রবিবারের রং কি?
সাইদুজ্জামান
গল্প এবং সংবাদের মধ্যে একটা পার্থক্য নিশ্চয় আছে। প্রেম-পিরীতির গল্প
বলে কথা আছে বটে,
তবে প্রেম-পিরীতির সংবাদ বলে এমন কোনো আজগুবি কথা এই ত্রিভুবনে কেউ
শুনেছে? প্রেম বলে কিছু নেই,
কিছুই নেই? তা সে যাই হোক,
স্বল্প কথায় বলি আমার একটা গল্প আছে বলার,
আর একটা ভয়ও আছে আর কখনো যদি এই গল্প-টি বলা না হয়ে
ওঠে।
টরন্টোর স্বল্পায়ু গ্রীষ্মকালে আলস্যময় রবিবারে
স্মৃতির ভিতর থেকে গল্পের জামা কাপড় খুলে বেরিয়ে আসে নগ্ন একটি সংবাদ।
রবিবার, মে ৫,
১৯৯৬ইং। শুভময়ের বউ অনুরাধা আত্মহত্যা করে ঐদিন।
রবিবার, মে ৫,
২০১১ ইং অনুরাধার মেয়ে অহনার বয়স ১৮ বছর হয়ে এলো।
রবিবার, মে ৫,
২০১১ ইং শুভময় নিজেকে শুধোয় রবিবারের রং কিগো?
সে দুকান ভরে শোনে বর্ণের কোলাহল,
দুচোখ ভরে দেখে শব্দের অপরূপ রূপ। বিজ্ঞানীরা একেই কি
বলে সপ্তম ইন্দ্রীয়, নাকি সিনেস্থেঝিয়া?
শুভময় ১৮ বছর বয়সেই বিদেশে চলে যায় এঞ্জিনিয়ারিং পড়তে।
১৯৮২, কোলকাতা-মস্কো,
জীবনের প্রথম উড়োজাহাজ ভ্রমণ। জীবনের প্রথম পিছনে ফেলে যাওয়া এক
অমীমাংসিত ভালোবাসা, একজন অনুরাধা সরে গেলো
দূরে, সরে গেলো জীবন থেকে। সামনে অহংকারী
সুবর্ণ সোভিয়েত দেশ। অনুরাধার সাথে তার সম্পর্ক যে বিভিন্ন কারণে
অসম্ভব, তা দেশ ছাড়ার আগেই জানতে পারে শুভময়।
অনুরাধা-শুভময় খুব নিকট না হলেও আত্মীয়, রক্তের
সম্পর্কও আছে। অনুরাধার দিদিমা আর শুভময়ের ঠাকুরদা আপন ভাই-বোন। যদিও
দু’বাড়ির মধ্যে সাধারণ যোগাযোগ আছে,
অনুরাধার বাবা-মা দুজনেই ওদের সম্পর্কের প্রতিকূলে। ওর বাবা এবং দাদা
অনুরাধাকে মারধোরও করেছে। বুকের ভিতর এক তীব্র ব্যথা পেঁচিয়ে ওঠে
শুভময়ের, মানুষের নির্বুদ্ধিতার কি
সীমা-পরিসীমা নেই? প্রকৃতই সীমা-পরিসীমা নেই,
তাই তো শুভময় আর পিছনের দিকে তাকাতে চায় না। সে এই
নতুন প্রবাসী কর্মচঞ্চল জীবনে নিজেকে ডুবিয়ে দেয়। সময় বয়ে যায়। ইভান
বুনিন, বরিস পাস্তেরনাক,
সের্গেই ইয়েসেনিন
– অন্যান্য আরও অনেক কিছুর সাথে
এইসব বিখ্যাত লেখকদের মূল রচনা নিয়ে তার জীবন ভালই কাটছিলো। বছর পাঁচেক
এ রকম ভালো থাকা।
তারপর একদিন ডাকে চিঠি আসে কোলকাতা থেকে। অনুরাধার
চিঠি। সংক্ষিপ্ত এবং স্পষ্ট।
‘তোমার
ঠিকানা পেয়েছি তোমার বোন স্মিতার কাছে। যদি অসম্ভব না হয় একবার দেশে
এস। আমি ভালো নেই,
তুমি ভালো থেকো। -অনুরাধা’।
‘আমি আসছি অনু...আমি আসছি...অ...নু...’ , এই অনন্য চিত্কার অনন্ত
কুয়োর গভীরে এক প্রতিধ্বনির মতো শোনায়। এইসব ধ্বনি-প্রতিধ্বনির সাক্ষী
থাকে না।
শুভময়ের সুখের ট্রেন ভুতের কিলে লাইনচ্যুত হয়ে গেলো।
খাদের পাশে চাঁদের ডাকে ফিরে এলো সে কোলকাতায়,
ঘুরে দাঁড়ালেও ক্ষতি কিছু ছিল না তবু ফিরে এলো একাকী অনুরাধার আয় আয়
ডাকে। ভেন্যু: কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ঝোপের
ছায়ায় খোলা মাঠের ঘাস। দীর্ঘতম পাঁচটি বছর পর এই দেখা হওয়া। শুভময়
তাকিয়ে থাকে অনুরাধার চোখে চোখ রেখে। ফুরিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে না এই
মুহূর্ত। কিছু শুনতে চায় না, যেতে চায় না
কোথাও। শুধু তকিয়ে থাকতে ভালো লাগে অনুরাধার দুচোখ থেকে বেরিয়ে আসা
সাংঘাতিক সুন্দর বিপজ্জনক এক জোছনার দিকে। শুভময়ের কোনো বক্তব্য নেই,
অনুরাধার কিছু বলার আছে।
- আমার অনেক দুর্ঘটনা ঘটেছে শুভ,
এই গত বছরগুলোতে।
- অনু, আমাকে আজো তুমি বন্ধু
ভাবলে বলতে পারো কি হয়েছে, আমি যদি পারি
সাহায্য করবো।
- তোমার শুনতে খারাপ লাগবে শুভ।
- না লাগবে না, আমার কোনো
কিছুতেই খারাপ লাগে না।
- শুভ, আমি এক ছেলের হাত ধরে
চলে গিয়েছিলাম পালিয়ে বিয়ে করতে, বিয়েটা যদিও
শেষমেষ হয় নি।
এমন কিছুই কি হওয়ার কথা ছিল না?
অনুরাধার মতো সুন্দরী মেয়ে কোলকাতায় হাত গুটিয়ে বসে
থাকবে সেরকম আশা শুভময় করেনি। ওর কাছে খুব-ই স্বাভাবিক মনে হয়েছে
অনুরাধার সংক্ষিপ্ত ব্যর্থ প্রেমের দুর্ঘটনা। তবু আরো একবার বুকের ভিতর
তীব্র ব্যথা পেঁচিয়ে ওঠে। পেঁচিয়ে ওঠে রেস্তরাঁর নীল আলোয় সিগ্রেটের
ধোয়ার মতো। সামলে নেয় শুভময়। তার সামনে যে মেয়েটি তার নিতান্ত
ব্যক্তিগত এবং কষ্টকর অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করছে,
তার কষ্ট নিশ্চয়ই শুভময়ের চেয়েও বেশি। শুভময়
বন্ধুত্বের হাত বাড়ায়, সে শুনতে চায় সমস্যার
কথা, দিতে চায় সমাধান। অনুরাধা বলতে থাকে এক এক
করে সব। সেই ছেলেটির কথা যাকে ভালোবেসে পালিয়ে বিয়ে করতে চেয়েছিলো। সেই
মাঝবয়সী ম্যাজিস্ট্রেটের কথা যে হতে দেয় নি এই বিয়ে,
ফিরিয়ে এনেছে তাকে তার বাবা-মার কাছে। এ পর্যন্ত
গল্পটি জলের মতো সহজ হতে পারতো, জীবন মানেই সব
সময় নদীর মতো সরল গা ভাসানো নয়, জলপ্রপাতের মতো
জটিল ক্রুদ্ধ আছড়ে পড়াও আছে। ম্যাজিস্ট্রেট ক্ষমা করেনি অনুরাধার
যৌবনকে, পেশাগত নীতিমালা,
দায়িত্বে সততা, বয়সের ব্যবধান
সবই কি তুচ্ছ হয়ে যায় যৌনতার জাদুঘরে? সর্বত্রই
নয়, শুধু অনন্ত কুয়োর জলে ব্যাঙ এই বঙ্গভূমে।
রবি কবির সেই বিখ্যাত লাইনটি মনে পড়ে শুভময়ের: সাত কোটি সন্তানেরে হে
মুগ্ধ জননী, রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করনি।
রাশিয়ায় হলে এমনটি হতে পারতো? না,
পারতো না। এতগুলো বছর ইউরোপে থেকে শুভময়ের দৃষ্টি যেনো
খুলে গেছে অনেক, বাঙালি বলে গর্ব করার ভরসা সে
খুব একটা পায় না, নিজ বঙ্গভূমে
বালক-বৃদ্ধ-বণিতা নির্বিশেষে মানুষের মানসিক দীনতা তাকে আহত করে। বড়
ইচ্ছে হয় অনুরাধা নাম্নী এই ডিপ্রেস্ড মেয়েটিকে সাহায্য করতে যে কোনো
মূল্যেই। শুভময় অনুরাধাকে ভালোবাসে, দান দিয়ে
প্রতিদানের আশায় নয় এই সাহায্য করতে চাওয়া। এই ভালোবাসা নিঃস্বার্থ।
একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধে নামার মতো এই ভালোবাসা। শুভময় প্রস্তাব
করেঃ অনু, তুমি আমাকে বিয়ে করবে?
আমাকে তোমার বাবামার সাথে কথা বলতে দাও,
তোমারতো পুরো জীবনটাই প্রায় সামনে পড়ে আছে। বাবা-মার
সাথে কথা বলার ব্যাপারে অনুরাধা পাশ কাটে, রাজি
হয় না। ও প্রস্তাব করে কোর্টে বিয়ে করতে। কোর্ট তা কোর্টই হত,
অনুর দাবি ওর সেই ম্যাজিস্ট্রেটের কাছেই যেতে হবে।
হৃদয়ের চেয়ে শারীরিক সম্পর্কই বোধ হয় প্রবল বেশি,
যত দূরই হোক না কেন সেই স্মৃতি। অনুরাধার সাথে মধ্য
বয়স্ক বিবাহিত ম্যাজিস্ট্রেটের সম্পর্কটি যত কালোই দেখাক না কেন,
মানুষের শ্রেষ্ঠ জীববৈজ্ঞানিক রসিকতাটি এই যে কাঙ্খিত
বা অনাকাঙ্খিত, স্বল্পায়ু বা দীর্ঘায়ু,
মধুর বা বেদনা বিধুর যে কোনো যৌন সম্পর্কই হৃদয়ে এক
দীর্ঘস্থায়ী স্থান দখল করে থাকে, তা কখনই
সম্পূর্ণ ঘৃণার নয়, কে জানে হয়তো আদৌ ঘৃণার নয়।
ভালো লাগে না শুভময়ের এইসব। তবু সে মেনে নিতে থাকে এক এক করে সবই যা
তার ভবিষ্যত স্ত্রী করতে চায়। অনুরাধার প্রাক্তন বুড়ো প্রেমিক ওদের
বিয়ের কাগজ রেজিস্ট্রি করে। অনুরাধার চোখের তারায় বুড়ো প্রেমিকটির
জন্য এক বিশেষ মায়া শুভময়ের দৃষ্টি এড়াতে ব্যর্থ হলো। নাটকটির যবনিকা
পতন হওয়া উচিত ছিল এখানেই, তবে হলো না। আরও
অনেক কিছু দেখার আছে। শুভময় দেখবে। দেখে যাওয়ার জন্যই কি এই জন্ম
শুভময়ের?
বিয়ে ফেরত শুভময় একাকী বিদেশে। বুকের ভিতর তীব্র ব্যথা
পেঁচিয়ে ওঠে। সুরঞ্জনা সাপের মতো পেঁচিয়ে ওঠে বুকের ভিতর বুকের ব্যথা,
মাঝে মধ্যে উঠে আসে গলার কাছে,
পেঁচিয়ে গোল হয়ে থাকে, কোথাও বিশেষ পালিয়ে যায়
না। কোলকাতা থেকে অনুরাধার ডাক-চিঠি আসে নিয়ম মাফিক। অনুরাধার মত
বদলেছে। কোর্টের বিয়ে কোনো কাজের কথা নয়,
ধুম-ধাম করে এবার বিয়ের পার্টি করতে হবে। বাবামাকে এবার একটু শান্তি
দিতে চায় অনুরাধা। বাবামাকে এই একটু শান্তি দেওয়ার কথা অনুরাধা আর একটু
আগে ভাবলেও পারতো। শুভময় নিজেই তো তাকে সেরকম কথাই বলেছিলো তখন।
আবার কোলকাতা। কলিকাল কি কলিকাতাতেই?
খুব ধুমধাম করে ধর্ম মতে বিয়ের পার্টি করাটাই মুখ্য নয়,
অনুরাধার এবারেও কিছু কথা আছে। ইশ্বর মুক্তি দাও,
জানো তো পারবো না সইতে এতসব। মুক্তি?
এক্ষুনি? একটু অসম্ভব
– এই প্রেক্ষাগৃহে তুমিই
নির্বাচিত দর্শক শুভময়। দেখে যাও, শুধু চোখ
মেলে দেখে যাওয়া, আর তো কিছু নয়। অনুরাধার
এবারের প্রেমিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, একই
সাথে পড়ে। অনুরাধা যদি তার এই বারবার প্রেমে পড়ার বিষয় আশয় গোপন রাখতো
তাহলেই বরং শুভময় বুঝি খুশি হত বেশি। তা কি করে হয়?
অনুরাধা ঠকাতে চায় না বরকে। কবে কখন ওর মরুভূমির মতো
খা খা করা ঠোঁটে পদ্মাপাড়ের এই ব্র্যান্ড নিউ যুবক প্রেমিকটি চুম্বন
ভোগ করেছিলো তার নিখুঁত বর্ণনা দিলো অনুরাধা। বাধ্য করলো ব্যক্তিগত
সাক্ষাতেও। বিয়ে–পার্টির আয়োজন নিস্তরঙ্গ হলো না। শুভময়ের দেওয়া শাড়ি গহনার
কিছুই অনুরাধা পরিবারের পছন্দ হলো না। যাদের সাধ্য থাকে না তাদের সাধ
আসে কোত্থেকে এই কথাটা অনুরাধার বাবামার মাথায় এক সুদীর্ঘ সময় ধরে
সেধোলো না কিছুতে। অনেক পিষ্ট হলো,
তিক্ত হলো লেবু। বিবাহ উত্সবে যুবক প্রেমিক ভগ্ন বুকে
বর কনের ছবি তুলে গেলো। শুভময় তাকিয়ে দেখে যুবকের মুখে অন্ধকার আর
বিষাদ। হে ঈশ্বর!
ফুলশয্যার রাতে বর, বধু,
ফুল, অথবা শয্যা কোনটাই সেরকম
অর্থ বহন করলো না। জীবনে একবার আসা এমন রাতেও রবীন্দ্রনাথের কোনো কবিতা
মনে এলো না। বাংলা সাহিত্যের অন্য একজন কবি শুভময়ের জীবনে খুব প্রভাব
ফেলেছেন, অগত্যা তিনি-ই এলেন। কবি শক্তি
চট্টোপাধ্যায়।
‘রাত দুপুরের শ্মশান চিতা আমাকে দাও কোল’ কবিতাটাই বারবার খুব মনে পড়লো।
ফুল শয্যার ফুলগুলো শুকনো ডালপালার মতই মনে হলো তার। বিরতি বিহীন সুখী
মুখের জন্য এইভাবে সংগ্রাম করে যাওয়া। বুকের ভিতর সুরঞ্জনা সাপটি খেলায়
মত্ত, বুক থেকে গলা,
গলা থেকে মাথার ভিতর উঠে পড়ে কখনো সখনো। বাথরুমের আর্শিতে পরীক্ষা করে
দেখে শুভ - চোখের কোথাও আকস্মিক জল আছে কি না। না নেই। সে এবারও পেরেছে
চেপে যেতে বুকের নিদারুণ ব্যথা।
আর মাতৃভূমি নয়, এখন থেকে
ফুলটাইম প্রবাসী জীবন। অনুরাধার মতো বউকে শুধু বউ হিসেবে বিদেশে নিয়ে
যাওয়া যায় না। সে ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ছিল,
তার ভবিষ্যত ক্যারিয়ার নষ্ট করা অমানবিক দেখায়। স্কলারশিপ দিয়ে তবেই
তাকে বিদেশে নিতে হবে। অনুরাধার বাবা যেরকম প্রভাবশালী ব্যক্তি,
উনি ইচ্ছে করলেই দু দশ জনকে স্কলারশিপ দিয়ে রাশিয়ার
মতো দেশে পাঠাতে পারেন। তবে সেতো অনুরাধার বাবার যোগ্যতা,
ও কথা তোলার এখন কোনো মানেই হয় না। অনুরাধা এখন
শুভময়ের বউ, বাবার সাহায্য এখন কেন নেবে?
সাধ আছে সাধ্য নেই? শুভময়কে
অনুরাধা পরিষ্কার জানিয়ে দিলো বাবার সাহায্য সে নিতে পারবে না,
তবে যে ক’
টা দিন শুভময় অনুরাধার জন্য স্কলারশিপ না জুটিয়ে দিতে পারছে সে বাপের
বাড়িতেই থাকবে। অনুরাধা, অনুরাধার বাবা,
মা, দাদা,
এমন কি কাজের ঝিও শুভময়কে জানিয়ে রাখলো শুধু শুভময়
ছাড়া ও পরিবারের আর কারো সাথে মিশবার অভিপ্রায় এ পরিবারের কারোরই নাই।
শুভময়, একমাত্র তুমিই ভালো,
তুমিই ব্যতিক্রমী, তুমি ছাড়া
তোমার অন্য কোনো স্বজন আমাদের সমাজের যোগ্য নয়। এটাই পরিষ্কার জানিয়ে
রাখলো অনুরাধার পরিবার। শুভময় দেখলো, শুনলো,
ভাবলো, শুধু বললো না কিছুই।
মনে মনে একটু হাসলও বুঝি সে। শুভময়ের ঠাকুরদা অভিজাত জমিদার বংশের শেষ
জমিদার ছিলেন অনুরাধার দিদিমা তা ভালই জানেন। একটা সময় ছিল অনুরাধার
বাবা শুভময়ের পরিবারে দাসত্বের যোগ্যতাও পেত কি না যথেষ্ট সন্দেহ হয়
শুভময়ের। খুব হাসি পায় শুভময়ের। সে নিজেও দেখেছে চোদ্দটা খালি সিন্দুক,
ওগুলোর ভেতর এক সময় ইটের মতো সোনার বার সাজানো থাকতো,
ঘোড়াশালে ঘোড়া থাকতো, হাতি-ও
ছিল। ঠাকুরদা হাতি চড়ে বাজার করতে যেতেন। তাঁর বাজার করা শেষ হোলে তবেই
অন্যরা বাজার করার সুযোগ পেত। ঠাকুরদাটা এক জীবনে জমিদারির পুরোটাই সব
উড়িয়ে দিলেন। ভালই করেছেন বোধ হয় ঠাকুরদা। জাগতিক বিষয় আশয়ের প্রতি
শুভময়ের মোহ মমতা হয় না। তবে তার পারিবারিক ইতিহাসটা খুব ভালো লাগে।
সেই একদা জমিদার পরিবারের কারো যোগ্যতা আজ আর নাই অনুরাধাদের সাথে
মিশবার? খুব হাসি পায় শুভময়ের। একটা সময় ছিল
– সেই সময় এখন আর নাই। মেয়ে
মানুষের অভাব পৃথিবীতে খুব একটা নেই, শুভময়ের
জন্যও নেই। ইচ্ছে করলেই সে নাটকের দৃশ্য বদল করে দিতে পারে। কাগজে যে
স্বাক্ষরে অনুরাধা
‘বউ’
হয়েছে ঐ একই স্বাক্ষরে সে ডিভোর্সী হতে পারে,
এমন কিছু কঠিন কাজ তো নয়। তবে ঐ যে প্রেক্ষাগৃহের
নির্বাচিত একক দর্শক শুভময়, চলচ্চিত্রটি যে
এখনো শেষ হয় নি।
মস্কোয় সোভিয়েত শিক্ষা মন্ত্রণালয় শুভময়ের আবেদন
মঞ্জুর করলো। পেট্রোকেমিক্যাল এঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্কলারশিপ পেলো অনুরাধা।
প্রথম বছর রুশ ভাষা শেখা। এ ভাষাতেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা। রুশ ভাষা
শেখা কতটা সহজ বা কতটা কঠিন তার উপর পাতার পর পাতা লেখা যেতে পারে,
তবে ঐ বিষয়টা প্রাসঙ্গিক নয় এখানে। যে কোনো শিক্ষাই
ইচ্ছা নির্ভর বলে মনে করে শুভময়। অনুরাধার ভিতর ঐ ইচ্ছা নেই। বাঙালি
মেয়ে মাত্রই কি প্রবাসে জীবন্ত শবদেহের মতো?
সম্ভবত নয়, তবু শুভময়ের এই শবদেহ কাঁধে নিয়ে
ফেরা। প্রতিদিন বাড়ি থেকে শ্রেণীকক্ষের দোরগোড়া পর্যন্ত দিয়ে যাওয়া,
নিয়ে যাওয়া, বাজার করা,
রান্না করা, রাতে হোমওয়ার্ক
করে দেয়া। শুধু তারপর রাতদুপুর হয়ে এলে,
ব্যালকনির নিঃসঙ্গ চেয়ারে বসে সিগ্রেটে একটি সুখের টান দিয়ে দূর
অন্ধকারের দিকে বিষন্ন তাকিয়ে শুভময় বলতে পারেঃ হে ইশ্বর!
এতদিন তবু সহনীয় ছিল, অনুরাধা
এবার তার সেরা খেলাটি খেলতে শুরু করলো। প্রতীয়মান কোনো কারণ ছাড়াই
ব্লেডে শরীরের বিভিন্ন স্থান কাটছে
– রক্তপাত হলে নাকি তার ভালো
লাগে। শরীরের অনাবৃত অংশের ভিতর দু হাতে এবং মুখে ভরে থাকছে অসংখ্য
দাগ। কয়েকবার আত্মহত্যার চেষ্টাও সে করলো ঘুমের অসুধ খেয়ে। হাসপাতালে
নিয়ে যেতে হলো বার দুয়েক, পুলিশের মুখোমুখিও
হতে হলো শুভময়ের। অনুরাধাদের ডীন শুভময়কে ডেকে অনুরাধা কোনো নার্কটিকে
আসক্ত কিনা এ নিয়ে নানারকম সংশয় প্রকাশ করলেন। একদা উচ্চশির শুভময়ের
মাথা ক্রমাগত হেঁট হতে থাকলো।
দাম্পত্য যুদ্ধ বেঁধে গেলে বুদ্ধি দিতে কিভাবে যেন লোক
জড়ো হয়ে যায়। তাদেরকে দোষ দেয়া যায় না। অনেকেই পরিষ্কার বুঝলো সমস্যার
মূলে রয়েছে একটি সন্তানের অভাব। আজকাল খুব ক্লান্ত বোধ করে শুভময়,
স্রোতের অনুকূলে গা ভাসিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। দশজন
বিচক্ষণের ধারণা মিথ্যে করার জন্যই বুঝি অনুরাধা গর্ভবতী হলো একদিন।
অন্য আর একদিন অনুরাধার উপর্যুপরি তর্জন গর্জন এবং হুমকির মুখে শুভময়কে
ব্যবস্থা নিতে হলো অকারণ গর্ভনাশের।
বাপের বাড়ি কোলকাতা ঘুরে এলো অনুরাধা গ্রীষ্মের
ছুটিতে। মস্কো ফিরে এসে শুভময়ের সাথে সে আর ঘর করবে না পরিষ্কার জানিয়ে
দিলো। শুভময়ের কোনো আপত্তিই নেই। বিদেশে ডিভোর্স দূতাবাসেই হয়।
দূতাবাসে আবেদন করা হলো যথারীতি। কয়েক ঘন্টার মধ্যেই অনুরাধা উচ্চপদস্থ
অফিসারদের সাথে তুমুল বাধিয়ে নিলো। অনুরাধার বাবামা ফোনে অনেক
কাকুতিমিনতি করলো শুভময়ের কাছে, বিয়েটা যেন
কোনভাবেই ভেঙ্গে না যায় এই বলে। আর একটু হলে বেঁচে যেতে পারতো শুভময়,
তা আর পারলো না। বিবাহ বিচ্ছেদ ভেঙ্গে গেলো,
শুভময়ের করুণাবশে।
কয়েক মাস পর শুভময় নিজে কোলকাতায় বেড়াতে এলো একাই।
অন্তহীন জামাই আদর পেলো। শুভময়ের মতো মহামানব নাকি অনুরাধার বাবামা
তাদের জীবনে আর দেখে নি। শুভময়ের যথেষ্ট আপত্তি থাকা সত্ত্বেও তার
পকেটে একলক্ষ টাকার পরিমানে ডলার গুজে দিলো ওরা। শুভময় কারো সাথেই টাকা
পয়সার সম্পর্কটা রাখতে চায় না। তবু বাধ্য হয়েই নিলো,
সে জানে এ পয়সার একটিও সে নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করবে
না।
শুভময় পি এইচ ডি করছে। ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে খুব। বৌয়ের
পাগলামি কমে নি কিছুই। এতদিন ওরা ভাড়া বাড়িতেই থাকতো। সে এবার
ইন্টারন্যাশনাল হস্টেলে মুভ করার সিদ্ধান্ত নিলো। ওখানে ওদের মতোই নানা
দেশের অনেক ছাত্র-ছাত্রী আছে। অনুরাধার সময়টা হয়তো ভালো কাটবে। ওরা
ফ্যমিলি রুম পেলো হস্টেলে। অনেক বাঙালি ছাত্রও আছে ওখানে,
বাঙালি মেয়ে বলতে বিশেষ কেউ নেই। যারা আছে তারা
অনুরাধার মনের মতো নয়। বাঙালি এক যুবকের সাথে বেশ ভাব হয়ে গেলো
অনুরাধার। যুবকের নাম অতীন। শুভময়কে আর যাই হোক রিটার্ডেড বলা চলে না।
সংসারে বৌয়ের নখর থেকে গা বাঁচাতে শুভময়ের মতো কোটি কোটি পুরুষ চোখ
বুজে এড়িয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে আনসাইটলি অনেক দৃশ্যাবলী। শুভময় একক
দৃষ্টান্ত নয়। অনুরাধা–অতীন,
এই নাটকের বিশেষ এবং চূড়ান্ত এক অধ্যায়।
আর দশজন মানুষের তুলনায় ওদের ঘর বড়ই নিকৃষ্ট মানের,
কালার টি ভি নেই, উল্লেখযোগ্য
কোনো ইলেকট্রনিক্স নেই, এসবই অনুরাধার অভিযোগ।
শুভময় একদিন পুরো একলক্ষ টাকাই খরচ করে ঘর সাজিয়ে ফেললো। সেইসব
ইলেকট্রনিক্স পাথর ছুড়ে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করতে এক ঘন্টার বেশি সময়ও
লাগলো না অনুরাধার। শ্বশুর বাড়ির শাল সেই একলক্ষ টাকা অবশ্য অনুরাধার
নিজের কাছে এবং তার বাবামার হিসেবের খাতায় শুভময়ের নামেই ধার হিসেবে
অক্ষত রইলো।
তিন মাসের গর্ভ শুধু খেয়াল বশে নাশ করার হৃদয়-ওয়ালা
অনুরাধার হঠাত আবার মা হবার ইচ্ছে যথেষ্ট সন্দেহজনক। সন্দেহ-বাতিক
শুভময়ের নেই। প্রেক্ষাগৃহের নির্বাচিত একক দর্শক হিসেবেই সে নিজেকে
মানিয়ে নিয়েছে। শুভময়ের তবু ভালো থাকা হয় না। ত্রিভুজ প্রেমের জটিলতম
ট্রাজেডিই হলো একই টাইম এবং স্পেসে পুরুষ বাহু দুটির সাথে ভূমি নারী
দেহটির নির্লজ্জ চূড়ান্ত সঙ্গম। জ্যামিতিক বহুভুজের জন্য ন্যূনতম তিনটি
লাইনের প্রয়োজন হয়। দু লাইনের জ্যামিতিক আকার নেই,
তিন লাইনের আছে। এ কারণেই গতানুগতিক দ্বিভূজ প্রেমের
কোনো গল্প হয় না, গতানুগতিক দ্বিভূজ প্রেম
সর্বদাই অদৃশ্য, সর্বদাই নিরাকার। জয় ত্রিভুজ,
জয় ত্রিভুবন, জয় ত্রিকাল।
তিন মাস পার হয়ে গেলো,ন’ মাস দশ দিন হয়ে এলো। দুজন
পুরুষের একনিষ্ঠ সেবা শুশ্রূষা, মায়া মমতায় ২২
শে জুন, ১৯৯৩, মধ্যরাতে
অনুরাধা মা হলো। মাতৃসদন চত্বরে রহস্যময় আলো আঁধারির ভিতর দুরু দুরু
বুকে দুজন পুরুষকে পায়চারি করতে দেখা গেলো। একজন আয়া এসে শুভময়ের জামার
আস্তিন টেনে ধরে খুব হাসি মুখে বললোঃ তোমার চাঁদের মতো এক মেয়ে হয়েছে
গো! দাঁড়িয়ে থাকলো কিছুক্ষণ আয়াটি পুরস্কারের আশায়। শুভময় কিছু টাকা
দিয়ে আয়াটিকে বিদেয় দিলো।
শুভময় -অনুরাধার ঘরখানি ভরে উঠলো। একটি শিশু সত্যই বড়
শক্তিমান। পৃথিবীর অন্ধকার মুখে হাসি ফুটানোর জন্যই শিশুদের এই আসা।
ঘরের প্রতি এতদিনকার কেন্দ্রাতিগ শক্তিটি আজকাল আর বোধ করে না শুভময়।
সে খুব খুশি, সে খুব সুখী,
সে এখন খুব ঘরমুখো। শুধু অনুরাধাই আগের মত ঘর বিমুখী,
শিশুর জন্ম তার জীবনে সেরকম লক্ষণীয় পরিবর্তন আনতে
পারলো কই? সময়মতো মাতৃদুগ্ধও ঠিক মতো পেলো না
শিশুটি। যে কোনো ছুতোয় অকারণ হৈচৈ বাঁধিয়ে অনুরাধা আজো সুখ পায়। শুধু
রাগ দেখিয়ে ক্ষুধার্ত শিশুকে খেতে না দিতে বুঝি মায়েরাই পারে। শুভময়ের
দুচোখ বাষ্পাকুল হয়ে ওঠে। শুভময়ের এই নিরুপায় মুখখানি দেখতেই বুঝি
অনুরাধার বড় ভালো লাগে। শিশুটিকে বুকে নিয়ে বাইরে পার্কে শুভময় হাঁটে,
গান গায় গুনগুনিয়ে। ক্ষুধার্ত শিশু একসময় ঘুমিয়ে পড়ে।
শুভময় ভালোবেসে শিশুটির ডাকনাম রেখেছিলো Wren,
গান গাওয়া ছোট্ট এক বুলবুলির নামে। ঐ ডাকনামটি আজ আর বেঁচে নেই।
অনুরাধার বাবামার দেয়া পুরো নামটিই শুধু অনুরাধার অনুমোদন পেয়েছিলো
শিশুটির বার্থ সার্টিফিকেটে দেয়ার। সেই নামটিও আজ আর অক্ষত নেই,
জন্ম তারিখটিও বদলে গেছে।
অতীনের ভূমিকা বিশেষ ভাবেই দ্রষ্টব্য। তবু শুভময় যেন
এক বৃদ্ধের ছানি পড়া চোখে তাকিয়ে দেখে ঠিকঠাক ঠাহর করতে পারে না। মানুষ
নাকি মহামানুষ? নির্দ্বিধায় এক যুবক অন্যের
শিশুর মলমূত্র, নোংরা কাপড় ধুয়ে দিচ্ছে,
মানব ইতিহাসে এজাতীয় ঘটনা কি নজিরবিহীন নয়?
শুভময়ের অভিধানে মহামানব শব্দটি কোনদিন ছিল না। কোনো
মানুষকেই সে বিশ্বাস করে নি কোনদিন, আজো করে
না। শ্রেষ্ঠ মানুষের নাম মনে করতে চাইলে শুভময়ের মনে লাইকা নাম্নী ভুল
নামটি-ই কেন মনে পড়ে? এমন কি নিজেকেও খুব একটা
ভালো মানুষ ভাবে না শুভময়। অতীনের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শেষ হয়ে গেলো।
পেট্রোকেমিক্যাল এঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিগ্রী নিয়ে অতীন ফিরে গেলো কোলকাতায়।
অনুরাধার যেন সন্তানের জন্ম দিয়েই দায়িত্ব শেষ।
শিশুটির দিকে তাকিয়ে চোখে শুধু জল চলে আসে। চোখের জলে দুনিয়ার খুব কম
সমস্যারই সমাধান হয়। শুভময় পার্মানেন্ট বেবি-সিটার রাখলো বাড়িতে। পি
এইচ ডি শেষ করে সে এখন এক আমেরিকান কম্পানিতে চাকরি করে। অনুরাধা
অতীনের সাথে ফোনে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে। খানিকটা দূরত্ব আছে বলেই বোধ
হয় প্রেম এত মধুর হয়, এত আসক্তির হয়। দূরের
চাঁদ নৈকট্য পেলে রূপ হারাতো। কর্তব্যের দোষে দুনিয়ায় বরেরা বা বউয়েরা,
প্রেমিক বা প্রেমিকাদের মতো নিখাদ হতে কখনই পারেনি সেই
প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে। যুগে যুগে অনুরাধা-অতীনরা যেন সেই হ্যামেলিনের
বংশীবাদকের সুরের টানে বাধ্য হয়েই ধাবমান নেশার মতো মৃত্যুর দিকে।
শুভময়ের অনুরাধাও তাই কোনো ব্যতিক্রম নয়। অনুরাধা তাই অপরাধী নয় কোনো,
এমন কি শুভময়ের কাছেও। শুভময়ের রাগ নেই,
অভিযোগ নেই, অভিমান নেই,
এমন কি বিস্ময়ও আর কোনো অবশিষ্ট নেই। অনুরাধা
নির্দ্বিধায় শুভময়ের বুকে মাথা রেখে কেঁদে উঠতে পারে,
কারণ অতীন নাকি মারাত্মক অসুস্থ। মাথা ঘুরে নাকি পড়ে
গিয়েছিলো। কে জানে ব্রেন টিউমার কি না। অতীনের কিছু হয়ে গেলে অনুরাধা
আর বাঁচবে না। প্রেমিকের জন্য স্ত্রীর এই আহাজারি দেখে শুভময় হাসবে না
কাঁদবে বুঝতে না পেরে হাসি-কান্নার মাঝামাঝি একরকম মুখ নিয়ে তাকিয়ে
থাকলো। ওঠে না কি বুকের ভিতর পেঁচিয়ে ব্যথা?
মাঝে মধ্যে ওঠে।
শুভময়ের কাজের বড় চাপ, ঘরে
ফিরতে রাত হয়। বেবী-সিটার তখন চলে যেতে পারে। আর অনুরাধা প্রায়ই রাতে
ফেরে না। ফিরলেও অনেক রাতে যখন শুভময়ের নাক ডাকছে আর তার বুকের উপর
ঘুমিয়ে আছে শিশুকন্যা রেন্। হস্টেলে আরো অনেক বাঙালি আছে,
অনুরাধা সেখানেই আড্ডা দেয়। এইসব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে কথা
তোলার স্টেজ অনেক আগেই পেরিয়ে এসছে শুভময়। অনুরাধার তবে তুচ্ছাতিতুচ্ছ
গন্ডির সীমাবদ্ধতা ভালো লাগে না। সে এবার শুরু করলো ঘুমের বড়ি খাওয়া,
নিজ শরীরে শিরার ভিতর সিরিঞ্জে বাতাস পুশ করা। অবস্থা
চরমে পৌঁছুলে শুভময় সত্যি ভয় পেয়ে গেলো। এরকম মানসিক অবস্থায় চরম কোনো
দুর্ঘটনা অনুরাধা ঘটাতে পারে বলেই শুভময়ের বিশ্বাস। আর্থিক দিক দিয়ে
কষ্ট হলেও শুভময় টিকিট কিনে ওদেরকে তুলে দিলো কোলকাতার প্লেনে। প্লেনে
ওঠার সময়ও অনুরাধা অস্বাভাবিক থাকলো। তার সাথে শিশু। বিমানবালাদেরকে
বিশেষ অনুরোধ করতে হলো শিশুটির দিকে বিশেষ নজর রাখতে।
মাস চারেক থাকলো অনুরাধা বাবামার সাথে। ইতিমধ্যে শুভময়
পার্সোনাল কম্পিউটার কিনেছে। ব্যবহারিক জীবনের কোনো ঘটনাই বুঝি শুভময়কে
কোনো শিক্ষা দিতে পারলো না। অনেক যুক্তিই মেনে নিলো না মন। ইচ্ছে করলো
শুভময়ের, অনুরাধাও কম্পিউটার শিখুক। তখন হয়তো
তাকেও একটা চাকরি জুটিয়ে দেয়া যাবে। কোলকাতায় ফোন করলো শুভময়,
কথা হলো বউয়ের সাথে, শাশুড়ির
সাথেও। অনুরাধার বর্তমান মানসিক স্বাস্থ্যের কথায় শাশুড়ি জানালেন তিনি
সেরকম কোনো সমস্যাই দেখেন নি। অনুরাধাও জিজ্ঞেস করলো সে কি করবে। শুভময়
বললো চলে আসতে, এসে কম্পিউটার শিখতে এবং কাজ
খুজতে। অনেক ঠাট্টাও হলো যা হয় বর-বউয়ের মধ্যে। অনুরাধা ফিরে এলো। ফিরে
এলো রেন্। শুভময় খুব সুখে আছে। এরকম সুখে থাকা দিন সাতেক।
হাসিরাশির দিন ফুরোলো। শুরু হয়ে গেলো আবারও অনুরাধার।
সে শুধু কাঁদে। কি হয়েছে জিগ্যেস করলে তার কোনো উত্তর দেয় না। মাঝে
মধ্যে কাগজে কিসব লেখে ও। একদিন শুভময়ের চোখে পড়লো,
অনুরাধা লিখেছেঃ আমি আর সহ্য করতে পারছি না,
বাবা মা’র নতশির হয়ে থাকা ওই পশুটার সামনে। এরকম কিছু
লেখা। শুভময় জিজ্ঞেস করলো কি ব্যাপার খুলে বলো, কিছু একটা নিশ্চয়ই করা যাবে।
-না যাবে না, তুমি পারবে না
-কেন পারবো না?
-তোমার শারিরীক, আর্থিক,
সামাজিক কোন শক্তিই নেই তার সামনে।
এর বেশি কিছুই বললো না। এর বেশি কিছু আজো জানা হয় নি
শুভময়ের। অনুরাধার মানসিক অবস্থা প্রতিদিন খারাপ হতে থাকলো। গলায় ওড়না
পেঁচিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে, প্রচুর ঘুমের
বড়ি খেয়েছে। সিরিঞ্জে বাতাস পুশ করেছে শিরায়। নিরুপায় হয়ে ইমারজেন্সি
হেল্প চাইলো শুভময়। ডাক্তাররা দীর্ঘ সময় কথা বললেন অনুরাধার সাথে
একাকীত্বে। পরে তারা শুভময়কে জানালেন তার মানসিক অবস্থা বিপজ্জনক।
শুভময়কে সাবধানতা অবলম্বন করতে বলা হলো। তবে কি মানসিক হাসপাতালে ভর্তি
করাতে হবে? কিন্তু অনুরাধা যাবে না কিছুতেই।
শুভময় নিরুপায়। শুধু আশা করে আছে, এরকম তো আগেও
বহুবার হয়েছে, কেটেও গেছে।
দু’তিন
দিন পর। এক বাঙালীর জন্মদিন। ওদের যাওয়ার কথা। অনুরাধা শাওয়ার নিল। খুব
সাজলো। এবং কিছু না বলে বেরিয়ে গেল। এরকম সে আগেও করেছে। শুভময় তার
শিশুকন্যা নিয়ে হস্টেলের সামনে অনেকক্ষণ হাঁটাহাটি করে অনুরাধা আসছে না
দেখে ফিরে এলো চারতলায় ওদের ঘরে। শুভময় টিভি অন্ করেছে, কি যেন একটা ফিল্ম হচ্ছে টিভিতে । হঠাত
কাঁদতে কাঁদতে ওদের দরজায় কড়া নাড়লো একটি ছেলে
– সে জানালো অনুরাধা মারা গেছে।
শুভময়ের মাথা ঘুরে উঠলো। সিঁড়ি দিয়ে নামতেই এক যুবক ইন্টেলিজেন্স
ব্রাঞ্চের কার্ড দেখিয়ে ওদের ঘরের চাবি চাইলো। শিশুটিকে কে যেন শুভময়ের
বুক থেকে নিয়ে গেল। শুভময় প্রায় পাগলের মতো নীচে নেমে এসে দেখলো
অনুরাধার মৃতদেহ পড়ে আছে রাস্তায়। কে একজন বললো,
সাত তলা থেকে লাফ দিয়েছে।
পোস্ট মর্টেম হলো। টিকিট করা হলো। তিনবছরের শিশু কন্যা
বুকে নিয়ে স্ত্রীর কফিনসহ শুভময় কোলকাতায় পৌঁছুলো। শুভময়ের শ্বশুর
শোকের বদলে তার বিভিন্ন ক্ষমতার বিবরণ দিতে থাকলো। শুভময়ের জন্যই
অনুরাধার মৃত্যু হয়েছে সেটাই বারবার প্রকাশ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
একদিন কথায় কথায় শুভময়কে শুনিয়ে তিনি বললেন,
দুনিয়াটা বড় নোংরা হয়ে গেছে। শুভময়ের শিশুকন্যাটিকে ফেরত দেওয়া হলো না।
এই বাচ্চাটিকে বাবার স্নেহ ভালবাসা থেকে বঞ্চিত করেও মানুষ কোন লজ্জা
বোধ করেনা উচ্চারণ করতে, দুনিয়াটা বড় নোংরা হয়ে
গেছে। শুভময় ফিরে এসেছে কর্মস্থলে। তাকে ডেকে ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের
অফিসার কিছু কথা বলেছেন। সে ভীষণ লজ্জার কথা । শুভময় সেসব কথা কোথাও
বলতে চায় না। তার কন্যা সন্তান বড় হচ্ছে। অনুরাধা সাত তলা থেকে লাফ
দেয়ার সময়, রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া দুজন
বাঙ্গালী এবং আরো অনেক পথচারীর সংগে কথা বলে লাফ দিয়েছে দিনের
আলোয়।শুভময়কে খুনের দায়ে বাঁচানোর জন্যই কি অনুরাধার এই সাক্ষী রেখে
যাওয়া?
শুভময় ভাল নেই। সারাক্ষণ মেয়ের কথা ভাবে। বিগত স্ত্রীর
কথা ভাবে। কোন ব্যথাই আর অনুভব করতে পারে না। শুভময় ভাবে। মাকড়সার মতো
এই জাল বুনে যাওয়া, ভাবনা জালে রহস্যের নদী
থেকে কোনো মাছই ধরা পড়ে না। এমনকি কোনো ইঙ্গিতের ছিটেফোটা ডালপালাও উঠে
আসে না শুভময়ের ভাবনা জালে। কেন এই আত্মহত্যা?
কেইবা সেইজন যার অসীম শক্তি, যার সামনে
অনুরাধার বাবামা নতশির থেকেছে? কিইবা ছিল তার
সাথে অনুরাধার সম্পর্ক? সাইকোসিস-ই কি একমাত্র
কারণ? রেন্-কে বাবার বুক থেকে ছিনিয়ে নেয়ার
রহস্যটাই বা কি? প্রাণের বদলে প্রাণ?
শুভময়ের প্রাণটাই যুক্তিযুক্ত হত বেশি। কি অপরাধে রেন্
অপরাধী? খুনই যদি হয়,
তবে খুনের বদলে খুনই হত। হাজার হাজার ঘরের বউ প্রতিবছর ভারতে আত্মহত্যা
করছে বা নিহত হচ্ছে, সেকারণে কোনো কোর্ট একটি
শিশুকে দাদামশাই দিদিমার কাস্টডিতে দেয়ার রায় দিয়েছে শুভময়ের জানা
নেই। শুভময়ের বাবামা এখনো জীবিত। খুনি প্রমানিত হলেও শিশুটির কাস্টডি
তাঁরাই পেতেন। কোর্টের কথায় অনুরাধার বাবামা পাশ কাটিয়েছে। কেন এই পাশ
কাটানো? অনুরাধার বাবামার এই নিজ হাতে আইন তুলে
নেওয়া নিতান্তই সহজ সরল রেখার মতো কখনই মনে হয়নি শুভময়ের। তোমার কাছেই
আমরা আমাদের সক্ষম সন্তান হারিয়েছি, সে কারণেই
তুমিও মেয়ের উপর অধিকার হারাচ্ছ। মেয়েটি তোমার কাছে সেফ্ নয়। তবে ভরণ
পোষণের দায়িত্বটা রাখো। এভাবেই তুমি অনুতাপের সুযোগ পাচ্ছ শুভময়। এই
কথাগুলোই অনুরাধার বাবামা তাকে বারবার জানিয়েছে। অনুরাধার বাবামার এই
সরল অঙ্কটি কতকাল দীর্ঘায়ু পাবে শুভময়ের জানা নেই। শুধু জানা আছে যা
কিছুর শুরু আছে তার নিশ্চয়ই শেষও আছে। এ গল্পেরও শেষ হবে একদিন এই কথা
মনে রেখে হেঁটে যায় শুভময়।
যেখানে চাকরি করতো শুভময় সেই কম্পানীটি বন্ধ হয়ে গেলো
একদিন। ভাঙ্গনের পর প্রাক্তন সোভিয়েত দেশগুলোয় ব্যাঙের ছাতার মতো
পশ্চিমী কম্পানী গজিয়েছে। ঐসব কম্পানীতে চাকরির আশায় রুশভাষী তরুণ
তরুনীদের ভিতর ইংরেজি শেখার হিড়িক পড়েছে। শুভময় এখন ফুল-টাইম টিউটর।
অস্ট্রেলিয়া এবং ক্যানাডায় ইমিগ্রেশনের জন্যও আবেদন করেছে। আবেদনপত্রে
রেন্ অন্তর্ভুক্ত। এক নাছোড় স্বপ্ন তার অন্তর্গত রক্তের ভিতর খেলা করে।
একদিন দুদেশই প্রায় একসাথে আবেদন মঞ্জুর করলো। অন্য আর একদিন অনেক বাক
বিতন্ডা শেষে শুভময় ব্যর্থ হলো অনুরাধার বাবামার একটানা জেদের কাছে।
রেন্ পড়ে রইলো তৃতীয় বিশ্বে। তাকে কিছুতেই আসতে দেয়া হলো না বাবার
কাছে। শুভময়ের মনে এক অদৃশ্য মাকড়সা বুনে চলে ঘন থেকে ঘনতর জাল,
সেই জালের ফুটো দিয়ে বরাবর পালিয়ে যায় রহস্যের
ছানা-পোনা।
ক্যানাডাই বেছে নিলো শুভময়। টাকা পয়সাও খুব একটা নেই,
আছে শুধু একগাদা ডিগ্রী। ফরাসিভাষী প্রদেশ কোবেক এই
দরিদ্রদের জন্য দাতা হাতেমতাই। ফরাসী শিখতে রাজি থাকলে কোবেক সরকার
ইমিগ্র্যান্টদেরকে কিছু টাকা পয়সাও দেয়, তাতে
বেশ ভালই চলে যায়। বছর খানেক এই ফরাসী ভাষা শিখে বেশ কাটিয়ে দিলো
শুভময়।
অল্প সময়েই শুভময় বুঝলো এদেশে শ্রমবাজারে বিরাজমান
বিশাল এক আমলাতন্ত্র। শুধু যোগ্যতায় যোগ্য চাকরি সে কখনই পাবে না।
রাশিয়ার ডিগ্রী নিয়ে নাক সিটকানোই যেন সত্যতা প্রতিপাদক এক কাজ,
অর্ধ শিক্ষিত বা অশিক্ষিত লোকও খুব হেসে ফেলে। মানুষের
এই ক্রমবর্ধমান সেন্স অব হিউমার দেখে শুভময়েরও খুব হাসি পায়। কিছু
হাসিরাশি না থাকলে তার জীবনতো নির্ঘাত বৈচিত্র হারাতো। শুভময় নিশ্চিত
এখানে তার সেরকম কিছু হওয়ার নেই। সেরকম কোনো ভবিষ্যত তার জন্য পড়ে নেই
বিশাল আর ধনী এই দেশটিতে। তারপরও এই নির্ঝঞ্ঝাট প্রথম বিশ্বই তার
ভালোলাগে। ভবিষ্যত না থাকুক এখানকার বর্তমানটা চমত্কার। তাছাড়া শুভময়
মহাত্মা গান্ধীর মতো নির্ভিক এক সৈনিকও নয়। শ্বেতাঙ্গ মোমের আলোয় এই
ধীরস্থির পথ চলা মন্দ লাগে না তার। এই
‘প্রথম-বিশ্বের’ লেখাপড়াটাই একবার খুঁচিয়ে
দেখতে চাইলো শুভময়, তাছাড়া সময়টাও বেশ কেটে
যাবে। রাশিয়া থেকে যারা আসে তারা সাধারণত বছর খানেক ব্যয়ে বড়জোর একটা
মাস্টার্সই করে। তাতেই বেশ চাকরি টাকরি হয়ে যায়। এইসব চাকরিতে বাদামি
বাঙালিরা এক নির্দিষ্ট সীমার উপরে একটুও খুব একটা উঠতে পারে না,
ক্রীতদাসত্বও মেনে নেয়া আছে সেখানে। তা সে যাই হোক
খানিকটা বাড়তি শ্বেতাঙ্গ সান্নিধ্য, ব্যাঙ্ক
থেকে বিস্তর ধার কর্য করে একটা বাড়ি কেনা, একটা
গাড়ি কেনা, আর আছে মাসান্তে একটা পার্টি দিয়ে
যারা এতটা উচ্চতায় উঠতে পারে নি তাদের সামনে পশ্চিমী আনুনাসিক ইংরেজিতে
আহ্লাদে বলে ওঠাঃ ইটস ওনলি ন্যাউ দ্যাট আ’এম এন্জয়িং লাইফ। মোটামুটি এরকমই হয় প্রবাস
জীবন। শুভময় এসবের কিছুই চায় নি। সে দ্বিতীয় বারের মতো পি এইচ ডি তেই
ভর্তি হলো। বিরাট কিছু হওয়ার জন্য নয়, শুধু একটু বাড়তি সময় ধরে ছাত্র থাকার
জন্যই বুঝি। অনেকেই খুব নাঁকি সুরে বললো বটে,
শেষ করতে পারবে না পি এইচ ডি। আর পারলেও চাকরি টাকরি পাবে না। শুভময়কে
নিয়ে আর দশজনের দুশ্চিন্তা বুঝি কখনই যাওয়ার নয়।
মেয়ের কথা এখনো খুব ভাবে শুভময়। ফোনে কথাও হয় মাঝে
মধ্যে। টাকা পয়সাও পাঠাতে হয়। বারবার ছবি চেয়ে মেয়ের একটাও ছবি পায় না
শুভময়। সেই যখন তিন বছর বয়স ছিল তখনইতো শেষ দেখা। সাত বছর হয়ে গেলো
মেয়েকে দেখেনি শুভময়। কে জানে এতদিনে মেয়েটা কেমন দেখতে হলো?
ছবির কথায় অনুরাধার বাবামা পাশ কাটায়,
টাকা পয়সা ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে কথা বলতে রাজিই নয়
তারা। সাফ জানিয়ে দেয়, মেয়ের খোঁজখবর রাখা
শুভময়ের একক দায়িত্ব। এসব শুভময়ের সমস্যা,
তাদের নয়।
শুভময়েরই যখন সমস্যা, তবে তাই
হোক। কোলকাতার টিকিট কিনলো শুভময়। সে কোলকাতায় ফোন করে।
৪ঠা জুন, ২০০৩। কথা হয়
অনুরাধার মায়ের সাথে। পাকা এক ঘন্টা ফোনে কথা হলো। ঠিক কথা নয়,
ঝগড়া-ঝাটিই হলো বলতে হয়। আর যদি কোনো চেষ্টা চলে মেয়ের
সাথে দেখা করার, এবারের সংগ্রাম - অনুরাধার মা
শুভময়কে ধূলিস্মাত করে তবেই ছাড়বে। গোটা ভারতবর্ষ ঝাঁপিয়ে পড়বে শুভময়ের
উপর। যাহ্ তারা! টিকিট ফেরত দিয়ে পুরো টাকাটা ফেরত পাওয়া গেলো না বটে।
কোলকাতা যাওয়া বন্ধ হলো।
পিতৃত্ব কি মাতৃত্বের চেয়েও আসক্তিজনক?
হতে পারে নিশ্চয়ই। জটিলতা থেকে কিছুদিন দূরে থাকার
চেষ্টা, তারপর বারবার ফিরে যাওয়া। সন্তানের
মুখের মতো আর কোনো চুম্বক আছে? যাহোক এই মাঝে
মাঝে ফোনে কথা বলা সন্তানের সাথে, এই বা মন্দ
কি? একদিনের রেন্ নাম বদল করে এখন অহনা,
জন্মের তারিখটাও বদল করা হয়েছে। অহনা ইংলিশ মিডিয়াম
স্কুলে পড়ে। মাসে মাসে ভরণ-পোষণ এবং লেখা পড়ার খরচের বদলে শুভময়ের বড়
ইচ্ছে ছিল স্কুল থেকে সে মেয়ের প্রোগ্রেস রিপোর্ট পাক। সে কথায়
অনুরাধার বাবামা পাশ কাটিয়েছে। শুভময়ের কোনো কথার গুরুত্ব নেই তাদের
কাছে। শুভময়ের পাঠানো টাকা পয়সা ছাড়া আর কোনো বিষয়ে তারা আগ্রহী নয়।
অহনার জীবনে, স্কুলে,
সমাজে আসল পিতৃপরিচয়টিই বা কি শুভময় নিশ্চিত জানে না।
এ কথায়, সে কথায় একদিন অহনা
ফোনে তাকে বললোঃ পাপা, তুমি মায়ের একলক্ষ টাকার
ধারটি শোধ করবে কবে? শুভময়ের মনটা বড় ব্যথিত
হলো। ব্যথিত হলো এ জন্য নয় যে তাকে একলক্ষ টাকা দিতে হবে। ব্যথিত হলো
এই ভেবে যে নিজেরই সন্তানকে দেয়া সামান্য টাকা,
সেই সন্তানের মৃত্যুর পরও যারা ফেরত চাইতে পারে তারা কি মানুষ?
টাকা পয়সার প্রাচুর্য শুভময়ের কোনদিনই ছিল না,
তবু পরিচিত একজন ডাক্তার ভদ্রলোকের মাধ্যমে অবিলম্বে
এক লক্ষ টাকা পাঠিয়ে দিলো। ডাক্তার ভদ্রলোকের সাথে এ কথায় সে কথায়
অনুরাধার বাবার একটি নাতিদীর্ঘ শোডাউনও হয়ে গেলো।
শুভময়ের বাবার ক্যান্সার ধরা পড়লো ২০০৫ সালে। মনটা বড়
খারাপ তার। সারাজীবন অন্যের জন্যই করে গেলো শুভময়,
বাবামাকে কার্যত কিছুই দিতে পারেনি। একটু শান্তি,
তাও নয়। ২২শে জুন, ২০০৫
কোলকাতার প্লেনে উড়াল দিলো সে, বাবা হাসপাতালে
আছেন। চোদ্দ দিন হাসপাতাল ঘরেই বাবার পাশে কাটালো শুভময়। অহনাকে,
তার দাদামশাই দিদিমাকে খবর দেয়া হলো,
শুভময় এখন কোলকাতায়, তার বাবা
হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে লড়ছেন। বাবা এবং মৃত্যুপথযাত্রী ঠাকুর্দার সাথে
শেষ দেখা করার প্রয়োজন বোধ করলো না অহনা। অহনার দাদামশাই এবং দিদিমা
তাকে নিয়ে দূরের কোনো শহরে চলে গেলো, পাছে
শুভময় মেয়েকে নিয়ে টানাটানি করে এই ভয়ে। ৮ ই জুলাই ফেরত প্লেনে শুভময়
কোলকাতা ত্যাগ করে।
২০০৬ সালে শুভময় তার দ্বিতীয় পি এইচ ডি অর্জন করলো
সিভল এঞ্জিনিয়ারিংয়ে, বাবা মারা গেলেন এবং
চাকরি নিয়ে সে আমেরিকা চলে গেলো। বছর চারেক ওখানেই থাকা,
তারপর ফিরে আসে টরন্টো। অহনার সাথে ই-মেইলে যোগাযোগ
হয়। ফেসবুকেও নিয়মিত কথাবার্তা হয়। বাবার প্রতি অভিযোগ অনুযোগ আর টাকা
পয়সা চাওয়া ছাড়া অহনার সেরকম আর কিছু বলার নেই। আর দশজন ছেলে মেয়ের
মতো ফেসবুকে অহনার কোনো ছবি নেই। বড় দেখতে ইচ্ছে করে সন্তানের মুখ।
অনেক অনুনয় বিনয় শেষে যে দু’চারটে
ছবি অহনা পোস্ট করলো তা তার শিশু বেলার।
একদিন শনিবার এলো, একদিন
শনিবার গেলো। কে যেন বলেছিলো শনিবারের রং সবুজ। শনিবার শেষে রবিবার
এলো। নিঃসঙ্গ বাসভূমে শুভময়ের এই এক আন্তর্জালে সুতোর পথ ধরে হেঁটে
ফেরা, নির্বাসনের মতো আপনার মনে নিতান্ত একাকী।
ফেসবুকের পাতাগুলো হাওয়ায় ওড়ে, কাপাস তুলোর মতো
উড়ে যায়, উড়ে আসে। কে যেন ভুল করে অহনার
বর্তমান ছবি অহনাকে ট্যাগ করেছে। প্রাণ ভরে শুভময় দেখে অহনার ছবি,
এ যেন বিশ্বরূপ। মুখের উর্ধাংশ ঠিক মায়ের মতো,
অনুরাধার চোখ, কপাল,
ভ্রু, দৃষ্টি,
ঠিক যেন ফটোকপি। নাক ঠোঁট হাসি আর থুতনি অতীনের।
আজ রবিবার। শনিবারের রং সবুজ,
রবিবারের রং কিগো? রংধনু.....রংধনু।
২
রংধনু কোনো আনন্দের প্রতীক নয় শুভময়ের কাছে। দুনিয়ায়
সব সুখী মানুষই সাদামাটা একরঙ্গা। সম্ভাব্য সাতটি রঙের সহবাস শুধু
অসুখেই, সম্ভাব্য সব ক’টি দৃশ্যমান
তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোক বর্ণালী শুধু বিষাদেরই বিষ। রবিই ভূমন্ডলের
একমাত্র আলোর উত্স
– রবিবারের রং তাই রংধনু,
প্রতিবারে তাই রবিবার এসে গেলে মনে বড় ব্যথা পায়
শুভময়।
অহনার সাথে সর্বমোট ৫৪ বার ই-মেইল আদান-প্রদান হয়েছে।
ডিসেম্বর ২০, ২০০৯,
রবিবার - প্রথম চিঠি। প্রেরকঃ অহনা
– প্রাপকঃ শুভময়। জানুয়ারি ৩০,
২০১১, রবিবার
– শেষ চিঠি। প্রেরকঃ শুভময়
– প্রাপকঃ অহনা। রবিবার থেকে
রক্ষে নেই যেন।
শেষ চিঠিখানা শুভময়ের লেখা। চিঠি ঠিক নয়,
নিরুত্তাপ একটিমাত্র শব্দে চিঠির প্রাপ্তি স্বীকার।
তবে অহনা কিন্তু তার শেষ চিঠিখানায় দারুণ নাটকীয়তা দিতে পেরেছিলো।
অহনার শেষ চিঠিঃ বেশ, বাস্তবিক
দ্রুতই হলো, খোলাখুলিও বটে। তুমি যদি আমাকে
সাহায্য করতে না চাও, তাহলে পুরোপুরিই আমার
জীবন থেকে বের হয়ে যেতে পারো। ভেবোনা আমাদের সম্পর্কটি স্থাপিত ছিল যে
ভিত্তির উপর তা অর্থ। তা নয়। তবে সব ক’টি দিক থেকেই বাবা হিসেবে তুমি ব্যর্থ। তুমি
নিঃস্ব ছাড়া আর কিছু নও যার সম্ভবত অনেক অর্থ আছে, যশ আছে,
বন্ধু আছে ... তবে কন্যা নেই। এটা নিতান্তই একটা
পরীক্ষা ছিল যে পরীক্ষায় তুমি ঠিক এই মুহূর্তে অকৃতকার্য হয়েছ। তুমি
ব্যর্থ হয়েছ বাবা হিসেবে। আমি মরে যাবো না তোমার অর্থ ছাড়া। আমার অনেক
মানুষ আছে এখানে যাদের সঙ্গে আমার রক্তের সম্বন্ধ নেই,
তবু তারাই আমার কাছে
‘বাবা’।
তুমি খুব ভালো করেই জানো আমি আইনত আমার অধিকারের দাবি করতে পারি। ডঃ
শুভময়,
আশা করি তুমি ভুলে যাওনি আমি আইনের ছাত্রী। তবে তুমি ইতিমধ্যেই এক
নিঃস্ব, দুস্থ,যে
বস্তুত নিজের অহমিকা পরাভূত করতে অক্ষম। আমি তোমার দীর্ঘায়ু কামনা করি,
এতটাই দীর্ঘ যেন তুমি দেখে যেতে পারো অহনা তোমার চেয়ে
অনেক অনেক ভালো এক অবস্থানে অবস্থিত। তুমি কখনই হতে পার নাই একজন পুত্র,
একজন পতি, একজন ভ্রাতা,
অথবা বস্তুত কোনো কিছুই ... কারণ তুমি একজন পুরুষ যার
অহমিকা ছাড়া আর কিচ্ছুটি নেই।
চিঠিটিতে কোনো সম্বোধন নেই,
মুখবন্ধ নেই, সমাপ্তিকরণ নেই,
সত্ত্বপ্রদান নেই। এই অনুপস্থিতিগুলোও অর্থহীন হয় নি,
এই অনুপস্থিতিগুলোও বেশ এক ধরনের নাটকীয় প্রতিমূর্তি
তৈরী করতে পেরেছে বৈকি। কাঠামোগত দিকটা বাদ দিলেও অহনার চিঠিতে
ইংরেজিটা নির্ভুল নয়, ভারতবর্ষে শিক্ষার এই
অধঃপতনে শুভময়ের মনে বড় ব্যথা পায়। একটা সময় ছিল,
বাঙালিরা মাতৃভাষার মর্যাদা বুঝতো,
দ্বিতীয় কোনো ভাষা শিখতে হলে তাও খুব ভালো করে শিখতো।
এই সময় আর সেই সময় নয়। লেখা পড়া শেখাটাই আজকাল এক নির্বুদ্ধিতা হিসেবে
গণ্য হচ্ছে। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোতে
বাঙালি সাহেবরাই, যাদের মাতৃভাষা ইংরেজি নয়,
আজকাল দুর্দান্ত ইংরেজি শেখাচ্ছে। পরিণামে ছেলেমেয়েরা
যা শিখছে তা ভয়ঙ্কর। যাহোক, অহনা কিন্তু দারুণ
লিখেছে - য়্যু ক্যান্ গেট আউট অব মাই লাইফ ....শুভময় কি আদৌ অহনার
জীবনের কোথাও সেরকম ভাবে আছে যে সেই স্থান পরিত্যাগের দুঃখে তার হৃদয়
দ্বিখন্ডিত হবে? অহনার কথাগুলো সত্যি হলেই
শুভময় খুশি হত বেশি, সম্পর্কটা অর্থ-প্রধান না
হলেই ভালো হত। ভালো হত অহনার জন্যই। শুভময়ের অর্থ,
যশ, বন্ধু,
কন্যা, কিচ্ছুটি নেই
– তা ঠিক।
‘হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহান /তুমি
মোরে দানিয়াছ খ্রীষ্টের সম্মান।’
ব্যর্থ বাবা খেতাবটিও মন্দ নয়,
বিশেষণটি যাই হোক, ঐ বিশেষ্যটি শুভময়ের একদিন
বড় কাঙ্খিত ছিলো।
রক্তের সম্বন্ধ কথাটারও কোনো মানে হয় না,
পৃথিবীজোড়া সব মানুষই হয়তবা একদিনের সেই এক রক্তের
বন্ধনে পরস্পর আবদ্ধ। আবার কারো সাথেই হয়তো কারো আদৌ কোনো বন্ধন নেই।
মানুষ মানেই রক্ত মাংস শরীর শুধু নয়, মানুষ
মানে আত্মাও। সেই আত্মার সৃষ্টি, আদি,
উত্স, বিভাজন মানুষ বড় জানে
না। অহনার সাথে রক্তের বন্ধন শুভময়ও দাবি করে না,
বন্ধনের উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি কোনটা আবিষ্কারের
প্রতি তার নিজের সেরকম কোনো আগ্রহও নেই। তবে কৌতুহলী জনের জন্য বিশেষ
দ্রষ্টব্য এই যে প্রাগ্রসর বিজ্ঞানের সুবাদে কমপ্লিট ডি এন্ এ
প্যাটারনিটি টেস্ট এখন সহজলভ্য, সাধারণ কৌতুহল
অথবা আইন সংক্রান্ত জটিলতা নিবারণের বাজার দর এখন $৭৯
মার্কিন ডলার। আধুনিক আইন আজ আর শুধুই কথা-বলা-কলা-কৌশল নির্ভর নয়,
বিজ্ঞান-প্রযুক্তিই এখন এক অপরিহার্য বিচারক হয়ে
উঠেছে।
অহনা ভালো একজন আইনজীবী হয়ে উঠতে পারলে শুভময়ই একদিন
খুব খুশি হবে। অতটা আশা করার সাহস যদিও শুভময় করে না,
কারণ অহনার মেধা নেই। অন্তত শুভময় তাই মনে করে। অপরাধী
বাবাকে শাস্তি দেবার জন্য আইনজীবী হওয়া বেশ নাটকীয় দেখালেও বাস্তবানুগ
নয় মোটেও। বরং একজন দক্ষ আইনজীবী ভাড়া করার কথাটা মাথায় আসলেই অহনাকে
বুদ্ধিমতি বলা যেত।
যুদ্ধ বাধলেই বুদ্ধি দিতে আসা মানুষের অভাব পৃথিবীতে
নেই, সে কারণেই অহনার পিতৃসম মানুষের অভাব নেই।
এই সব বাবারা যদিও প্রয়োজনে বিন্দুমাত্র কাজেও আসে না। কাজে আসলে
পৃথিবীটা আরো একটু বেশি বাসযোগ্য হত। কাজে আসলে অহনার জীবনটা আজ নড়বড়ে
বাশের সাঁকোর মতো না হয়ে শক্ত রেললাইনের ব্রীজের মতো দেখাতো।
অহনার এই নাটকীয় ভাবে শুভময়ের দীর্ঘায়ু কামনা করাটা
বেশ উপভোগ্য। আজ খুব মনে পড়ে অনুরাধার শবদেহ সামনে রেখেই অহনার
দাদামশাই একটানা বিলাপ করেছিল, অনুরাধার
মৃত্যুতে শুভময়েরও কেন মৃত্যু হলো না, বারবার
এই বলে। জুলিয়েটের শবদেহ দেখে রোমিও কি নিজ হাতে তুলে নেয়নি বিষ?
বাহ্, মানুষের চাওয়ার কোনো শেষ
নেই বুঝি। অহনার সেই দাদামশাই আজ নব্বই পেরিয়েছে,
সন্তানকে সে নিজের জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসতো।
পৃথিবীর মায়া মমতা ছেড়ে তবু জীবনের সাঁকোখানি পেরিয়ে ওপারে যাবার কোনো
লক্ষণই তার ভেতর আজো কেউ দেখেনি। আর দিদিমাও আছে বেশ ঠিকঠাক,
আজো ঠিক আগের মতই টেনে টেনে সুর করে দারুণ বাংলা বলতে
পারে। কথিত আছে, একদিন তার সেই সুরে কেঁপে উঠে
যৌবন ফিরে পেতে দেখা গেছে কত বুড়ো মন্ত্রী-মিনিস্টার আর বুদ্ধিজীবীর
হৃদয়। যা রটে তার কিছুটা বটে। অহনার দিদিমার চরিত্রহীনতার রটনা একদিন
সত্যই ছিল, সেই সময়ের যে দু’একজন যারা এখনো বেঁচে আছেন,
খুকখুক হাসি সামলে তারা সেরকম সাক্ষ্যই দেন।
একদিন অহনা খুব বড় অবস্থানে পৌঁছুতে পারুক এই
আশীর্বাদই করে শুভময়, অহনার সাথে তার কোনো
প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই,শুভময়ের অবস্থান এমন কোনো
গগনচুম্বী নয় যে সেই অবস্থান পেরুনো এক দুরাশার মতো শোনাবে। শতায়ু আর
ধনে পুত্রে লক্ষীলাভ হোক, আন্তরিক এই আশীর্বাদই
করে শুভময়।
পিতা নয়, পতি নয়,
পুত্র নয়, ভ্রাতা নয়,
কোনো কিচ্ছুই আর শুভময়ের হবার নয় এ পৃথিবীতে অহনার এই
প্রজ্ঞাপন বেশ নাটকীয় তবে অবাস্তব। শুভময়ের বাবা মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত
পর্যন্ত পুত্রগর্বে গর্বিত ছিলেন, মা এখনো
বেঁচে আছেন, সমাজে দু দশজনকে আজো তাঁর পা ছুঁয়ে
প্রণাম করে বলতে দেখা যায়
‘রত্নগর্ভা মা, আমাকে আশীর্বাদ করো।’ দাদা বা ভাই হিসেবে শুভময়ই
ভাইবোনদের কাছে আজো প্রিয়তম। শুভময়ের পিতৃস্নেহবলেই এমনকি অহনার জীবনের
প্রথম তিন বছর নিষ্কন্টক ছিল। শুভময়ের পিতৃস্নেহবলেই অহনার আজকের জীবন
জটিলতর হয়ে ওঠেনি। শুভময় মুখ খুললে হতো, মুখ সে
খোলেনি। অহমিকা নয়, সত্যবাদিতা। এই সত্যবাদিতার
কারণেই শুভময়ের নিজের জীবন কন্টকাকীর্ণ, এই
সত্যবাদিতার কারণেই তার জীবন পুষ্পের পেলবতা পেলো না।
অহনার এই শেষ চিঠির আগের চিঠিখানা ছিল শুভময়ের,
সেটাও সংক্ষিপ্ত একটিমাত্র শব্দে রচিত।
‘না।’
শুভময় এমন নিস্প্রাণ চিঠিই বা লিখতে গেলো কিসের উত্তরে?
অহনার চিঠিঃ পাপা, নমস্কার।
কেমন আছো? তুমি জানো,
আমি সত্যিই ব্যস্ত আমার পরীক্ষা নিয়ে। না, দয়া
করে অবাক হয়োনা। আমি তোমার কন্যা এবং আমি তোমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করবো
না যতক্ষণ না তুমি আমার কাছে মোটামুটি সহনীয় থাকছো। মূল বিষয়ে ফিরে
আসছি। আমি নির্দিষ্ট করে তোমার পূর্ববর্তী চিঠির উত্তর দিচ্ছি তা নয়,
কারণ সেইসব বিষয়বস্তু ব্যাখ্যা করার জন্য আমাক আরো
ভেবে বের করতে হবে সম্ভবত অতিপ্রাকৃত শব্দাবলী,
খোলামেলাভাবে বলতে গেলে সেইসব বিষয়বস্তু মনে হয় না তুমি আদৌ বুঝতে
পারো। ঠিক আছে, খুলে মেলেই বলছি,
আমি চাই এখন থেকে তুমি আমাকে নিয়মিত মাসিক ভাতা দাও।
এটা কি সম্ভব হবে? দয়া করে জরুরি ভিত্তিতে
আমাকে জানাও। এখন চলি। অহনা।
জরুরি ভিত্তিতেই অহনাকে প্রশ্নটির উত্তর জানিয়েছিলো
শুভময়। তাত্ক্ষণিক, নিশ্চিত,
সহজ, সরল,
সংক্ষিপ্ত ছিল সেই উত্তর। অহনার এই চিঠির পর শুভময়
মাত্র দুবার উত্তর পাঠিয়েছে, দুবারই সংক্ষিপ্ত
উত্তর। তারপর অহনা আর যোগাযোগ রাখেনি। তাহলে সামান্য এই এক
‘না’
শব্দটিই কি অহনার কাছে সহনাতীত হয়ে উঠলো?
শেষ চিঠিতে অহনা লিখেছিলো বটে
‘ভেবোনা
আমাদের সম্পর্কটি স্থাপিত ছিল যে ভিত্তির উপর তা অর্থ।’ অহনা ঠিক লেখেনি। অর্থের
প্রশ্নে নিষ্পাপ এই
‘না’ শব্দটিই জগতের অধিকাংশ
সম্পর্ককে ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়। এটাই সত্য,
এটাই বাস্তব। পিতা-মাতা-সন্তান, ভাই-বোন,
পতি-পত্নী -জগতের কোনো সম্পর্কই এই টাকা-পয়সার চৌম্বক
ক্ষেত্রের বাইরে নয়। জগতে এই টাকা-পয়সা উপার্জন করা একই সাথে খুব কঠিন
এবং খুব সহজ। টাকা-পয়সার এক ধরনের হৃদয় আছে, যা
স্পর্শ করতে পারা এক শিল্পবিশেষ। কেউ কেউ জানে,
কেউ কেউ জানে না সেই শিল্প, সেই কলা। অহনা
জানলে শুভময়ের বড় ভালো লাগতো।
ডিসেম্বর ২৩, ২০১০,
অহনাকে পাঠানো শুভময়ের উত্তর। শুভময় অহনার লেখা
চিঠিটিকে পুনর্বিন্যাস করেছে - অক্ষরগুলো লালরঙ্গা,
ছোট বড় বারো ভাগে বিভক্ত হয়েছে অহনার চিঠি,
প্রতিটি খন্ড অংশের নীচে নীল অক্ষরে টাইপ করা শুভময়ের
উত্তর।
-হাই পাপা,
-হাই মাই ডটার!
-ধন্যবাদ তোমার অবিলম্বে উত্তর দেবার জন্য। আমার প্রথম
প্রশ্ন আমাকে বিদ্রোহী নামে ডেকেছ কেন। আবারও তুমি মানুষকে অভিযুক্ত
করা চালিয়ে যাচ্ছো।ঠিক আছে, আমার এ ব্যাপারে
কিছুই করার নেই।
-বিদ্রোহী নামে ডেকেছি এক পিতৃস্নেহ মাখা নিতান্তই
ঠাট্টার ছলে, কোনো কিছুতে অভিযুক্ত করার
উদ্দেশ্যে নয়।
-প্রথমেই আমি কিছু বিষয় তোমার কাছে পরিষ্কারভাবে
জানিয়ে দিতে চাই। আমার কাছেও ভালোবাসা বিক্রয়যোগ্য নয়। আর আমি ধারণা
করি ম্যাটেরিয়াল বিষয়-আশয় দিয়ে ভালোবাসা অর্জন করা যায় না। আমি তোমার
ব্যাপারে জানি না, তবে এটাই আমি ঠিক যেভাবে
ভালোবাসাকে দেখি। আমি যদি তোমার কাছে কিছু চেয়ে থাকি,
তবে তা তুমিই করতে বলেছো বলে করেছি।
-তুমি খুব ভালো মেয়ে।
- পরিবার বলতে আমি বুঝিয়েছি সেইসব মানুষকে আমার সাথে
যাদের রক্তের সম্বন্ধ আছে, বাবা হিসেবে তুমি
অন্তর্ভুক্ত। আমি আমার পিতার দিক দিয়ে সম্পর্কযুক্ত আত্মীয়দের নিয়ে কথা
বলতে চাই না, কারণ তারা কখনই আমার খোঁজখবর
নেবার প্রয়োজনটি বোধ করেনি। অতএব দয়া করে আমার কথাগুলোর
অন্যথা-ব্যাখ্যা দিও না।
-সব মানুষই মূলত মানব প্রজাতির এক বিশাল পরিবার। আদৌ
রক্ত নয়, পরস্পর সম্পর্কিত হওয়ার জন্য বরং অন্য
কিছু জরুরি।সব সত্ত্বেও বাবা হিসেবে আমাকে বিবেচনা করার জন্য ধন্যবাদ,
আমি সম্মানিত বোধ করছি, ...আর
খুউব সুখী। তোমার পিতার দিক দিয়ে সম্পর্কযুক্ত আত্মীয়রা কখনই তোমার
খোঁজখবর নেয়ার প্রয়োজন বোধ করে নি ... শাবাশ! তুমি সঠিক পথটিতেই আছো।
আমি বুঝতে পারছি তোমার কথাগুলো, সম্পূর্ণভাবে,
পরিপূর্ণভাবে, সম্ভাব্য সব
অর্থ বিবেচনা করে। চালিয়ে যাও।
-তোমার মতানুযায়ী, তো কাস্টডি
টাই সর্বশেষ কথা!! আমার যদি ভুল না হয়, আমার
মা'র মৃত্যুর পরে তো তুমি আমাকে আভিভাবক স্বরূপ
এই দাদু-দিদিমার হাতেই তুলে দিয়েছিলে। আমি কন্যা সন্তান। আমার মায়ের
প্রয়োজনীয়তা ছিল। আমার দিদিমা সেই শুন্যস্থান পূরণ করেছেন। যাই হোক,
তাতে তোমার পিতৃত্বের অধিকার তো আর বিলুপ্ত হয়নি। নাকি
আমাকে হস্তান্তর করার সময়েই তুমি তোমার পিতৃত্ব বিসর্জন দিয়েছিলে। আমি
আবারো বলছি, তোমার স্নেহ,
ভালবাসার প্রতি সংশয় প্রকাশ করছিনা,
কিন্তু তোমার আমার দায়িত্ব নেবার ক্ষমতা কে প্রশ্ন
জানাই। আর্থিক দিক দিয়ে আমি আমার ভবিষ্যতকে বিপদমুক্ত রাখতে সক্ষম।
বর্তমানে, আমি আমার দেশের এক অতি সুপ্রতিষ্ঠিত
ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ে পড়ছি। অর্থের ভিক্ষা আমি চাইছি না । কোনোদিন
চাইও নি। সমাজের নিরিখে, আমি আমার নিজস্ব
দক্ষতায় ভাল মতই স্বাবলম্বী ও সম্মানিয়া।
-হ্যা, নিশ্চয় কাস্টডিই
একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমি আদৌ একমত নই তুমি যা বলছো তার সাথে।
আমি তর্কও করতে চাই না। কারণ আমি তোমার সাথে কোনো সংঘর্ষমূলক
বিরুদ্ধতায় যেতে চাই না। তবে আমি এক প্রাচীনকালীন গল্প বলতে চাই,
সেই গল্পের নাম ছিলো অন্ধকারে হাতি দেখা। এই গল্পে
হিন্দুস্থান থেকে আসা একদল লোক অন্ধকার ঘরে হাতি প্রদর্শনের ব্যবস্থা
করে। কিছু সংখ্যক মানুষ অন্ধকারে হাতি স্পর্শ করে হাতি দেখতে কেমন
বোঝার চেষ্টা করেছিলো, ঠিক কোথায় স্পর্শ
করেছিলো তার উপর নির্ভর করে তাদের মধ্যে কেউ মনে করলো হাতি এক প্রকার
জল নির্গমনের নল বিশেষ (শুঁড়), আবার কেউ কেউ
মনে করলো হাতি দেখতে পাখা (কান), থাম (পা)এবং
সিংহাসনের (পিঠ) মতো। এটা পৃথক পৃথকভাবে প্রত্যক্ষকরণের সীমাবদ্ধতার
একটি উদাহরণ। আবারো বলছি, কেউই কারো বা কিছুর
জন্য দায়ী নয়। আমি খুউব সম্মানিত বোধ করছি নিজের অক্ষমতার জ্ঞান আমার
কন্যার কাছেই অর্জন করতে পেরে। ধন্যবাদ! আর দয়া করে আমাদের এই
চিঠিপত্রের আদানপ্রদান সংরক্ষণ করে রেখো ভবিষ্যতে পড়ার জন্য,
ধরা যাক, এখন থেকে কুড়ি বছর পর
যদি তোমার হঠাত অশ্রুপাত করার প্রয়োজন পড়ে। অন্যতম সর্বোত্তম ইংরেজি
মাধ্যম বিদ্যালয়ে পড়বার অভিজ্ঞতা নিশ্চয় আকর্ষনীয়,
তাই নয় কি? আমি বড় হয়েছি
প্রত্যন্ত একগ্রামে, প্রকৃতই জানিনা
ইংরেজি-মাধ্যম বিদ্যালয়ে ড়ার অনুভূতিটা কেমন। তবে আমার কাছে খুউব বড়
শোনাচ্ছে।আমি তোমার সুস্থিত আর্থিক অবস্থা এবং সামাজিক মর্যাদার জন্য
প্রকৃতই সুখী। তোমার জন্যই ভালো, তাই নয় কি?
-না, আমি নিশ্চয় আমার বিয়ের
ব্যাপারে তোমাকে জানাবো। নিমন্ত্রণ পত্রের দরকার হবে না বোধ করি। এখানে
তোমার কন্যার কথা হচ্ছে। তবে তুমি যদি অন্ধ হয়ে যাও ততদিনে?
তুমিতো আমাকে তাহলে দেখতে পাবে না। আমার হাসব্যান্ডের
‘সত্য’
জানাই ভালো। তোমার প্রথম option টাই সমগ্রভাবে
সত্যের কাছাকাছি।
- খুউবই সম্ভব আমি অন্ধ হয়ে যেতে পারি ততদিনে। এগিয়ে
যাও Honey, যে option
টাই তোমার পরিস্থিতির জন্য বেশি স্যুট করে তা নিয়ে। আমি প্রভূত মূল্যের
সাথেই গ্রহণ করেছি তোমার মতামত - তুমি প্রকৃত আমার সম্পর্কে কি ভাবো তা
বুঝতে সাহায্য করার জন্য ধন্যবাদ।
-বিগত ১৪ বৎসর , আমার কোন
কম্পিউটার এর প্রয়োজন হয়নি। শুধুমাত্র তোমার কথা অনুযায়ী,
তোমার সাথে যোগাযোগের কারণেই আমার কম্পিউটার এর
প্রয়োজনয়ীতা। তোমার ভাই, যাও বা কম্পিউটার
আমাকে দিয়েছিল, সবচেয়ে ভাল কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ
কে দেখিয়েও আমাকে ওটা আবর্জনায় ফেলতে হয়েছে,
বিক্রি টুকুও করা যায়নি। এখন যেহেতু আমি তোমার সাথে যোগযোগ রাখছি এবং
বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আবেদন করছি, আমার
এটি প্রয়োজন। দাদু-দিদিমা আমার কোন কিছু তেই আপত্তি প্রকাশ করেন না।
তাদের তো আমার রক্ষণাবেক্ষণ বৈ আর কিছুই করার ছিলনা,
যা কিনা তারা যথেষ্ট পরিমাণেই করেছেন। এটা তো তোমার
কর্তব্য ছিল।
- বিগত ১৪ বছর , তোমার কোন
কম্পিউটার এর প্রয়োজন হয়নি? হ্যা,
তাইতো, তুমি যথার্থ তাই বলছ।
আমি তাহলে ক্ষমা মার্জনা করছি আমার সাথে যোগাযোগ রাখতে বলায়,
আমার দাদাকেও ক্ষমা করো, যে
তোমাকে এক আবর্জনা কিনে দিয়েছিলো যা থেকে মুক্তি পেতে তোমাকে বেগ পেতে
হয়েছে। আমি কারো জন্য, বা কোনো কিছুর জন্যই
দায়ী নই।
-আমি কখনো ভাবিও নি যে আমাকে এই ভাবে বলতে হতে পারে।
আমার সক্ষম মা কিন্ত তাদের জিম্মায় থাকা কালীন মারা যাননি। আমি তাকে
হারিয়েছি, যখন সে তোমার কাছে ছিল। যেহেতু,
তুমি ভাবছ, আমি এক কঠিন জীবন
অতিবাহিত করছি, তার কারণ শুধু এটাই,
আমার মা নেই। অবশ্যই, আমার
দাদু-দিদিমার কাছে এর উত্তর নেই। তুমিই আমায় বলো,
যদি তুমি সত্যই এত কর্তব্যপরায়ন,
এতই বিচক্ষণ, কি করে আমার মা
কে মৃত্যুর পথে যেতে হল? সুতরাং,
যদি আমি আজ এতই দুর্দশার স্বীকার,তোমারই
কি নয়, সেই দায়? তোমার
কি কোন উত্তর আছে? তাহলে,
কিভাবে আমি আমার সুরক্ষা বলয় দেখব বল,
ওখানে? আমার পক্ষে এটা বিবেচনা
করা সম্ভব ছিলনা, কারণ আমি ছোট ছিলাম। আমি
বিবেচনার কথা নয়, তথ্য বা বাস্তব ঘটনার কথা
বললাম। আমি এভাবে তোমাকে প্রশ্ন করতে চাইনি,
কিন্তু তোমারি কথা আমাকে এরূপ তর্কে অবতীর্ণ করেছে ।
-‘কাস্টডি’
প্রাসঙ্গিক শুধুমাত্র ১৮ বছর বা তার কম বয়সের
সন্তানাদির জন্য। স্বচ্ছন্দেই তুমি তোমার হৃদয় খুলে মেলে বলো,
হানি। তোমার যা খুশি তাই বলতে পারো। আমার এখন আর তাতে
কিচ্ছু যায় আসে না। আমি আগেও বেশ শুনেছি এই একই নিন্দা তোমার পরিবারের
অন্য সদস্যদের মুখ থেকে প্রবাহিত হতে। ছেলেমানুষী। তবে তোমাকে ধন্যবাদ,
এ ব্যাপারে তোমার নিজস্ব উপলব্ধি আমাকে জানানোর জন্য।
আর একটা সাধারণ উপদেশ দিচ্ছিঃ দয়া করে অন্ধকারে হাতি দেখা গল্পটির কথা
মনে রেখো যখনই তোমাকে তথ্য বা প্রকৃত ঘটনা সম্পর্কে কিছু বলতে হয়।
তোমার দাদু-দিদিমার কাছে জিজ্ঞাসা করতে থাকো ...
তাদের কাছেই সব উত্তর আছে ... আমি নিশ্চিত ... তারা
তোমাকে বলছে না তোমার নিরাপত্তার কথা ভেবেই ... নিশ্চয় গুরুতর কোনো
কারণ আছে যে জন্য তারা তোমাকে সত্য বলছে না ... আমি নিশ্চিত তারা
তোমাকে ভালোবাসে ... আমি নিশ্চিত তারাও মনে করে
‘সত্য’
তোমার জন্য কল্যাণকর নয়।
- আমি ফেস্ বুক এ আমার কিছু ছবি আপলোড করে দেবো। তুমি
ওখানে আমাকে দেখতে পাবে।
-তোমার অশেষ কৃপা!!!
-আমি তোমার কাছে জিনিসপত্র চাই,
কারণ আমি চাই তুমি আমার জন্য অন্তত কিছু করো,
ভালোবাসা ব্যতিরেকে নিশ্চয়। তুমি যদি আমাকে ভালোবেসে
থাকো, আমিও তোমাকে ঘৃণা করি নি।
-কে জানে, হয়তো আমি কিছুই করি
নি তোমার জন্য। এটাই তবে
‘সত্যি’ হোক।
-দেখতেই পাচ্ছো পিতা-মাতা-সন্তানের ভালোবাসা
বিশ্বজনীন।
-সাধারনভাবে বলতে গেলে
‘হ্যা’।
তবে আমরা এক ব্যতিক্রম। তুমি কি করে আমার মতো একজন ঘৃণ্য মানুষকে
ভালোবাসতে পারো?
-বাই! উত্তরের প্রতীক্ষায় থাকবো।
-বাই! তোমার উত্তর পেলে সুখকর বিস্ময়ে আমি নিশ্চয়
অভিভূত না হয়ে থাকতে পারবো না।
আগের দুখানা চিঠির তুলনায় এই চিঠিতে বাবা-মেয়ের মধ্যে
বেশ বাক্য বিনিময় হয়েছে। অহনার কথাগুলো পরস্পর বিরোধী,
নির্দিষ্টভাবে ঠিক এই পরস্পর বিরোধী কথাগুলো শুভময়ের
কাছে অতটা গুরুত্বপূর্ণ না হলেও, সাধারণভাবে
অহনার
‘প্রকৃতি’
শুভময়কে ভাবিয়ে তুলেছে। এ বয়সেই যদি শক্ত-সমর্থ প্রকৃতিটি গঠন করে নিতে
ব্যর্থ হয়, তবে কবেই বা আর অহনা পারবে?
এই প্রকৃতিই মানুষের ভাগ্য বহুলাংশে নির্ধারণ করে
থাকে। বক্তব্যে পরস্পর বিরোধিতা ভাবনার অস্থিরতা থেকেই আসে সম্ভবত।
প্রযুক্তির এই যুগে অহনার একটা কম্প্যুটার না থাকাটা অপরাধসম,
শুভময় তা জানিয়েছে বটে অহনাকে,
তবে তা কিনে দেবার প্রতিশ্রুতি সে কখনই দেয়নি। একপা বাড়িয়ে এই একটু
অতিরিক্ত বুঝতে যাওয়া শুভময় মনে করে অহনার চরিত্রের বড় এক দুর্বল দিক।
একটু বেশি এবং একটু কম বুঝতে পারা-ই সম্ভবত জীবনে সব ব্যর্থতার প্রধান
কারণ। চারিত্রিক গুণাবলীর ভেতর শুভময়ের বড় আশা ছিল কৃতজ্ঞতাবোধটুকু
অন্তত অহনার থাকুক। যে কম্প্যুটারটি প্রথম অহনাকে কিনে দেওয়া হয়েছিল তা
সেই সময়ে কোলকাতার বাজারে যা পাওয়া গেছে তাই,
দামও ছিল তখন চড়া। অহনার দাদু-দিদিমা অবশ্য বায়না ধরেছিলো টাকাগুলো নগদ
দিতে। শুভময় রাজি হয়নি, সে তার দাদাকে দিয়ে
কিনিয়ে দিয়েছিলো কম্প্যুটারটি। ই-মেইলে বাবার সাথে মেয়ের যোগাযোগ রক্ষা
অন্যতম উদ্দেশ্য হলেও, শুভময়ের প্রধান
উদ্দেশ্যটি ছিল সমসাময়িক প্রযুক্তির সাথে মেয়ের একটি যোগসূত্র শিশুকাল
থেকেই তৈরী করে দেয়া। নিজ জীবনে পাওয়া প্রথম কাগজের খাতাটি নিজ হাতে
বানিয়ে দেবার জন্য শুভময় আজো তার লোকান্তরিত ঠাকুরদাকে কৃতজ্ঞতা জানায়,
অহনা ঠিক উল্টোটি করাই শিখেছে। কৃতজ্ঞতার বদলে এই
তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করাটা অনুরাধার পরিবারে শুভময় আগেও দেখেছে।
কৃতজ্ঞতাবোধ বিবর্জিত মানুষকে শুভময় মনে করে মানব সৃষ্টির এক বর্জ্য
পদার্থ, যথার্থ মানুষ নয়। ব্যক্তিগতভাবে
শুভময়ের প্রতি অহনার কৃতজ্ঞতাবোধ থাকুক বা না থাকুক,
তাতে শুভময়ের সেরকম কিছু যায় আসে না,
তবে সাধারণভাবে অহনার চরিত্রের এই দিকটি এক বিশেষ
দুশ্চিন্তার কারণ।
বিশেষ এক প্যাটার্ন চোখে পড়ে,
এক নির্দিষ্ট পন্থায় যেন সব ঘটনা পরিবর্ধিত এবং বিন্যস্ত। ঐ যে অহনা
লিখেছে,
‘পরিবার বলতে আমি বুঝিয়েছি সেইসব মানুষকে আমার
সাথে যাদের রক্তের সম্বন্ধ আছে, বাবা হিসেবে তুমি
অন্তর্ভুক্ত। আমি আমার পিতার দিক দিয়ে সম্পর্কযুক্ত আত্মীয়দের নিয়ে কথা
বলতে চাই না, কারণ তারা কখনই আমার খোঁজখবর
নেবার প্রয়োজনটি বোধ করেনি। অতএব দয়া করে আমার কথাগুলোর
অন্যথা-ব্যাখ্যা দিও না।’
ঠিক এই কথাগুলোই কি শুভময় শোনেনি অনুরাধার সাথে বিয়ের
পর, অহনার তখন জন্মই হয় নি।মনে পড়ে অনুরাধা,
অনুরাধার বাবা, মা,
দাদা, এমন কি কাজের ঝিও
শুভময়কে জানিয়ে দিয়েছিলো শুধু শুভময় ছাড়া ও পরিবারের আর কারো সাথে
মিশবার অভিপ্রায় এ পরিবারের কারোরই নাই। শুভময়,
একমাত্র তুমিই ভালো, তুমিই ব্যতিক্রমী,
তুমি ছাড়া তোমার অন্য কোনো স্বজন আমাদের সমাজের যোগ্য
নয়। এটাই একদিন পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিলো অনুরাধার পরিবার। প্রায়
দেড়যুগ পর অহনার চিঠি কি সেই ধ্বনিরই প্রতিধ্বনি নয়?
শুভময়ের বাবা যতদিন বেঁচে ছিলেন অহনাকে দেখতে গিয়েছেন
শত লাঞ্ছনা, অপমান সহ্য করেও। শুভময়ের
ভাইবেনেরাও চেষ্টা করেছে যতটুকু সম্ভব। এই যে বিশেষভাবে শুভময়ের
আত্মীয়দেরকে অপমান করা, এ বাড়ির ত্রিসীমানায়
আসতে না দেয়া, এই সবের পিছেই কি লুকিয়েছিলো না
একদিন বড় হয়ে অহনার মনে পিতৃকূলের বিরুদ্ধে এক তীব্র বিরাগ তৈরী করার
ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র? এ জাতীয় ষড়যন্ত্রে ক্ষতি
ছাড়া কি লাভ হয় কে জানে, তবু এই এক বিকৃতি
থেকে কিছু মানুষ মুক্তি পায় না কিছুতেই।
অহনা কন্যা সন্তান, তার মায়ের
প্রয়োজনীয়তা ছিল বলেই শুভময় তাকে স্বেচ্ছায় দাদু-দিদিমার হাতে তুলে
দিয়েছিলো? আত্মপক্ষ সমর্থন মানুষকে হয়তো
খানিকটা অন্ধ বানিয়ে দেয়, আত্মপক্ষ সমর্থন
দোষের নয়, তবে মানুষের যুক্তিবোধের বিনষ্টি
শুভময়কে পীড়িত করে। শুভময়ের পুনর্বিবাহই যুক্তিযুক্ত হতো অহনার মায়ের
শুন্যস্থানটি পূর্ণ করার মতো ব্যাপারটা সহজ হলে। শুভময় নিজে,
তার বাবা মা, আত্মীয়স্বজন অনেক
চেষ্টা করেছিলো অহনাকে নিজের কাছে রাখতে। অহনার দাদু-দিদিমা সাঙ্গপাঙ্গ
ডেকে, নানাবিধ হুমকির মুখে শুভময়কে বাধ্য
করেছিলো সাময়িক ভাবে তাদের কাছেই শিশুটিকে রেখে আসতে। অহনা যে তার
দিদিমাকে মা বলে ডাকে, সেটাও খুব শ্রুতিমধুর
বলে মনে করে না শুভময়। এই সাময়িক তত্ত্বাবধানের সময়সীমা অহনার
স্বেচ্ছাচারী দাদু-দিদিমা নিজেরাই ফলত নির্ধারণ করেছিলো। তাদের
গোয়ার্তুমির কারণেই শুভময় শত চেষ্টা করেও মেয়েকে নিজের সাথে বিদেশে
নিয়ে আসতে পারেনি, পারলে শুভময়ের নয় অহনারই লাভ
হতো আজ।
চলবে...