সম্পাদকের ডেস্ক থেকে
কার্তিকের কুয়াশা’র এই বিজয় দিবস সংখ্যায়, গলা
পেঁচিয়ে ধরে সাপের মতো স্মৃতি, বিজয় দিবসের এই সূচনালগ্নে বলতে পারি না
স্মৃতি সততই সুখের । ৩০ লক্ষ মানুষের প্রাণ আর ২ লক্ষ নারীর সম্ভ্রমের
বিনিময়ে অর্জিত প্রিয় বাংলাদেশ ।
বিপুল সখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির জন্ম স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে। বাংলাদেশ
ই একমাত্র দেশ যে দেশের একমাত্র এবং জাতীয় ভাষা বাংলা। ও আমার
মাতৃভূমি, ও আমার স্বদেশভূমি , তোমার পরে ঠেকাই মাথা । মহান
মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর প্রতি
শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করে সকলকে মহান বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন!
‘বালক বয়স’ ক’বছর বয়স থেকে শুরু হয় যেন? ছ’ সাত বছর? আমার তখন ছ’ সাত
বছরই বয়স। ১৯৭১ সালে শত্রুর বোমা বারুদে খুন হলো প্রায় ৩ মিলিয়ন অমূল্য
প্রাণ এবং সেই সাথে আমার নিজস্ব এবং আরো অনেকের বালক বয়স। বয়সের মৃত্যু
হলো; সময়ের সাথে আমাদের বালক বয়স বেড়ে কিশোর, যুবক, বৃদ্ধ কিছুই আর
হলোনা। যুদ্ধের ট্রমা বুকে যেসব বালক বেঁচে রইলো অনন্যোপায় Zombi র মতো
– আমি তাদেরই একজন।
আমাদের স্মৃতি সততই হৃদয় বিদারক। মনে পড়ে গরুর গাড়িতে বাড়ি ফেরা খোনোর
শবদেহ। মনে পরে গড়াই নদীর জলে ভেসে গেছে শবের বন্যা, এ বালকের জানা হয়
নি কি ছিলো তাদের নাম, কোথা ছিলো গ্রাম। ধর্ষিতা মেয়েটির মুখ আজও অবিকল
মনে পড়ে। মনে পড়ে ‘খেলায় নিতে হবে’ এই অপরাধে শত্রু ক্যাম্পে কাটানো
আমার কয়েক ঘন্টা। মনে পড়ে পিতামহের হাত ধরে নদী-ঘাট, মাঠে মাঠে পালিয়ে
ফেরা নিশীদিন। মনে পড়ে বিরতিবিহীন একটানা অনাহার।
কে যেন কান্নার ফাঁকে বলে গেলো আনো ডাক্তারের ভাই খোনো খুন হয়ে গেছে
পূর্ণিমার রাতে। মড়া আমি দেখেছি আগেও। তবে নিহত এই প্রথম। একগ্রাম
মানুষ, মাথার উপর পাখিরা, পাশে বয়ে যাওয়া নদী -সবাই বাকরুদ্ধ হয়ে
থাকলো। আমরা দল বেঁধে দেখলাম একটি শবদেহ। অনেক প্রশ্নে হৃদয় ভারি হলো।
তবু ফুটলো না মুখে একটি কথাও। নিজেই বুঝেছি এ সময় নীরবতার। আমার হাত
ধরা পিতামহের মুঠি শক্ত। মুখ তুলে তার চোখের দিকে তাকিয়ে আমার প্রথম
সমুদ্র দর্শন হলো
– তিনি শুধু অস্ফুট বললেন ‘মুক্তিযুদ্ধ’।
আমার জীবনে মুক্তিযুদ্ধ এভাবেই শুরু হলো। তারপর ২৬৬ টি দিবসের ২৬৬ টি
রজনীর দীর্ঘ, দীর্ঘতম পথটি শেষ হয়ে এলো, এলো না স্বাধীনতা। একদিন ২৬৬
টি নিশীদিনের দীর্ঘতম পথটি শেষও হলো, স্বাধীনতা এলো না তবুও।
স্বাধীনতার কথাটা থাক। বিবেক বালক যা বলছিলে তাই বলো – তোমার সেই
স্মৃতির কথা।
সূয্যি মামা তেঁতে ছিলো, গুমোট ছিলো হাওয়া, তাইতো যাওয়া বাড়ির পাশে সেই
নদীতটে। একা আমি, একাই বটে, হেঁটে এসে নদীর পাশে দাঁড়াতেই মাছেদের
ক্রন্দন শুনে চকিতে চমকাই -কারা যায় ঐ জলে ভেসে? কোথা থেকে আসা ঐ
বিদেশী নিষ্প্রাণ দেহমন্ডলী আমাদের এই নদী নাম্নী গাঁ –এ? শিশু মাছটি
কি তার মাকে তাই শুধোলো? এইরকম একটি দৃশ্যই মনে পড়ে। স্রোতে ভাসা
মানুষের শব, যেদিকে তাকাই চোখ জ্বালা করে ওঠে। আজো ওঠে। ‘মানুষ মানুষের
জন্য’ কথা ক’টি মিথ্যে শুনায়।
বিবেক বালক এবার তবে সেই মেয়েটির কথা বলো। সে কি আজো আছে? নিশ্চয়ই আছে,
থেকেছে এতকাল, থাকবে নির্ঘাৎ যতকাল আমিও আছি। খুলে মেলেই বলছি তবেঃ
পশুর দল হল্লা শেষে যেই ফিরেছে, কানে কানে ফিসফিসিয়ে উচ্চ এবং অনুচ্চ
স্বরে সারা গাঁ-এ রাষ্ট্র হলো নারকীয় সেই ঘটনা। রটনা নয়, নিরুংকুশ এক
সত্যি দেখতে ঘনীভূত হলো হালকা পাতলা গ্রাম খানি কুমারী বিভা রাণীর
উঠোনে। আমিও ছিলাম সেই ভীড়ের ভিতর নীল হয়ে আসা এক চিলতে হৃৎপিন্ড। আর
কারো নয় আমার চোখেই কি তবে একবার শুধু চোখ রেখেছিল কুমারী বিভা রাণী?
এটাও তবে থাকুক অসমাপ্ত – বড় রকম ব্যথা করে ওঠে বুক। বিবেক বালক খেলার
ছলে বলবে নাকি সেই খেলাটি?
তবে তাই হোক, সেই ভীষণ খেলাটি ভীষণ ভাবেই মনে পড়ে, সবুজের প্রতি আমার
ছিলো খুব টান। কাউকে সঙ্গে নেব, তাও নয়, একাকী হিংসুটে, বনে জঙ্গলে
বেড়াতে খুব ভালো লাগতো। বনের ভেতর সহসা দেখি মুক্তিবাহিনী। কেটে রাখা
কলাগাছে লুংগি জামা পরাচ্ছে, সামনে কাঠের তৈরি রাইফেল।‘আমাকে খেলায়
নিতে হবে’ বললেই সহজে নেবে না তা আমার জানা। তাই ওৎ পেতে থাকি
সুযোগের।মুক্তি সেনারা সরে যেতেই লাফিয়ে পড়ি। লাথি মেরে সরিয়ে দিই
ফাঁদের এক কলাগাছ সৈনিককে। বুকে চেপে ধরি জোরে কাঠের রাইফেল। অদূরে
কোথাও গুলি ছুড়লো, মুক্তি সেনারা। একটি মুহূর্ত যেন। তারপর শত্রু
সেনাদের কোটি কোটি গুলি এসে বিঁধলো আমার কলাগাছ সহযোদ্ধাদের বুকে। ভয়ে
চোখ বন্ধ করে আছি, চিতকার শুনে চোখ খুলে দেখি শত্রু সেনারা ঘিরে ফেলেছে
আমাকে। একজন আমাকে প্রায় টেনে হেঁচড়ে ওদের ভ্যানে তুলে নিলো।
মুক্তিবাহিনীর কেউ আর গুলি ছুড়লো না।ওরা আমাকে দেখেছে বলেই বদলে
নিয়েছিল প্ল্যান। শত্রুসেনাদের ভ্যান ওদের ক্যাম্পে ফিরে এলো।উত্তেজনায়
বুকের ভেতরটা খুব কাঁপছে। এক অজানা কারণে আমার গায়ে একটি নখের আঁচড়ও
পড়লো না।
সন্ধ্যে বেলায় ওদের এক বড় কর্তা জানালো বিচিত্র বিকৃত এক বাংলা ভাষায়
যার অর্থ হয় আমার চাচা আমাকে নিতে এসেছে। চাচাকে দেখে আনন্দে কেঁদে
ফেলেছিলাম। দুজন মিলে যখন বেরিয়ে যাবো ক্যাম্প থেকে তখন সে আরো একবার
ডাকলো। আমরা দাঁড়িয়ে আছি। বুকের ভেতর অনিশ্চয়তা। বৃহদাকার গরিলাটি
বললো, তোমার চাচার চুল খুব লম্বা, তার চুল কেটে দিও। আমরা আর দেরি করি
নি। বাড়ি ফিরে আমার মুক্তিযোদ্ধা চাচা অনেক বকুনি দেবার ইচ্ছে বুকে
চেপে শেষমেষ কিছুই বললেন না।
মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়ে এলো, স্বাধীনতা এলো না।
মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়ে গেলো, স্বাধীনতা এলো না।
চঞ্চল জামান
টরন্টো, ক্যানাডা, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১১
editor@kartiker-kuasha.nauba-aloke-bangla.com