কার্তিকের কুয়াশা

কার্তিকের কুয়াশা – 3
এবারের সংখ্যাটিতে ভেবেছিলাম আমার লেখাটি ‘পাঠকের কলমে’ স্থান পাবে, তার বদলে; দেখছি একটি বিভাগ যুক্ত হয়েছে পর্যালোচনা নামে। নামেই যে শুধু নতুনত্ব রয়েছে তা নয় বরং এর মধ্যে দিয়ে পত্রিকাটির পরিচালক মণ্ডলী সংখ্যাগত ভাবে এক আলাপ আলোচনার জায়গা করে দিলেন দেখে পত্রিকাটির উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা পাঠকেরা বেশ স্বচ্ছতার আভাস পেলাম। ধারণা আরও দৃঢ় হল যখন দেখলাম পত্রিকাটির প্রচ্ছদ এবং হরফ নিয়ে পরিচালক মণ্ডলী ভাবনাচিন্তা করতে শুরু করে দিয়েছেন।
সম্পাদকীয়তে আমার কিছু প্রশ্নের জবাব পেলাম। বিশেষত: কল্প-গল্প বোধ নিয়ে আমার জিজ্ঞাস্যটি নিরসন করেছেন – ভালোকথা। তবে পাঠকেরা যেহেতু একটি গল্প পড়ছেন সেহেতু বোধহয় কোন লেখা থেকে উদ্গত জিজ্ঞাসার উত্তর পাঠক খুঁজবে সেই প্রতিপাদ্যটি থেকেই। যাইহোক আমার এবারের সংখ্যাটি পড়ে যা মনে হল:-
কবিতা – ১
যদি একবার বলো – সনাতন দাস

কবিতাটি ভাল লেগেছে। কবিতাটির প্রথম স্তবকে একটি কথা কবি বলেছেন বড় আবেগ-ঘন শব্দে, ‘জীবন্ত বেদনা’কে বর্ণনা করেছেন তাঁর ‘স্বপ্নিল আহারের’ সাথে , তবুও একটি খটকা রয়ে গেল পরের লাইনে – ‘যা তোমার অন্তর পার হয়ে ,ছুঁতে চায় আমার চারণভূমি, অনন্ত নীল।‘ এখানে ‘তোমার’ যদি কবির প্রতীক্ষার তুমি হন তবে তার অন্তরের পার হওয়া কবির কাম্য কেন? ব্যাপারটির মধ্যে এক অধরা অস্বস্তি রয়ে গেল।
কবিতাটির দ্বিতীয় স্তবকটি ভারী ভাল লেগেছে। খুব মৃদু সুর, কিন্তু কোথাও থমকে যাওয়া নেই, সাবলীল গতিটির লক্ষ্য স্থির। সকাল থেকে দুপুর,দুপুর থেকে মধ্যরাত্রি – উপলব্ধির স্বরটি মোলায়েম কিন্তু দৃঢ়, কোথাও দ্বিধা নেই। কবিতাটির নামে যে যদিটি আছে লেখাতে সে যদির আশংকা প্রায় নেই বললেই চলে।
কবিতা – ২
অরণ্য ক্রন্দন – শ্রীধর মণ্ডল।

গত সংখ্যায় লিখেছিলাম সম্পাদনার টেবিলে মঞ্জুরি পাওয়ার কথা নিয়ে। এবারে এই লেখাটির বানান ও শব্দের ছিরি দেখে বুঝতেই পারছিনা সম্পাদক তার প্রথম সংখ্যায় ‘নতুন লেখক, প্রথম লেখা’ ইত্যাদি বলে যে আবেদনটি রেখে ছিলেন তার মানে এই হোল কিনা যে লেখাগুলির মধ্যে ভুল বানান বা ভুল শব্দের ও কোনরকম সম্পাদনা হবে না। আশ্চর্য! (পড়তে হবে সম্পাদনার টেবিলটি ফাঁকি দিয়েছেন)
এই লেখাটির কথা বলতে গেলে এটাই মনে হয় যে সাধু/চলতির গোলমাল ছাড়াও ভাবের জায়গাতেও প্রচুর ফাঁক ফোকর। সত্যি বলতে কি বুঝতেই পারলাম না কবিতাটি কখন রম্য-কবিতাতে রূপান্তরিত হল, আর বক্তব্যই বা কি পরিস্ফুট করলেন? ছন্দ মেলানো মানে যদি শেষ শব্দের মিল হয় তাহলে কিছু বলার নেই। একটিই কথা অনেক পরিমার্জন দরকার।
কবিতা – ৩
সময় – আবদুল হাকিম।

এই লেখাটিও যেন লিখতে হয় বলে লেখা। সময় নিয়ে বলতে গিয়ে প্রিয়ার মদির চোখে হারিয়ে যাওয়াতে আমাদের আটকে দিলেন। কোন উৎস বা কিসের খোঁজ সবই অব্যক্ত রেখে দিয়েছেন, মনে হল কবিতাটির মধ্যে ঐ পাঁচটি অক্ষর ব্যবহার না করার প্রমাণতাই প্রাথমিকতা। কবিতাটিকে কবিতা করার কোন দায়বদ্ধতা নেই।
কবিতা – ৪
খেলা – কোয়েল সাহা।

ওনার একটি নিজস্ব শৈলী আছে। খুব সাধারণ কথায় লেখেন সরল জীবনবোধের কথা। লেখাটি যে স্টাইলে লেখা হচ্ছে তার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। ‘কি খেলা যে খেলেছিলে/ বেহিসাবি নিয়মে?/ হেরে গিয়েও গা জোয়ারি?/ অনেক হল- যাও থেমে’। সুন্দর ছোট ছোট কথায় জীবনবোধের বর্ণনাটি খাঁটি। কবিতাটি ভাল লেগেছে।
কবিতা – ৫
হতাশার কবিতা – সাগর জামান।

কবিতাটি হতাশার। জীবনবোধও হতাশার। কখনও যদি হতাশার অপর পক্ষটিকে বুড়ি ছোঁয়ার মতও ছুঁয়ে যেতেন ভাল লাগত। ‘প্রতিবন্ধকতা প্রচুর’ কিন্তু লেখার মধ্যে তা নেই। আছে একটি কথা ‘স্বজনের কাছে আমার অক্ষমতার অপরাধ অনেক’ – বাকি ভোঁ ভোঁ। বুঝে নিতে হবে(!)। হতাশা থেকে উঠে আসা জীবনবোধে? তাও পাওয়া যায়নি। যা বোঝার বুঝে নিতে হবে। তাহলে কবিতাটির সম্পূর্ণতা কোথায়? অথচ লেখাটি কিন্তু তর তর করে পড়া যায় হোঁচট না খেয়েই। হতে পারে যারা অনেক লেখেন তাঁরা কখনো কখনো এমনি ক’টা লাইন ছুঁড়ে দেন। সব সময় পাঠকের কথা ভেবেই যে লেখেন তা নয়। পক্ষকালের বেদনা – মুহূর্তের দ্বিধা থেকেও এমন সব মামুলী লেখা বেরোয়।
ছোট গল্প
জানি আমি – হুমায়রা হারুন

আজকাল যখন ই-মিডিয়ার কল্যাণে এত লেখা দেখতে পাই অথবা প্রথম সংখ্যায় সম্পাদকের যে উদাত্ত আহ্বান ছিল তা পড়ার পর যখন দেখি কোন বিভাগে মাত্র একটি লেখা বা কোন বিভাগে একটিও নেই তখন মন খারাপ হয়। মনখারাপের কথা বললাম কারণ এই পত্রিকাটির সাথে হয়তো মানসিক ভাবে জড়িয়ে গেছি।
হুমায়রা হারুনের লেখাটি ছোট গল্প বিভাগে একমাত্র লেখা। এই লেখাটিকে কি গল্প বলা যায়? হয়তো যায় হয়তো বা যায়না, যদি গল্প না বলি তাহলে কি বলি? গদ্য কবিতা? – তাও নয়। সে যাই হোক, সে সব বিদ্বজ্জনের ভাবনা; আমার মত অজ্ঞাত কুলশীল পাঠকের যেটা দরকার সেটি হল তৃপ্তি বা পরিতৃপ্তি। তবে এটির দৈনিক পত্রিকার যেমন জায়গা বা শব্দের প্রতিবন্ধকতা থাকে তেমন তো ছিল না তাই এটি ছোট গল্প হলেও সামান্য বড় হওয়ার দরকার ছিল। ‘জানি আমি’ – নিজেকে লেখা এক স্বগতোক্তি। এবারের সংখ্যাটিতে আমার চোখে এটিই সেরা, তা সেরা হওয়ার জন্য প্রেমের থেকে ভাল প্রতিপাদ্য আর কি বা হতে পারে।
গল্পটি একটি ক্লাসিক প্রেমের গল্প। সাতসমুদ্র পেরিয়ে অমিত্রা আর সুমনের মিলন, ক্ষণিকের উদ্দামতা, তারপর আপাত বিদায়-লগ্নে দয়িতার কোলে দয়িতের মৃত্যু। কিন্তু প্রেমের মৃত্যু হয়না, সুমনের সঙ্গে ক্ষণকালের প্রেমই স্মৃতির ফল্গু নদী হয়ে বয়ে চলে অমিত্রার জীবনে। নিজের সঙ্গে নিজের কথা বলা, তাই বাহুল্য বিহীন; তবু মাঝে মাঝে এক একটি লাইনই অনেক কথা বলে।
‘কথা যতই বলিনা কেন কখনো ভাবিনি আমি তোমার প্রতি অনুরক্ত হব। এ আমার ভাবনারও অতীত ছিল’ – অদ্ভুত! একটি প্রেমের সম্ভাবনার কি সুন্দর প্রকাশ – অনবদ্য। গল্পটির এই লাইনটি , গল্পটিকে একটি মসৃণ টেক অফ দিলো। লাইনটির প্রত্যেকটি নঞর্থক কথা - হাজার বারের হ্যাঁ। কোথাও বলা নেই অথচ বুঝিয়ে দেয়, অদৃশ্য পরিচিতি ভালবাসার বেড়া বেঁধেছে দিন-প্রতিদিন।
‘দরজা খুলে দেখি খুব সুন্দর একটি মানুষ আমার সামনে’ – অসাধারণ! লাইনটি সুমনের সঙ্গে অমিত্রার প্রথম দেখা হওয়ার বর্ণনা অথচ একটিও আশংকার শব্দ নেই। আসলে ভাল না লাগার বা হতাশ হওয়ার কোন জায়গাই আর অবশিষ্ট নেই তখন ঐ দুটি মানুষের মনে। ভালবাসা ইতোমধ্যে তার কাজটি সেরে ফেলেছে। কোন দ্বিধা নেই, যেন সুন্দর হওয়ারই ছিল।( ঐ পেন ফ্রেন্ডশিপের জায়গাটি একটু বড় হওয়ার দরকার ছিল।) আসলে দুটি মানুষ যখন ভেতরে ভেতরে ভালবাসাতে থাকে তখন সুন্দর হয়ে ওঠা ছাড়া আর কিছু করার থাকেনা। হয়তো অমিত্রা আর সুমন খুবই সাধারণ ছিলো কিন্তু প্রেমময়তা তাঁদের মধ্যে আর অসুন্দরের জায়গা রাখেনি। Bravo – ঠিক এই জায়গা থেকেই কখনও আমার লেখাটিকে শুধু ছোট গল্প নয় অন্য কিছু মনে হয়েছে। মনে হয়েছে এর বিচরণ ক্ষেত্রটি অনেক ঊর্ধ্বে।
ধারাবাহিক
সুখের লাগিয়া – ফিরোজা হারুণ।

ফিরোজা হারুণের লেখাটি প্রথম সংখ্যার পর আর এগোয়নি – কারণ নিশ্চয় কিছু রয়েছে তা সম্পাদকীয়তে উল্লেখ করার দরকার ছিল। বিশেষত: উপন্যাসটি যখন already published.
কল্প বিজ্ঞান
নিকষ কালো – হুমায়রা হারুন

পর পর তিনটি সংখ্যাতে ওনার কল্পবিজ্ঞান বিভাগে গল্প বেরিয়েছে। গতবারের মত বা এই সংখ্যায় অন্য লেখাটির মত বেশ নিটোল একখানি গল্পের প্রত্যাশা পূরণ করতে অক্ষম গল্পটি। বরং গল্পটির দ্বিতীয় অধ্যায়ে ‘মারফি’ আর তার গাড়ি নিয়ে টানাপোড়েনের পর জড়পদার্থের বোধ বা অনুভূতি নিয়ে কয়েক লাইন খারাপ লাগলো না। গল্পটি ব্ল্যাক হোল, বা বারমুডা ট্র্যঙ্গেল কোথায় যে শেষ করতে চাইছিলেন ঠিক ধরা গেল না। একটু নেগেটিভ ভাবনা দেখা গেল। প্রতিটি অনুচ্ছেদ কেমন ধাঁধায় রেখে শেষ হল। অবশ্য বলতে পারেন ঐ ব্ল্যাক হোল থিওরি ধাঁধাই। তবে আমরা তো সাধারণ মানুষ, আমরা গল্প পড়ছি ; লেখাটির মধ্যে পৃথিবীর এতগুলি সাধারণ মানুষের হারিয়ে যাওয়া হল কিন্তু আর কিছু পাওয়া গেল না। ব্যাপারটা সহজ বোধ্য নয়। গল্পটি মোটামুটি।
কথা প্রসঙ্গে বলি, গত সংখ্যার গল্পটিতে জিসানের সঙ্গে শীলার প্রেম না হওয়ার ব্যাপারে প্রশ্ন করতে সম্পাদক মহাশয় যে মানুষ এবং মনুষ্যেতর প্রাণীর উদাহরণ দিয়ে জবাবটি দিয়েছেন সেই প্রসঙ্গে বলি পাঠক এখানে একটি গল্প পড়ছেন সাহিত্য পত্রিকাতে , কোন সায়েন্স জার্নালে কোন বিজ্ঞানীর আবিষ্কৃত ‘নিরস’(মাফ চাইছি শব্দটির ব্যবহারে) থিসিস পড়ছেন না। সে হলোই বা science fiction-এর গল্প। আর লেখককে ও মনে রাখতে হবে তিনি ultimately একটি সাহিত্য রচনায় ব্রতী হয়েছেন আর কিছু নয়। যে সব কল্প বিজ্ঞানের গল্প/উপন্যাস তার নিজ গুনে বিশ্ব সাহিত্যে আলাদা ছাপ রেখে গেছে তার প্রত্যেকটিই বিজ্ঞান আর কল্পনার সঙ্গে মানবিক রস/বোধের এক অদ্ভুত মিশ্রণ। খুব ইচ্ছে হচ্ছে সাম্প্রতিক কালের দুটি সিনেমা District 9 বা Avatar-এর উদাহরণ দিতে কিন্তু সেটি এখানে উচিৎ হবে কিনা বুঝতে পারছি না।
প্রবন্ধ
শিল্পী ও মিস্তিরী – শামসুল হক।

শামসুল হক বাংলাদেশ তথা বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে এক প্রিয় নাম। ওনার লেখাটি ধারাবাহিক ভাবে বেরোচ্ছে, ভাল লাগছে ওনার কথাগুলি – প্রতিটি লাইনে নিজেকে প্রতিস্থাপন করতে করতে এগিয়ে চলছি পরের লাইনের দিকে। কেন? আমিতো সাধারণ পাঠক আমার কেন এমন লেখক/কবি হওয়ার অছিলা? … আসলে তা নয়।
আমার মনে হয়েছে উনি সাহিত্য বা অন্য কলা নিয়ে যা বলেছেন তা শুধু সাহিত্য বা অন্য কলাতে আটকে নেই। শিল্পী আর মিস্তিরীর গল্প পরিসর করে নিয়েছে গোটা জীবন জুড়ে। ও আসলে এক কঠিন জীবনবোধের তত্ত্ব। একটি সংস্থার ইঞ্জিনিয়ার বা আর্কিটেক্ট ও তার কাজে সফল হয় ঐ দৃষ্টি / বুদ্ধির জোরে। তা শুধু ঐ উঁচু শ্রেণীর কথাই বা বলি কেন, জীবনের কোন তলাতে এই দৃষ্টি আর বুদ্ধির ছোঁয়া নেই? সামান্য খেটে খাওয়া মানুষের থেকে সাধারণ গৃহবধূর সংসার করাই ধরিনা কেন সবেতেই ঐ দৃষ্টি/বুদ্ধি বা শিল্পী মিস্তিরীর গল্প। যদি দুটির সমন্বয় ঠিক মতো ঘটলো তো সব ঠিক নইলে সে একটি বড় প্রজেক্টই হোক বা সামান্য মাঠে কোদাল চালানোই হোক বা সংসারের নিত্যনৈমিত্তিক রান্নাবান্নাই হোক দৃষ্টি/বুদ্ধির গাঁটছড়াটি না বাধলেই চিত্তির ফাঁক। জীবনের যে যে ক্ষেত্রে, মানুষ, ঐ জ্যামিতিক ফিগারটি আঁকতে অপারগ, সেই সেই ক্ষেত্রেই তার জীবন ঐ বৃত্ত বা আয়তক্ষেত্র বা চতুর্ভুজের জোড়া না লাগা ফাঁকটি দিয়ে ঝর্ণার জলের মত ঝরে পড়ে, ব্যর্থ হয় সমগ্র প্রয়াসটি। সঠিক মনন আর অনুশীলনের অভাব তৈরি করে ঐ তেপায়া চেয়ারের গল্প।
যেমন আমার এই পাঠক থেকে সমালোচক বা পর্যালোচক যাই বলা হোক সেই প্রক্রিয়াটি।
পত্রিকাটির জন্য শুভেচ্ছা রইল।
--------------শিবশংকর মণ্ডল।
ধানবাদ, ভারতবর্ষ।
shiva.s.mandal@gmail.com








 শিবশংকর মণ্ডল, ধানবাদ, ভারতবর্ষ।