এই পত্রিকাটি চোখ বোলানো হঠাৎ করে। ইন্টারনেটের একটা মজা আছে – মাউসে ক্লিকের পর ক্লিক করা যায়, পৌঁছানো যায় একদমই অপরিচিত দরজায় আর স্বাদ নেওয়া যায় পরিচিত আস্বাদের। পত্রিকাটির প্রকাশনের স্থান টরেন্টো হওয়ায় আকর্ষণ বাড়ে। পত্রিকাটিতে ‘মুখবন্ধ’-র জায়গাটি অন্য আর পাঁচটা পত্রিকার মত নয়; পাঠক পরিষদের লেখাটি বেশ ইন্টারেস্টিং লাগলো। সাহিত্য নিয়ে বেশ ভাবনাচিন্তা রয়েছে, শুধু ভাবনাচিন্তা বলি কেন; ভাবনাগুলির দ্বিধাহীন স্পষ্টীকরণ করা আছে। পরে সম্পাদকীয়তে ডঃ জামানের লেখাটি পড়ে বেশ আগ্রহ নিয়ে পত্রিকাটি পড়লাম।
পত্রিকাটিতে অনেক গুলি বিভাগ, সমস্ত বিভাগ নিয়ে কথা বলার মত পন্ডিত আমি নই। তাই এই লেখাটি এক অজ্ঞাত কুলশীল পাঠকের প্রতিক্রিয়া বলা যেতে পারে।
ধারাবাহিকের দুটি লেখাই এই সংখ্যার চুম্বক। দুটি লেখাই অসাধারণ - ভয় পাচ্ছি ভাল লাগাটা আগামী সংখ্যাগুলোতে থাকবে কিনা। যাই হোক এ নিয়ে যা বলার তা ধারাবাহিক দুটি কিছুদূর এগোলেই বলা সঙ্গত।
কল্পবিজ্ঞানের গল্প – ‘বোধ’ সব থেকে ভাল লেগেছে। আলাদা বিভাগে না দিয়ে ছোট গল্পের মধ্যে দিলে কোন ক্ষতি ছিলনা। সব থেকে মৌলিক লেখা। ছাত্র/শিক্ষিকার প্রশ্নোত্তরে আমার একটা প্রশ্ন ছিল – কণাগুলির বোধে যদি এমন কিছু ঘটে যে আমি আর পৃথিবীর দিকে যাবোনা তখন কি হবে? চাবি হারানোর মধ্যে কি ছিল? শীলাকে দেরী করিয়ে কি হবে? জিসানের চলে যাওয়া ছোট গল্প হিসাবে ভাল কিন্তু ঐ চাবি হারানোর মধ্যে দিয়ে জিসান আর শীলার এক অন্যরকম প্রেমের প্রবর্তন করানো যেত, তা পরিষ্কার হয়নি। গল্পটি বেশ ছোট। তাই বুঝতে পারলাম না।
ছোট গল্প বিভাগের গল্পটি পড়ার সময় ধারাবাহিকের ‘রবিবারের রং’ আগে পড়ার কারনেই হোক বা যে কারনেই হোক মনে হল দুটি লেখার মধ্যে এক আত্মিক মিল আছে। তর্ক করলে বোঝাতে পারবোনা, ওটা আমার অনুভূতি। মোটামুটি গোছের। তবে ছোট গল্পের যে চমকটা থাকে সেটা পাওয়া যায়নি, বস্তুতঃ লেখাটি অসম্পূর্ণ লাগল। পাঠক পরিষদের লেখায় যে কড়া সতর্কীকরণ ছিল সেখানে এই লেখাটি সম্পাদনার টেবিলে মঞ্জুরী পেয়েছে দেখলে অনেক প্রশ্ন জাগে। ছোট গল্প বিভাগের শুরুতে একটু খানি লেখা, ছোট গল্পের সংজ্ঞা/টংজ্ঞার মত করে- কারণটা অনুধাবন করা গেলনা। ওটা যদি দিতেই হয় তাহলে পাঠক পরিষদের লেখাটির মধ্যে কায়দা করে একটি পরিচ্ছেদের সংযোজন ঘটানো যেতে পারতো।
শিশুতোষের লেখাটি মাঝারি-মানের ,ইলাসট্রেশান ও তাই।
ইলাসট্রেশানের কথা বলতে গিয়ে মনে পড়ল ধারাবাহিক দুটি পড়ার সময় ছবির অভাব অনুভূত হয়েছে। পত্রিকার পাতাগুলিতে একটা হালকা রং থাকলে আর লাইনের মধ্যেকার গ্যাপ একটু বড় হলে ভাল লাগতো। হঠাৎ করে ধারাবাহিকে ফিরোজা হারূনের পাতাটিতে যে ভাবে কালার,ফন্ট বা পাতার সাইজ বদলে গেছে সেভাবে নয়। ওতে অসুবিধে হয়। প্রচ্ছদ নিয়েও ভাবতে হবে, কার্তিকের কুয়াশা নামটি যে ভাবে লেখা হয়েছে তাতে মনে হল একটু ছেলেমানুষি ব্যাপার রয়েছে। ...মাঝে মাঝে অসাধারণ সব প্রচ্ছদ দেখতে পাই।
ই-বুকের কারণটা বোঝা গেলনা। কেজানে ই-ম্যাগাজিনে হয়তো এসব থাকে আমার জানা নেই।
আর্কাইভ ব্যাপারটি চমৎকার। তবে এর মধ্যে কি কার্তিকের কুয়াশার প্রথম সংখ্যাটি আছে? দেখা হয়ে ওঠেনি।
কবিতা বিভাগটিতে প্রথম কবিতাটিতে বানানের ব্যাপারে যে পরিবর্তনটা দেখলাম সেটা নিয়েই মনে হয় সম্পাদকীয়তে খানিক উল্লেখ আছে। এ ব্যাপারে নির্দিষ্ট কোন বক্তব্য রাখতে গেলে যতটা পড়াশোনা করার ছিলো প্রথমেই স্বীকার করেছি তা নেই। তবে যতদূর মনে পড়ে আজ থেকে বছর পঁচিশেক আগে এ নিয়ে তর্ক বিতর্ক শুনেছিলাম বা পড়েছিলাম পরে পত্র পত্রিকাতে দেখলাম এক এক প্রকাশনী সংস্থা এক একরকমের বানান প্রয়োগ করেন তাও খুব বেশী নয়। কেউ ‘সাদা’কে ‘শাদা’ লেখেন, কিন্তু আমার বোধগম্য হয়নি এই ধরনের পরিবর্তনে মুক্তিটা কোথায়? আগেই বলেছি তর্ক করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই কারণ অত জ্ঞান নেই। আমার ভাল লাগেনি। ‘আকাশ’ কবিতাটি মোটামুটি-চলনসই। কবি বেদানুজের লেখা ‘বাইশে-শ্রাবণ’ লেখাটি অন্যরকম। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বা তাঁর কাজকে প্রেক্ষিত করা, জীবন যে মার্গে বিচরণ থাকলে অমনি ভাবে সকল সাহিত্যকর্মে অবিচল থাকা যায় তারই আশ্চর্য অভিব্যক্তি কবি নিজের অ-পারঙ্গম জীবনের সঙ্গে তুলনা করেছেন ‘সন্ধান দিয়ে যাও সেই শ্যমলিম ঘাস থেকে’। শেষ পর্যন্ত বিদায়. মৃত্যু, বিরহকে বাইশে শ্রাবণে আখ্যান দিয়েছেন – ভাল; তবু কবিতাটি কবিগুরু বিষয়ক কোন সংখ্যায় পড়তে পারলে ভাল লাগতো। আসলে কবিতারও ছোটগল্পের মত একটা ব্যাপার থাকে। প্রেক্ষাপট যেভাবে রচনা হবে সমাপ্তিও সেভাবে আনতে হবে। শুধু পড়া নয় পড়ার পর প্রাপ্তিতেও এক অনায়াস তৃপ্তি পেতে হবে। কোথাও যেন একটা অতৃপ্তি রয়ে গেল। অন্য কবিতাগুলির মধ্যে কবি পার্থসারথির লেখা ‘নামাঙ্কিত’ কবিতাটির বিষয় এবং বুনন দু’ই মন কেড়ে নেয়। অসাধারণ। কবিতাটি আমার পড়া সেরা কবিতা গুলির একটি। কবিতাটিকে প্রকাশিত হতে দেখে ভাল লাগল। ‘দূরত্ব’ – সামান্য কটি কথাতে অতি উঁচু প্রতিপাদ্য। জীবনের অভিজ্ঞতার ফসল। ভাল লাগলো অহেতুক মেদ বৃদ্ধি না করার প্রবণতাটি।
রম্যরচনা – ভাল লাগেনি। ই-ম্যাগাজিনের গ্লোবালাইজেসনের কথা মনে রাখলেও বাঙ্গালির ছা-পোষা মনোভাবের কারণে হয়তো।
প্রবন্ধ – কবি মহাদেব সাহা। প্রথমেই স্বীকার করে নিয়েছি আমার জ্ঞানের স্বল্পতা। আমি খুব সম্ভবত: ওনার লেখা পড়িনি। কারণ যা কিছু গোগ্রাসে গেলা সবই প্রায় পঁচিশ বছর আগে। তখন কার লেখা আর কি পড়ছি বোঝার আগেই পড়া শেষ। পরের কুড়ি বছর প্রায়ই অ-পড়া। আমার কাছে মহামূল্যবান লেগেছে এই লেখাটি। কারণটি কিছুক্ষণ আগেই বলেছি – তৃপ্তি। ওনার সাক্ষাৎকারটির প্রাপ্তি ভীষণ ভাল। প্রতিটি কথা মনে রাখার মতো। লেখা নিয়ে যারা একটু নাড়াচাড়া করছেন তাঁদের কাজে লাগবে। এই প্রসঙ্গে বলি এই বিভাগটি কিন্তু যেকোনো একটি পত্রিকার ক্ষেত্রে এক বিশেষ বিভাগ। প্রবন্ধের বৈচিত্র্য এবং উৎকর্ষতা একটি পত্রিকাকে অন্য পত্রিকার থেকে আলাদা করে দেয়।
লেখক পরিচিতি – সব গুলোতে একই রকম পরিচিতি নেই। ব্যাপারটা বোধহয় লেখকের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। তবু সম্পাদক মহাশয় কিছু কমন ব্যপার রাখলে পারতেন। যেমন কোয়েল সাহার বেলায়, ওনার কবিতা তো পড়া গেছে আবার কেন? আবদুল হাকিম – পরিচিতিতেও বানানের ব্যপারটা লিখেছেন। ওনার প্রাজ্ঞতার কাছে আমার বিনম্র জিজ্ঞাসা এই - যে পাঁচটি অক্ষর ব্যবহার করেননি তাতে করে কি ব্যপারটা হলো? কারণ ঐ পাঁচটি অক্ষরের বদলে ঐ রকমই শুনতে অন্য পাঁচটি অক্ষর ব্যবহার হয়েছে। যেগুলি হয়নি সে গুলি হলে কি হতো? এগুলিতে কি হয়েছে? এটা জিজ্ঞাসা করছি কারণ এই পত্রিকাতে এই ধরনের আলোচনার মতো এক পরিসর আছে। ‘ইতিহাস, বিবর্তন, প্রচলিত ধারনা’ ইত্যাদি নিয়ে এক প্রেক্ষাপট আছে। ‘বিবর্তন ও বহুমুখীতা’ কি হলো বা এলো তা একটু উদাহরণ সহকারে বলতে পারেন।
লেখাটি শেষ করি। মুক্ত গদ্য নিয়ে বলা গেলনা ঐ রকম নামের কারণে। জ্ঞানের স্বল্পতা। শুধু বলি লেখাটির স্বাচ্ছন্দ্য-ভাব আমাকে মুগ্ধ করেছে।
ম্যাগাজিনটি টরেন্টো থেকে প্রকাশিত বাংলা ম্যাগাজিন। অন্য কিছু নয় শুধু বাংলা বা সত্যি-কথা মাতৃভাষাকে ভালবেসে এই রকম একটা কর্মকাণ্ড ঘটানো আর যার মধ্যদিয়ে অনেক সহজে আমাদের প্রিয়ভাষাটির প্রচার, প্রসার আর সমৃদ্ধির চেষ্টা অবশ্যই অভিনন্দন যোগ্য। অনেক শুভেচ্ছা- প্রয়াসটি সফল হোক।

শিবশংকর মণ্ডল, ধানবাদ, ভারতবর্ষ।