মেঘ রাজা ও রোদ রাজা
ফিরোজা হারুন
এক ছিল এক রাজা। নাম ছিল রোদ রাজা। তার রাজত্বে কেবল রোদ আর রোদ। চারদিকে রোদে ঝলমল। ভোর না হতেই পূবাকাশে সোনার থালার মত সূর্য উঠে। আকাশ ঘন নীল। কোথাও মেঘ নেই। সাদা মেঘ, কাল মেঘ, সিঁদূরে মেঘ সব যেন দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। মাথার উপর আকাশ গাঢ় নীল সামিয়ানার মত। সময় যায়। সূর্য আকাশ পথ বেয়ে মাথার উপর উঠে আসে। তখন রোদে রোদে দেশ ভরে যায়। গাছ-পালা, ঘর-বাড়ি, মাঠ-ঘাট সব যেন গলানো সোনার আবরণে চকচক করতে থাকে। মানুষগুলো মনের আনন্দে কাজ করে। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের মনের একটা মিল আছে। আকাশ যদি আলোয় ভরে থাকে, মানুষের অন্তর ভরা থাকে আনন্দে। আর যদি থাকে মেঘে ভরা, তবে কি যেন নেই, কি যেন নেই Ñ এরকম একটা ভাব তাকে। রোদ রাজার দেশের লোকের সব সময় হাসিখুশী। তাদের কোন দুঃখ নেই। ওরা কাজ করে খায়, দায়, গান গায় তাইরে নাইরে না। রোদ রাজার দেশে বিকেল হয়, সোনা ঝরা বিকেল। মানুষ দিনের কাজকর্ম সেরে এদিক ওদিক বেড়াতে যায়। সারা দেশে আনন্দ আর আনন্দ, খুশীর যেন শেষ নেই।
এদেশের পাশেই আরেক দেশ ছিল। তার নাম মেঘ রাজার দেশ। মেঘে মেঘে ছেয়ে থাকে সারা আকাশ ঝমঝম বৃষ্টির শব্দে মানুষের ঘুম ভাঙ্গে। বৃষ্টি কখনও কমে, কখনও বাড়ে। এই যা। যখন বৃষ্টি কমে তখন মানুষেরা তাদের কাজকর্ম করে। যখন বাড়ে তখন ঘরে বসে থাকে। নানা রকম বৃষ্টি আছে মেঘ রাজার দেশে। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি, টিপটিপ বৃষ্টি সাধারণ বৃষ্টি, ঝমঝম বৃষ্টি, মুষলধারে বৃষ্টি, বান-ডাকা বৃষ্টি। কত রকম যে বৃষ্টি! মানুষের জীবনে কোন সুখ নেই, কোন আনন্দ নেই। হাসি নেই, গান নেই, কোলাহল নেই। গাছ-পালা ভেজা, পশু-পাখিরা ভিজে জবুথবু। তাদের কণ্ঠে সুমধুর সঙ্গীত নেই। মেঘের দেশে কেবল মেঘের গুরুগুরু গর্জন। বজ্রের নিনাদ। বৃষ্টির গান। আর থেকে থেকে বিজলী চমকে আলোকিত হয়ে উঠে চরাচর।
এই মেঘ রাজার একটি ছেলে ছিল। নাম তার মেঘনাদ। সে বড় হল। তার বিয়ে দিয়ে রাজামহাশয় বিশ্রাম নিতে চান। সুন্দরী রাজকন্যা চাই রাজকুমারের জন্য। লোক পাঠানো হল পরগনায় পরগনায়। অবশেষে সন্ধান পাওয়া গেল এক পরীর মত কনের। নাম তার পামেলা। যেমন তার রূপ, তেমন তার গুণ। গৌরবর্ণ পানপাতা মুখের উপর পটলচেরা দুখানি আঁখি তার মায়ার জাদুতে ভরা। সে আর কেউ নয়, রোদ রাজার একমাত্র কন্যা। রাজপুত্রের বিয়ের দিনক্ষণ সব ঠিক হয়ে গেল। তারপর শুভ লগ্ন দেখে মেঘাজার পুত্র মেঘনাদের সঙ্গে রোদ রাজার কন্যার বিয়ে হয়ে গেল। মহাধুমধাম হলো বিয়েতে। দুই রাজ্যের লোকেরা সব আনন্দ ফূর্তিতে মেতে উঠলো। পোলাও, কোরমা আর কত রকম ফল যে সবাই খেল, তার হিসাব নেই। মেঘ রাজার দেশে আনন্দের বন্যা বইতে লাগলো। কিন্তু বিপদ হলো রাজকন্যা পামেলার। তার মন ভাল থাকছেনা কিছুতেই। ঘরেই থাকতে হয় তাকে। বাইরে যাওয়ার কোন উপায় নেই। সব ভিজা, সব কেমন স্যাতঁসেতে। আগুন নিয়ে কত আর শুকানো যায়!
দিনে দিনে রাজকন্যার বদন মলিন হলো। আগের মত আর প্রাণ খুলে হাসতে পারে না। একদিন রোদ রাজা, লোক-লষ্কর নিয়ে মেঘ রাজার দেশে বেড়াতে এলো। রোদ রাজার আগমনে মেঘের দেশে বাদল টুটে গেল। আকাশ হলো ঘন নীল। পাখিরা ডানা ঝাপটা দিয়ে আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো। তাদের কণ্ঠে গান বেজে উঠলো। গাছের পাতারা রোদের ছোঁয়ায় দুলে উঠলো। ঘর ছেড়ে বাইরে এসে দাঁড়ালো সব প্রজারা। রাজ্যময় রটে গেল রোদ রাজার আগমনের সংবাদ। প্রজাদের খুশী আর ধরে না। জীবনেও তারা এত সুখ পায়নি। এত সুখেও রাজকন্যার চোখে পানি। তাই রাজা খুব দুঃখ পেলেন। পামেলা বললো এত বাদল তার ভাল লাগেনা। আলোহীন জীবন তার নিরানন্দে ভরা। কি করে কন্যাকে সুখে রাখা যায় রাজা তাই ভাবতে লাগলেন। কিন্তু কিছুই করতে পারলেন না। মেঘরাজা রোদ রাজাকে অনেক আদর-যত্ন করলেন। মজার মজার খাবার দিলেন। সুন্দর সুন্দর উপহার দিলেন। এ দিকে পামেলা একটা বুদ্ধি খুঁজে পেল। সে একটা বড় মটকা উঠানে রেখে দিল। তার ভিতরে ঢুকে গেল অনেক রোদ। ঢাকনা দিয়ে মুখ বন্ধ করে দেয়া হলো সেই মটকার। বেড়ানো শেষে রোদ রাজা ফিরে গেলেন নিজের দেশে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। দিনের আলো নিভে গেল। পরদিন ভোরে যথারীতি বর্ষণ হওয়ার কথা। কিন্তু তা আর হলো না। সুন্দর নরম রোদে ভরে গেল সারা দেশ। বিস্ময়ে হতবাক হলেন মেঘ রাজা। জানতে চাইলেন কেন এমন হলো। তখন পামেলা বললো যে সে একটি মাটির মটকায় রোদ ধরে রেখেছে। সকালে মটকার ঢাকনা খুলে দিতেই রোদ বেরিয়ে পড়েছে।
এভাবে পামেলা প্রতিদিন ভোরে মটকার মুখ খুলে রোদ বের করে, আবার বিকেলে ঢাকনা দিয়ে রোদ বন্দী করে রাখে। মেঘ রাজ্যের দুঃখ দূর হল। প্রজারা রাজকন্যাকে ধন্য ধন্য করতে লাগলো। পামেলার এখন আনন্দের সীমা নেই, আদরেরও সীমা নেই।
***