কার্তিকের কুয়াশা

 

সম্পাদকের ডেস্ক থেকে

৭১ এর কালরাত্রি



১৯৭১ সাল। পাকিস্তানের রাজনৈতিক আকাশে কালো মেঘের আনাগোনা। কারণ নির্বাচনে এ্যাবসোলিউট মেজরিটি পেয়েও শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ, সরকার গঠন করতে পারছে না l কারণ সরকার গঠনে দেশের দুই অংশের সহযোগীতা প্রয়োজন l ওদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতা ভুট্টো ঘোষণা করেছেন যে, যে এম পি ঢাকায় সংসদ অধিবেশনে যোগদান করতে যাবে তার পা ভেঙ্গে দেয়া হবে l
পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ তখন খুবই অস্থির, উত্তেজিত l ভুট্টো, জেনারেল ইয়াহিয়া খানের বৈঠক চলছে শেখ মুজিবের সঙ্গে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল – বর্তমানের শেরাটনে l এ বৈঠক ছিল নিছক প্রহসন l বৈঠকের নাম করে পাকিস্তানের ধূর্তরা কালক্ষেপণ করছিল মাত্র l ঐ ‘সময়’ টুকু তাদের প্রয়োজন ছিল। কারণ সেই সময়ের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরে বিপুল সংখ্যক অস্ত্র পাকিস্তান থেকে আনা হয়। বন্দরের বাঙ্গালী কর্মচারীরা এতো বিশাল পরিমাণ মারাণাস্ত্র প্রত্যক্ষ করে চমকে ওঠে। তাদের বুঝতে বাকী থাকে না যে, এগুলো বাঙ্গালীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে। তারা জাহাজ থেকে মাল খালাস করতে অস্বীকৃতি জানায়। তাই পাকিস্তান সরকার চট্টগ্রাম বন্দর থেকে বাঙ্গালীদের সরিয়ে নিয়ে পাঞ্জাবী খালাসী নিয়োগ করে।
যাত্রীর ছদ্মবেশে লক্ষ লক্ষ পাঞ্জাবী সেনায় দেশ ছেয়ে যায়। এদিকে সাধারণ জনগণের আশা মুজিব-ভুট্টো বৈঠকে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু শেখ মুজিব বুঝেছিলেন এই দরবার বাস্তবে কোন ফল বয়ে আনবে না। তাই তিনি দেশের জনগনকে ডাক দিলেন। বললেন, ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম – এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
বাংলাদেশের পরিস্থিতি তখন উত্তাল। এরকম সময় ভুট্টো, ইয়াহিয়া রাতের অন্ধকারে ঢাকা ছেড়ে পালিয়ে যান করাচীতে আর হুকুম দিয়ে যান কুখ্যাত এক জেনারেল, টিক্কা খানকে। টিক্কা খান ছিলেন অতি নিচাশয় নিষ্ঠুর প্রকৃতির ব্যক্তি। ‘বাঙাল’দেরকে খতম করে দেয়ার সনদ লাভ করে টিক্কা খান খুব খুশী। টিক্কা খান সৈন্যদের উদ্দেশ্যে ঘোষণা দিল, ‘হামে জামিন চাহিয়ে-ইনসান নেহি।’ বাঙ্গালীদের বাংলা বলার সাধ মিটিয়ে দাও। পাঞ্জাবী এনে বাংলা মুলুকে মানুষের আবাদ করব। উন্মত্ত সেনাবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়লো ঢাকা নগরীর ঘুমন্ত মানুষদের উপর। সেদিন ছিল ২৫ শে মার্চের কালরাত্রি ১৯৭১.
ঢাকায় শোনা গেল গুরুগম্ভীর যন্ত্র নিনাদ। ঢাকাবাসী কাঁচা ঘুম থেকে জেগে উঠলো। মনে করলো ঝড় আসছে , আসছে প্রচন্ড বৃষ্টি। হ্যা, বৃষ্টি হলো ঠিকই, তবে তা কোন কালো মেঘ হতে ঠান্ডা জলকণা নয়। তা ছিল ট্যাংকের ব্যারেল হতে নিক্ষিপ্ত জীবন হরণকারী উত্তপ্ত গোলা। ঘুম ভাঙ্গা মানুষেরা জানতেও পারলো না যে, তাদের মরণ ঘনিয়ে এসেছে। নিরাপরাধ, নিরস্ত্র সাধারণ মানুষকে হত্যা করতে অস্ত্র চালকদের কোন দ্বিধাই থাকলো না। এই নির্বিচার হত্যাযজ্ঞের ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতশত তাজা প্রাণ ঝরে পড়লো। রাজারবাগ পুলিশ লাইনে বাঙ্গালীদের নির্মম ভাবে হত্যা করা হলো। মানুষ মেরে খড়ির বোঝার মতন রাস্তার মোড়ে মোড়ে স্তুপ করে রাখা হলো।
আমরা তখন কোয়েটায় — বেলুচিস্তানের প্রাদেশিক রাজধানী। ভুট্টো, মুজিবের বৈঠকের ফলাফল শোনার জন্য উৎকর্ণ। পাকিস্তানী প্রচার মাধ্যমের ওপর কোন আস্থা ছিল না আমাদের। বিদেশী রেডিও শোনা ছিল খুবই বিপদজনক। গভীর রাত্রে বিদেশী প্রচার মাধ্যমে ইয়াহিয়া, ভুট্টোর ঢাকা ত্যাগের সংবাদ পেয়ে দারুণ ভাবে উদ্বিগ্ন হই। বিনিদ্র রজনী আর শেষ হতে চায় না। ভোর রাত্রে অল ইন্ডিয়া রেডিওর একটি স্টেশান পাই। রেডিও প্রচার করছে, ‘পূর্বি বাঙ্গাল মে ভারী জান–ই নুকসান হো রাহা হ্যায়।’
সংবাদ শুনে শিউরে উঠলাম। বিশ্বাস হচ্ছে না। কিন্তু জেনোসাইটের সংবাদ তো আর মিথ্যা হতে পারে না। গভীর দুঃখে পতিত হলাম। একটু পরেই ভোর হলো। দোর খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। চারিদিক শান্ত, সুনসান। রুটিওয়ালা রুটি, দুধওয়ালা দুধ, কাগজওয়ালা পত্রিকা দিয়ে গেল। রেডিওর খবর শুনে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত আমরা। বহির্বিশ্বে পাকিস্তান প্রচার করলো এটা তাদের আভ্যন্তরীন ব্যাপার। কিছু বিদ্রোহী বাঙ্গালীকে শায়েস্তা করবার জন্য তাদেরকে এ পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে। এসব লোকদেরকে শেখ মুজিব নষ্ট করে ফেলেছে। শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী করা হয়েছে।
কিন্তু পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী জানতো না যে, অত্যাচার যখন সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়, নির্যাতিতের পিঠ যখন দেয়ালে ঠেকে, তখন কোন না কোন শেখ মুজিবের জন্ম হবেই হবে। কারার ওই লৌহ কপাট ভেঙ্গে মুক্তির মশাল জ্বালাবে সেই মুজিব। মুজিবের বাণী প্রতিধ্বনিত হতে থাকলো বাঙ্গালীর ঘরে ঘরে।
“এরপর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমাদের অনুরোধ রইলো, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। রক্ত যখন দিতে শিখেছি, রক্ত আরো দিব – এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম – এবারের সংগ্রাম – – স্বাধীনতার সংগ্রাম। ”

ফিরোজা হারুন

editor@kartiker-kuasha.nauba-aloke-bangla.com