করবে। কয়েক দিনের মধ্যেই নুরু মিয়া ঢাকায় আসে । বর্ষার শেষ। বাগানে জাম্বুরা, আনারস আর পেঁপে ছাড়া অন্য কোন ফল নেই। তাই নিয়ে নুরু মিয়া ঢাকায় এসে হাজির হয়।দীর্ঘদিন পর নুরু মিয়ার আগমনে বাসায় সকলেই খুশী। যথাযথ আদর আপ্যায়ন করা হয় তাকে। মা তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সকলের কথা জিজ্ঞেস করেন। রাতে নুরু মিয়ার মামার সংগে একান্তে তার সমস্যার কথাটি প্রকাশ করে।
নুরু মিয়া বলল, 'ভাইসাহেব, আপনারা তো গ্রামে যাওয়া ছেড়েই দিয়েছেন। ভবিষ্যতে আপনাদের বংশধরেরা গ্রামে যাবেন -সেরকম লক্ষণও দেখা যায় না। সুতরাং ও সম্পত্তি রেখে কি করবেন? সম্পত্তি তো আমিই দেখা শোনা করছি বহুকাল যাবত। আপনি আমাকে সব জমিজমা লিখে দেন। আপনারা শহরে বাড়ী করেছেন। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার লাইনে রেখেছেন। তাদের তো আর গ্রামের দরকার হবে না। আমার ছেলেরা আমার কথা মতো চলে না। একেকজন একেক পথের পথিক। খায়দায়, ইচ্ছে হলে কাজকর্ম করে, না হলে,করে না। তারা খুব জোর দিচ্ছে জুদা হওয়ার জন্য। তাদের তো কিছু দিয় আলাদা করতে হবে।'
নুরু মিয়ার প্রস্তাব শুনে মামা চমকে ওঠেন। তিনি নিজে কখনও এরকম কথা চিন্তা করেননি। তবুও বললেন, দেখ নুরু মিয়া, তোমার সাহস একটু বেশী। এ জমি আমার একার নয়। এ জমি আমার পিতামহ, পিতা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন। বুকের রক্ত ঝরা পরিশ্রম করে ক্রয় করেছেন, বাড়িয়েছেন। অতন্দ্র প্রহরীর মতো দিবারাত্র পরিশ্রম করে তা রক্ষা করেছেন । আমরা ইচ্ছে করলে বহু বছর আগেই এসব বিক্রি করে প্রচুর টাকা লাভ করতে পারতাম। কিন্তু আমরা তা করিনি। কেন করিনি তার কারণ আছে। আমাদের টাকা -পয়সার প্রয়োজন নেই, তা নয়। পিতা, পিতামহের পরম প্রিয় ছিল এ জমি। এই বাড়িঘর। তাদের প্রিয় ধন -দৌলত বিক্রি করতে মন চায় না। আদের আত্মা কষ্ট পাবে। নিজেদের আরাম আয়েশের জন্য পিতৃপুরুষের সম্পত্তি বিক্রি করে দেব, আমরা কি এমনই লক্ষ্মীছাড়া? তুমি দীর্ঘদিন ধরে আমাদের বাড়ী আছো, আমাদের যাবতীয় বিষয় সম্পত্তি ভোগ করছো। আমরা কোনদিন তার হিসাব চাইনি। আজ তুমি চাচ্ছো জমির মালিক হতে? তোমার অসুবিধা হচ্ছে বলে আমি তোমাকে জমি লিখে দিতে পারিনা।
তুমি আজ নুরু মোহাম্মদ খাঁ। সফেদ পাজাম পাঞ্জাবী পরো। মাথায় গোল ক্রুশের টুপি। দাড়ি রেখেছ। গাঁয়ের লোক তোমাকে মান্যগণ্য করে। তোমার তৃতীয় জেনারেশানের লোকেরা জানেই না তুমি কার বাড়িতে থাকো, কার জমি চাষ করো। তোমার হাতে যথেষ্ট টাকাকড়িও আছে।
তিন ফসলী জমি আমাদের । সোনার টুকরো একেকটা ক্ষেত। এত বড় বড় ক্ষেত ওই তল্লাটে কারোরই নেই। বছরে কয়েকশত মন ধান ঘরে তোল। রবিশস্যের ফলনও কম নয়। শাক সবজি, ফল ফলাদি -কোনটা না ফলে? অঘ্রাণ মাসে দিগন্তজোড়া সোনালী ধানের ক্ষেত দেখে চোখ জুড়িয়ে যায় । প্রাণ আনন্দে নেচে ওঠে। ধানের শীষে শীষে ঘর্ষণের ফলে কি যে মৃদু শ্রুতিমধুর ঝংকার অনুরণিত হয় -তা শ্রোতা মাত্রেরই হৃদয় পুলকিত হয়। মনে পড়ে আমাদের ছোটবেলার কথা। গৃহাংগনে মেয়েরা নবান্নের আগমনে অনুষ্ঠান করতো। ধানের শীষের প্রথম গোছা নিয়ে বড় ঘরের 'মধ্যম খামে' (কেন্দ্রীয় খুঁটি ) টাঙ্গিয়ে রাখতো। সেদিন বাড়িতে পিঠেপায়েস রান্না হতো । মেয়েদের নৃত্য, গীতে ভরে উঠত গৃহস্থের অন্তঃপুর। কত যে আনন্দ হত নবান্নের! যাক সে সব কথা। তোমার হাতে প্রচুর টাকা পয়সা থাকার কথা। তোমার মনে পরে 'গিরস্ত' আমাদের গাঁয়ে আর নেই। তোমার চেয়ে কম জমির মালিকরাও বছরে বছরে না হোক , মাঝেমধ্যে খেত - খোলা ক্রয় করেন, শুনতে পাই। তোমার উচিত ছিল কিছু জমি জমা ক্রয় করা। জমি লিখে নেবার বায়না ধরা তোমার কি উচিত হচ্ছে?
- 'কি করব ভাই সাহেব? ছেলেরা যে আমাকে ছাড়বে না। তাদের সংসার বড় হচ্ছে। এত বড় সংসার একত্রে রাখা যাচ্ছে না। নিত্য কলহ, নিত্য বিবাদ হচ্ছে । আমার তেত্রিশজন নাতি নাতনী। সব মিলিয়ে প্রায় ৫০ জনের খাবার এক হাঁড়িতে রান্না করা যায় না। তারা অনেকেই যার যার হাঁড়ি আলাদা করে নিয়েছে। সেজন্য জুদা করে দেয়া জরুরী হোয়ে পড়েছে।'
-'জুদা করতে অসুবিধার তো কিছু দেখি না। আলাদা করে দেয়ার জন্য জমির মালিকানা লাভের প্রয়োজন নেই। মালিক না হয়ে গত চল্লিশ বছর ধরে তুমি ভোগ করছ তাতে তো কোন অসুবিধা হয়নি। তোমার ছেলেরা পৃথক হাঁড়ি চড়ালে তাতে কোন মহাভারত অশুদ্ধ হবে না। শুন, নুরু মিয়া, যদি অনেক আগে তোমাকে এ জমি লিখে দিতাম তাতে এতদিনে সব বিক্রি করে শেষ করে দিতে। যে নুরু মিয়া ছিলে তুমি, সেই নুরু মিয়া হয়ে নিজের ভিটেয় বসত করতে। আজকের নুরু মোহাম্মদ খাঁ হতে পারতে না। যদি আজ আমি তোমাকে ওই জমি লিখে দিই, তবে আগামীকাল থেকেই তোমার ছেলেরা ওগুলো বিক্রি করতে শুরু করবে। আমার একথা দিনের আলোর মত স্পষ্ট এবং সত্য। কারণ এ জমি তোমাদের কষ্টার্জিত সম্পত্তি নয়। পরের জমি, এর জন্য তোমাদের কোন মায়া নেই। তুমি বড়লোক হয়েছ। লোকে তোমাকে সম্মান করে। আমিও তোমাকে অসম্মান করিনা। কেবল একটি কথাই বলতে চাই, এ রকম অন্যায় আব্দার আর কোনো দিন কোরো না। আরেকটি কথা এ সঙ্গে স্মরণ করিয়ে দিই, মনে রেখ, এ জমি তোমার নামে দিলে বৃদ্ধ বয়সে তোমাকে উপোষ করে মরতে হবে। তোমাকে কেউ খাবার দেবে না। সেজন্য ওসব চিন্তা বাদ দিয়ে ছেলেদেরকে পরিশ্রম করে যার যার পথ দেখতে বলো । সাতজনের সংসার একত্রে রাখার নজির বোধহয় আর গ্রামে নেই। তুমি তাদেরকে পৃথক করো। তাতে বাড়িতে শান্তি আসবে।
নুরু মিয়া আবার বলে, 'ভাই সাহেব আপনি আমার অবস্থাটা ভালভাবে চিন্তা করে দেখেন। তারপর মত দেবেন। আমি কতকাল ধরে আপনাদের সম্পত্তি দেখাশোনা করে আসছি। আমার তো একটা দাবি আছে । '
মামা বললেন, 'আমাদের বাড়িঘর বিষয় -সম্পত্তি দেখাশুনা করেছ ঠিকই, কিন্তু তাতে আমাদের তিন ভাইবোনের কি উপকার হয়েছে? আমরা সেখান থেকে কি পেয়েছি? সেখানে তো গিয়ে দু'দিন্থা কার পরিবেশ ও নেই। বরং নিজের টাকায় বাপজানের ঘর মেরামত করে ঠিক রাখতে হয়। বাড়ির অন্যান্য ঘর কোথায় গেল ? কাজেই ও কথা আর বলো না যে তুমি আমাদের সম্পত্তি দেখাশুনা করেছ। বরং বলো ভোগ করেছ। ভোগ করে তোমার নিজের উপকার করেছ। তোমার ভাইদের অবস্থা দেখ না? তারা তো সপরিবারে দিনচুক্তি করে খায়। আর তুমি আজ নুরু মোহাম্মদ খাঁ। বছরে হাজার হাজার টাকার ধান গোলায় তোল। লক্ষ লক্ষ টাকার সম্পত্তি নিজর নামে লিখে নিতে এসেছ। এত উপকার করা সম্ভব নয়। তোমাকে ভাল মানুষ মনে করি এখনও । তোমার বয়স আমার চেয়ে খুব একটা কম নয়। সাংসারিক বুদ্ধি আমার চেয়ে তোমার হয়তো বেশী। তবুও অটি লোভ ভাল নয়। হয়তো জান, লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। শেষে তোমার সব যাবে, তোমাকে দেখার এখনও কেউ নাই -তখন সেই দুঃসময়েও কেউ থাকবে না ।এত বড় সংসার তুমি পত্তন করেছ, আগামী দশ বছরে তোমার ছেলেমেয়ে ও নাতি নাতনীর ঘরে কমপক্ষে আরও একশজন মানবসন্তান জন্ম লাভ করবে। তারা তোমার সাক্ষাৎ বংশধর । কিন্তু তুমি তাদের কেউ নও। তোমার বিশাল সংসার তোমার কাছে নিশার স্বপ্ন বলে মনে হবে। আমার আজকের কথাগুলো ইয়াদ রেখো। যদি বেঁচে থাক, তাহলে বৃদ্ধ বয়সে মিলিয়ে দেখ।‘
পরের দিন মামাকে খুব বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল। মা জানতে চাইলেন বিষণ্ণতার কারণ। মামা মৃদু হেসে বললেন, 'কই না তো?'
সেদিন নুরু মিয়াও বিষাদ ভরা চিত্তে দেশে অর্থাৎ গ্রামে ফিরে গেল। সকালে আর আগের মত প্রাণ খুলে গল্প করতে পারলো না।
সেসময়ে বাস চলাচল ছিল খুবই সীমিত। ট্রেন ধরতে হবে বলে তাড়াহুড়ো করে বিদায় নিল। নুরু মিয়া অর্বাচীন। তার এহেন দায়িত্বহীন প্রস্তাবে মামা এতই অবাক হয়েছিলেন, কয়েকদিন তিনি আর কোন কথাই বলতে পারলেন না। তার কেবল শৈশবের সোনাঝরা দিনগুলোর কথা স্মরণ আসতে থাকে। এত সুন্দর মানুষের বাল্যকাল থাকে! এমন পিতামাতার ঘরে তাদের জন্ম! তারা ভাগ্যবান যে এমন ক্ষণজন্মা নারী -পুরুষের হেফাজতে বিধাতা তাদেরকে পাঠিয়েছেন।
বেশ কয়েকদিন পর একদিন বিকেলে চায়ের আসরে মামা আমাদের সকলকে নুরু মিয়ার প্রস্তাবের কথা বললেন। আমার ভাই -ভাবিও সেদিন উপস্থিত ছিল। আমার মামার কাছে সেই সকল বক্তব্য শুনে আমরা আশ্চর্য্য হলাম। আমার জননী বজ্রাহত হলেন। তিনি তো সেখানে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেছেন।
ওখানকার সবকিছু মায়ের হাতেই ছিল। সেজন্য তার কষ্ট হচ্ছে সবচেয়ে বেশী। মামা তার নিজের কথাও বললেন, যা তিনি নুরু মিয়াকে শুনিয়েছেন।আমরা সকলে একবাক্যে মামাকে সমর্থন করলো। লোকটার অবিমৃষ্যকারিতা দেখে বিচলত হতেই হয়। ছোটমামা থাকেন বিদেশে। তাকে এসব জানানো যায় না। তার প্রাণ এমনিতে বাড়ীর জন্য কাঁদে। তার জন্য এসব সংবাদ পীড়াদায়ক হবে।

।। নয়।।
আমার মামা সেই প্রতারক রহমতুল্লাহ্র বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। ঘটক আগে থেকেই নিরুদ্দেশ। সুতরাং রহমতুল্লাহ্র মনের ভাব জানার কোন উপায় নেই। কোর্টেই দেখা। মামা যে অভিযোগ দায়ের করেছেন তা খণ্ডন করার কোন পথ ছিল না। তার পক্ষে সমর্থন করে কোন সাক্ষী আসেনি। উকিল ব্যতীত সেই দুর্বৃত্তের আর কোন আপনজন এখানে উপস্থিত ছিল না।, মামা বললেন, 'অনেককেই তুমি অকারণে জেলে ঢোকাও। এবার নিজে একটু জেলের স্বাদ গ্রহণ করো।তুমিএক দুশ্চরিত্র, খল, তোমার কপালে আরও দুঃখ আছে। সেদিনের জন্য প্রস্তুত হও।
নারী নির্যাতন আর প্রতারণার দায়ে রহমতুল্লাহ্র তিন মাসের জেল হয়। সংগে জরিমানাও ধার্য্য হয়। অনাদায়ে আরো একমাস কারাবাস।
দণ্ড প্রাপ্তির পর রহমতুল্লাহ্ এ শহরে বাস তুলে খুলনায় চলে যায়। সেখানে হয়তো তার দুষ্টু বুদ্ধির খেলা আরও খেলতে পারবে।
এই কলেজে আমি নতুন। সেজন্য আমার পরিচয়ের পরিধি একটু ছোট। তাই আমার ব্যক্তিগত ঘটনার কথা কেউ জানতে পারলো না। তখনকার দিনে বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়ার দায়িত্ব মেয়েদেরই বহন করতে হতো। ঘটনা যাই ঘটুক না কেন, মেয়েদের তা সহ্য করে সেখানে টিকে থাকতে হবে । তাতে যদি তার মৃত্যুও হয় , কেউ কিছু মনে করবে না। দুর্ভাগ্য বলে আফসোস করবে। সুতরাং এসব ব্যাপার যথাসম্ভব গোপন রাখাই সর্বোত্তম পন্থা। আমাদের পরিবারে ব্যাপারটি সেরকম নয়। আমাদের বাড়ির লোকেরা আমার জীবনের ঘটনাকে স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করেছেন। তবে গুরুত্ব দিয়েছেন যথেষ্ট।
আশ্চর্যের বিষয় এই যে, আমার আর শিহাবের জীবনের ঘটনার মধ্যে যথেষ্ট মিল দেখা যাচ্ছে। আমরা দুই বান্দাই প্রতারিত হয়েছি। রহমতুল্লাহ্ হয়তো আমাকে মেরেই ফেলত। অন্যদিকে লতিফা বানু শিহাবকে প্রাণে মারেনি বটে, তবে জীবনের ফল্গুধারাকে অনুর্বর মরুপথে নিরুদ্দিষ্ট করে দিয়ে গেল। সৎ, সুন্দর একটি নিস্পাপ আত্মা চিরকালের জন্য ভূ-লুণ্ঠিত হলো। অপমান ও আত্মগ্লানিতে এই চরিত্রবান লোকটির বিশ্বাসের ভিত কেঁপে উঠলো। তিনি ঠিক করলেন আর কোনদিন এপথ তিনি মড়াবেন না। একলা চলাই হবে জীবনের ব্রত। আমি অবশ্য কোন ব্রত গ্রহণ করিনি। চলতে থাকে জীবনের রথ। কোথায় কোন নক্ষত্রলোকে গিয়ে থামবে কে জানে। কারণ সেই অদৃষ্ট , সেই ডেস্টিনি, যে আমাকে নিয়ন্ত্রণ করে তার বৃত্তের বাইরে যাওয়া তো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এই উপলব্ধি আমার নতুন। ভাগ্যে বিশ্বাস ছিল না বলেই হয়তো আমার জীবনের এই নির্মম পরিহাস।
শিহাবের উপাখ্যান বড়ই বিচিত্র। তার কথাই আগে বলতে হয়। সেই লতিফা বানু বাংলার পল্লীগ্রামের অন্তঃপুর থেকে বেরিয়ে এসে শহরে থেকে বি.এ. পাশ করেছিল। তার এ সাফল্য ছিল পরিবারের জন্য গৌরবের বিষয়। একটি শিক্ষিত সে যুগে গোটা পরিবারের এবং সমাজের আলোকবর্তিকা বহনকারী। মেয়ে বি.এ. পাশ, লোকের মুখে মুখে ফিরত। কিন্তু লতিফা বানুর কোন আদর্শ ছিল না। স্বার্থপর চরিত্র তার। কারো জন্য তার কিছুই করার ছিল না। উচ্চভিলাষী। সেই নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য যে কোন অন্যায়ের আশ্রয় নিতে কুণ্ঠাবোধ করত না। তার জনক -জননী সাধারণ ভাল মানুষ ছিলেন। শিক্ষার আলোয় তারা আলোকিত ছিলেন না। বংশধরদের শিক্ষা -দীক্ষা প্রাপ্তির দিকে নজর দিয়েছিলেন। কিন্তু তারা আলোর পরিবর্তে অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত হলেন।
লতিফা বানু শিহাবের টাকা পয়সা, গহনাপত্র নিয়ে বশিরউদ্দিন সঙ্গে বিলেত গমন করে তার স্বপ্নের সাত সাগরের ওপারে। বশিরউদ্দিনের যাতায়াত খরচ সেই বহন করে। বিলেতে গিয়ে কিছুদিন তারা নতুন জীবন যাপন করে আনন্দের সাথে। ইংল্যান্ডের যা কিছু দর্শনীয় প্রায় সবগুলো তারা দেখে ফেলে। টাকা পয়সাও যথেষ্ট খরচ হয়ে যায়। লতিফা বানু চাকরীর সন্ধান করে। সে দেশে তো চাকররী অভাব নেই। ছোটখাটো অনেক কাজ করা যায়। ঘন্টায় ঘন্টায় কাজ করা সম্ভব। যে কাজ এ দেশের শিক্ষিত মেয়েরা করে না। তবুও বিলেত বলে কথা।কল্পনার রাজপুত্রকে নিয়ে স্বপ্নের দেশে বাস করা। এখানে কোন কাজই তুচ্ছ নয়। সব ভাল। সব করা যায়। তাদের বেশ ভালই সময় কাটে। অতীতকে তারা জীবন থেকে কেটে বাদ দেয়। সেখানে কেউ ছিল না। দু'জনে উপার্জন করে, খায় দায়, আনন্দ করে। দু'জনের কাজের ধারা দু'রকম। সেজন্য তাদের দেখা -সাক্ষাত একটু কম হচ্ছে। একজন যখন কাজে যায়, অন্যজন তখন বাসায় ফেরে । সদা সর্বদা ব্যস্ত - ত্রস্ত ভাব। তাদের সময়ের খুব টানাটানি। শেষ পর্যন্ত দেখা যায় তাদের দেখাই হয়না। প্রায় নানা কাজে বশিরউদ্দিন জড়িয়ে পড়ে । বশিরউদ্দিন সে দেশে গিয়েছিল ব্যারিস্টারি পড়তে । কিন্তু ব্যারিস্টারি পড়া তার হয়েছিল কিনা তা কেউ জানেনা। এমনকি তার পিতামাতা বা অন্য কেউ তা জানেনা। তবে আয় কম নয় তার। দেশের তুলনায় রোজগার অনেক বেশী।
বাঙালি বন্ধু তাদের বেশ কয়েকজন আছে। তারাও ততটা আন্তরিক নয়। সপ্তাহান্তে দেখা -সাক্ষাত হয়েছে প্রথম প্রথম। এখন বশিরউদ্দিন সময় করতে পারে না। সেজন্য বন্ধু -বান্ধবের বাড়িতে যাওয়া হয়ে ওঠে না। লতিফার হৃদয় প্রকোষ্ঠে কোথায় যেন প্রশ্ন জাগে, সন্দেহ জাগে। কিন্তু সেসব প্রশ্নকে সে প্রশ্রয় দিতে চায় না। দিন যায়। যদিও দীর্ঘদিন নয়। লতিফা লক্ষ্য করে তার
P55

... চলবে