কার্তিকের কুয়াশা

এবারের টিপ্ স:
লঘু কন্ঠে আমি অনেকবার এরকম একটি কথা বলেছি যে, লেখাটা কোনো কঠিন কাজ নয়, যে কেউ লিখতে পারেন, কঠিন হচ্ছে, লেখাটিকে একটি পাঠের অধিক আয়ু দান করা   
~ সৈয়দ শামসুল হক
  স্মৃতির দুয়ারে
ফিরোজা হারুন

আমাদের পাশের গ্রাম ছিল রসুলপুর। এ গ্রামের অধিকাংশ লোক হিন্দু। ঐ অঞ্চলে এই গ্রামটি ছিল একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা ছিল অতিশয় বিদ্বান। বিখ্যাত র্যাং লার কিরণ রায় এই গ্রামেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন। নানা বিদ্যায় পারদর্শী অনেকে ভারতে উচ্চপদে আসীন। এই গ্রামের ভিতর দিয়ে চলার সময় মনে হত একটি সাজানো, গোছানো, আদর্শ বসতি। পরিষ্কার ছিমছাম বাড়িঘর, নিকানো উঠান, ফুলের বাগান, ফলের গাছ, শান বাধানো পুকুর ঘাট-সব যেন ছবির মত। ভারত বিভক্তির পর অনেক হিন্দু ভারতে চলে যান। ফলে হিন্দুদের সংখ্যা হ্রাস পায়। যারা ছিলেন তাদের একজনের নাম ছিল নিশিকান্ত। অবস্থাপন্ন ব্যক্তি, মান্যগণ্যও বটে। পাঞ্জাবী মিলিটারিদের ক্রোধ হিন্দুদের উপর খুব বেশী ছিল। একদিন গভীর রাত্রে তারা রসুলপুরে হানা দেয়। রাস্তা চলতে চলতে তারা দু’ধারে জনপদে আগুন ধরিয়ে দেয়। এলোপাথারি গুলি চালায়। পরে এসে পৌঁছায় নিশিকান্তের বাড়িতে। বাড়ির মালিক নিশিকান্তকে ওরা ধরে ফেলে। নিশিকান্তের শোবার ঘরের বড় খুঁটিতে তাকে রশি দিয়ে বেঁধে ফেলে। বাড়ির আরও ছয়জন ধরা পড়ে। তারপর বাড়িতে পেট্রোল ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। বিরাট বাড়ি দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। নিশিবাবুদের আর্ত চিৎকারে জেগে উঠে গ্রামবাসী। তাদের সম্মিলিত চিৎকারে এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। জেগে উঠে আমাদের গ্রামের মানুষেরা। তারা বিস্ময়ের সঙ্গে দেখতে পায় বিশাল অগ্নিকুন্ডের গগনচুম্বি লেলিহান শিখা। আগুনের প্রচন্ড তাপে আটচালা টিনের ঘরের চালের টিনগুলো ঠাস ঠাস বিকট শব্দে ছুটে যেতে থাকে। ভয়ে আবাল বৃদ্ধ বণিতা থর থর করে কাঁপতে থাকে। নিশিকান্তের আওয়াজ স্তব্ধ হয় চিরতরে।
যুদ্ধ জয়লাভের মিথ্যা প্রচারণা পাকিস্তানীরা তাদের নিজেদের দেশেও চালাতো দক্ষতার সাথে। প্রতিদিন খবরের কাগজে পুরো পৃষ্ঠা জুড়ে বড় আকারে লেখা থাকতো ইংরেজী অক্ষর V (ভি) অর্থাৎ ভিকটরি-বিজয়। পাকিস্তানীদের ভাষায় আখেরী ফাতাহ্ হামারা হোগা। যার অর্থ হলো, শেষ বিজয় আমাদের হবে। সাধারণ নাগরিকরা মনে প্রাণে তাই বিশ্বাস করতো। তারা জানতো না এই V এর কোন সত্যতা নেই। পাকিস্তানীরা অল ইন্ডিয়া রেডিওর উর্দূ গানের প্রোগ্রাম খুব পছন্দ করে। প্রায় সময় রেডিও চলে। কিন্তু যখন খবর প্রচারের সময় হয়, তখন তারা ঠাস করে রেডিও বন্ধ করে দেয়। উর্দূতে বলে, ইন্ডিয়ান খবর শুনে মনে হয় যেন, সত্যি কথা বলছে। কাফেররা মিথ্যা সংবাদকে কেমন সত্য সংবাদের মত পরিবেশন করে, ওরা বড় চতুর। খবর শুনলে মনে হয় বিশ্বাস করি! আসলে সব খবর মিথ্যা!
যেদিন বৃক্ষ সমূলে উৎপাটিত হলো সেদিন সেদেশের সাংবাদিকগণ সত্য গোপন করেনি। তারা সত্য সংবাদ ছাপালো। এতদিন পর তারা পত্রিকায় বিরাট বড় হেড্ লাইন লিখলো, OUT ! একটি শিরোনাম, একটি লাইনে। এখনও সেই বিরাট OUT লেখাটি আমার চোখে ভাসে। যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার মাঠে পাকিস্তান আউট হয়েছে। এটি একটি বাস্তব ঘটনা যে পূর্ব বঙ্গ স্বাধীন হয়েছে। বাঙালীরা পাঞ্জাবী দৈত্য দানবের থাবা অবশ করে দিয়েছে। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর যৌথ বিক্রমের নিকট পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হিংস্র উন্মত্ত তান্ডবলীলার অবসান ঘটেছে। অবশেষে এসেছে সেই দিন। আনন্দের দিন , বিজয়ের দিন ১৬ ই ডিসেম্বর,সেই ১৯৭১ সালেই।
কিন্তু এ সংবাদটি অবিশাস্য মনে হল পাকিস্তানী জনগণের কাছে। সেদিনে হঠাৎ করেই নিস্তব্ধ হয়ে পড়লো চারিদিক। গাছে গাছে পাতারা যেন ঝুলে পড়েছে, পাখীর কুজন গেছে থেমে। রোদ্র যেন ঝিমিয়ে পড়েছে। প্রকৃতি শুনশান। আকাশ, বাতাস, পৃথিবী সব দুঃখে মগ্ন। কোথাও কোন শব্দ নেই, কোলাহল নেই। মনে হয় ঘরে ঘরে মৃত্যু শোক। প্রত্যেকটি নাগরিক যে যেখানে ছিলো মাথা নীচু করে বসে পড়লো। তারা তাদের সরকারের হঠকারিতা উপলব্ধি করতে পারলো। তারা বুঝতে পারলো তাদের সরকার তাদেরকে এতদিন মিথ্যা কথা বলে প্রতারিত করেছে। তারা জানতে পারলো দেশের সরকার অন্যায় সমরে লিপ্ত ছিল। দেশী পত্র-পত্রিকা বা মাধ্যমগুলো এতদিন সত্য সংবাদই পরিবেশন করেছে, কিন্তু অন্ধ বধির তারা,সেসব সংবাদে কর্ণপাত করে নাই, বিশ্বাস স্থাপন তো দূরের কথা।
 
Best Buy Coupons
Best Buy Coupons